বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

অপরাধে নৃশংসতা বাড়ছে

আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব’ বলছেন বিশেষজ্ঞরা অর্থনৈতিক সঙ্কট সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে নিষ্ঠুরতা বেড়ে যায় : নুরুল হুদা আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং আইনের শাসনের অভাবে অপরাধ বেড়ে যায় : অধ্

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ২৭ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

দেশে অপরাধীদের মধ্যে পৈচাশিকতা, নৃশংসতা বাড়ছে। একই সঙ্গে নিষ্ঠুরতা, ভয়াবহতা এত বেড়েছে যে, সামান্য ইস্যুতে ‘ভয়ঙ্কর’ হয়ে উঠেছে অপরাধীরা। সমাজে নৈতিক অবক্ষয়, দরিদ্র্যতা, হতাশা, শূন্যতা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচক কনটেন্ট অপরাধীদের আরো হিংস্র করে তুলছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যাচ্ছেতাই ব্যবহার, সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক টানাপড়েন, ব্যক্তির নৈতিক স্খলন, আইনপ্রয়োগে পক্ষপাতিত্ব, বেকারত্ব, ইউটিউবের বিভৎস কনটেন্ট ইত্যাদি অপরাধীদের বিভৎস-নিষ্ঠুরতায় সাহস দিচ্ছে। স্কুল-কলেজে নৈতিক শিক্ষার অভাব, রাজনৈতিক বিভাজন ও ধর্মহীনতাও অপরাধীদের আরো বেপরোয়া করে তুলছে। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের’ বদলে রাজনৈতিক কারণে উল্টো ‘দুষ্টের পালন শিষ্টের দমন’ অপরাধীদের হিংস্রতার জন্য কম দায়ী নয়।
জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা ইনকিলাবকে বলেন, সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে নিষ্ঠুরভাবে খুনের ঘটনা অনেক সময় বেড়ে যায়। সামাজিক ও পারিবারিকভাবে মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে; না হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ ছাড়াও অনেক সময় অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত থাকে। লোভ-লালসা বা টাকার প্রয়োজনে মানুষ খুনের মতো বড় ধরনের অপরাধও করে। সবার উচিত এদিকে দৃষ্টি দেয়া।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে এখন দরিদ্রতা, হতাশা ও শূন্যতা বেড়েছে। এটা দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নেয়নি। যার ফলে নৃশংস হত্যা বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে টার্গেট কিলিং ও অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে হত্যাসহ পরিকল্পিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নাঞ্চলে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা বেড়েই চলছে। গলাকেটে হত্যা করে লাশের টুকরা করা, শ্বাসরোধে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া এবং হত্যার পরে লাশ ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। সামান্য কিছু টাকার জন্য নানার বাসায় ডাকাতির নাটক সাজিয়ে নানাকে বন্ধুদের সহযোগিতায় হত্যা করে নাতি ও নাতনি। সম্প্রতি চট্টগ্রামে ৭ বছরের আয়াতকে হত্যার পর ছয় টুকরা করা হয়। এ সব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও উঠকণ্ঠা বিরাজ করছে। কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রতিবাদের ঝড় উঠে।

বিশেষজ্ঞদের দাবি, সামাজিক-পারিবারিক বিভিন্ন জটিলতা ও অর্থনৈতিক টানাপড়নের কারণে এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। হতাশা থেকে রাগ ও ধৈর্য হারানোর ঘটনা ঘটছে এখন। ধৈর্যচ্যুতির কারণে অল্পতেই সহিংস হয়ে উঠছে মানুষ। পারস্পরিক সহিংস মনোভাব ও সামাজিক মূল্যবোধের অভাব এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। আইনের শাসন ও বিচারপ্রার্থীদের বিচার নিশ্চিত হলে এধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। এটা নিশ্চিত করা খুব জরুরি।

বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার টাকা সংগ্রহের জন্য নানার বাড়িতে ডাকাতির পরিকল্পনা করেছিল নাতি ও নাতনি। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ১৭ নভেম্বর রাতে রাজধানীর চকবাজারের খাঁজে দেওয়ান লেনের বাড়িতে ডাকাতির সময় বাধা দিলে বৃদ্ধ মুনসুর আহম্মেদ মুনসুরকে হত্যা করে নাতি-নাতনিসহ পাঁচজন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

গত ১৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড এলাকা থেকে মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশে অপহরণ করা হয় ৭ বছর বয়সি শিশু আলিনা ইসলাম আয়াতকে। শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ ৬ টুকরা করে ফেলে দেয়া হয় কর্ণফুলী নদীতে। বাসা থেকে পার্শ্ববর্তী মসজিদে আরবি পড়তে যাওয়ার সময় নিখোঁজ হয় আয়াত। ২৫ বছর ধরে একই ভবনে বসবাস করত ঘাতক ও শিশুটির পরিবার। আয়াতের অপহরণের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় উঠে।

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার শংকরপুর এলাকার শরিফুল ইসলামের স্ত্রী তাকে তালাক দিয়ে চলে যান। স্ত্রী চলে যাওয়ার পর গত ২৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে শিশু পুত্র ইমন (৭) ও ইমরানকে (৩) বিষ প্রয়োগে হত্যা করে বাবা নিজেই। পরে স্বজনদের ফোন করে জানান এবং এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নিখোঁজ শরিফুল বিরলের শংকরপুর গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে। পেশায় তিনি কৃষক। তবে মাঝে মাঝে আইসক্রিম ফেরি করে বেড়াতেন। আড়াই মাস আগে শরিফুলকে তালাক দিয়ে চলে যান তার স্ত্রী উর্মি বেগম। স্ত্রী চলে যাওয়ার পর অর্থকষ্টে পড়েন শরিফুল। সন্তানদের হত্যা করার পেছনে অর্থ সঙ্কট বড় কারণ বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. খন্দকার ফারজানা রহমান ইনকিলাবকে বলেন, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সাধারণ মানুষের মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন। সামাজিক দায়বদ্ধতা এখন আর মানুষের মধ্যে নেই। নিজে কীভাবে বড় হবে বা নিজের স্বার্থের বাইরে মানুষ এখন ভাবছে না। এছাড়া নৃশংস খুন বা বড় কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দ্রুত বিচার হতে হবে। যাতে মানুষের মধ্যে ভয় তৈরি হয়। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে সামাজিক পরিবর্তনের ফলে মানসিক পরিবর্তন হচ্ছে। হিংসা ও ক্ষোভসহ বিভিন্ন নেগেটি মনোভাব তৈরি হচ্ছে মানুষের মধ্যে। মানুষ এখন নিজের স্বার্থকেই বড় করে দেখছে। ফলে নিজেদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে এবং মানুষ নৃশংস অপরাধ করতে চিন্তা করছে না।

এ বিষয়ে আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ইনকিলাবকে বলেন, চট্টগ্রামে এক শিশুকে ৬ টুকরা ও ঢাকায় নানাকে হত্যায় জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। হত্যাসহ সকল অপরাধের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে সারাদেশের পুলিশকে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অপরাধ করে কেউ যাতে ছাড় না পায়, সে জন্য আমরা কাজ করছি। তিনি বলেন, সকল হত্যাকাণ্ডকেই আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করি। এ পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ৯০ ভাগ শনাক্ত করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। যে সব হত্যাকাণ্ড বা বড় অপরাধ শনাক্ত করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে বিলম্ব হয়, সেগুলো সিআইডি বা পিবিআইয়ের মতো প্রতিষ্ঠান তদন্ত করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সমাজের সকলকেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম ইনকিলাবকে বলেন, সম্প্রতি সময়ে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা আমাদেরকে অস্থির করে তুলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করলে এবং দ্রুত কঠোর শাস্তি না হলে এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়। আমাদের দেশটা ছোট; কিন্তু জনসংখ্যা অনেক বেশি। আইন আছে, প্রয়োগ নেই, আইনের শাসন নেই। আইন প্রয়োগের সাথে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সীমাবদ্ধতাও আছে। রাজনৈতিক প্রভাব আছে। এসব আইনের প্রয়োগ নেই বলে সমাজে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। তিনি বলেন, আমরা এখন আমাদের শিশু ও বৃদ্ধদের নিরাপত্তা দিতে পারছি না। এ বিষয়গুলো সকলকেই নাড়া দেয়া উচিত। সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (9)
Mizan Khan ২৭ নভেম্বর, ২০২২, ৮:২২ এএম says : 0
দেশে অবৈধ সরকার তাই
Total Reply(0)
Usman Goni ২৭ নভেম্বর, ২০২২, ৮:২৩ এএম says : 0
যতক্ষন পর্যন্ত মানুষ কোরআন হাদীস মানবেনা ততক্ষন পর্যন্ত শান্তি আসবেনা
Total Reply(0)
মোহাম্মদ ফরহাদ ২৭ নভেম্বর, ২০২২, ৮:২৮ এএম says : 0
বাংলাদেশে ভারতের সব চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়ার প্রয়োজন।
Total Reply(0)
Sumon Ninad ২৭ নভেম্বর, ২০২২, ৮:২৪ এএম says : 0
যে দেশে মায়ের জঠরে থাকা অবস্থায় শিশু গুলিবিদ্ধ হয় সে দেশকে আমি মানুষের দেশ বলতে পারলাম না। যে দেশে সাপ মারবার মত করে একটি শিশুকে নৃশংসভাবে খুন করবার পর খুনী পুলিশি সহায়তায় দেশ ছেড়ে যেতে পারে, সে দেশকে আমি মানুষের দেশ বলতে পারলাম না। যে দেশে ১২ বছর বয়সী একটি শিশুর পায়ুপথ দিয়ে মোটর টায়ার হাওয়া করার নল ঢুকিয়ে নাড়িভুঁড়ি ছিন্নভিন্ন করে হত্যা করা হয়, সে দেশকে আমি মানুষের দেশ বলতে পারলাম না। যে দেশে একের পর এক বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় কিন্তু সরকার বা তার আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে বিচারের আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়, সে দেশকে আমি মানুষের দেশ বলতে পারলাম না
Total Reply(0)
Golam Mostofa ২৭ নভেম্বর, ২০২২, ৮:২৬ এএম says : 0
বাংলাদেশে ক্রাইম পেট্রোল আর সি.আই.ডি দেখানো বন্ধ করা উচিত।
Total Reply(0)
Muhammad Abu Sayed ২৭ নভেম্বর, ২০২২, ৮:২৬ এএম says : 0
এদেশে বিচার নাই কিন্তু মহান রাব্বুল আলামিন একদিন বিচার করবে আজ যারা আইন কে প্রহসন বানিয়ে রেখেছে একদিন তাদেরকেও আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে ।
Total Reply(0)
Md Absar ২৭ নভেম্বর, ২০২২, ৮:২৭ এএম says : 0
কি নিষ্পাপ মুখ। ইশ! এই মুখের দিকে তাকালেও মায়া হবার কথা। কিভাবে পারলো আল্লাহ
Total Reply(0)
Zainal Abedin Tito ২৭ নভেম্বর, ২০২২, ৮:২৭ এএম says : 0
· অত্যন্ত বেদনাদায়ক । যে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আমাদের জন্য ক্ষতিকর সেগুলো বন্ধ করে দেওয়াই উচিত ।
Total Reply(0)
Md. Jalal Uddin Rumi ২৭ নভেম্বর, ২০২২, ৯:২০ এএম says : 0
ইনকিলাব আমার পছন্দের একটি পত্রিকা, আমি প্রায় সময় পড়ি। অত্যান্ত ভালো লাগে যখন দেখি পত্রিকার মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সকল বিষয়ে তথ্য থাকে। অত্যান্ত ধন্যবাদ ইনকিলাব
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন