বিদেশে নারী গৃহকর্মী রফতানিতে কালো মেঘের ছায়া দেখা দিচ্ছে। বিদেশ গমনেচ্ছুকর্মীর বহির্গমন ছাড়পত্রসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রিতার দরুন বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সউদী নিয়োগকর্তারা। এতে সউদীর ৭০ ভাগ থেকে ৮০ ভাগ নারী গৃহকর্মীর চাহিদা কমে গেছে। মহিলা গৃহকর্মীর পাশাপাশি সউদীতে পুরুষ কর্মীর চাহিদাও হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া বিএমইটি ডিজি শহীদুল আলম হঠাৎ বিদেশ গমনেচ্ছু মহিলা গৃহকর্মীদের এক মাসের ট্রেনিং সময় বর্ধিত করে দু’মাস নির্ধারণ করায় কর্মীদের মাঝে অনীহা দেখা দিয়েছে। বায়রার একাধিক সূত্র এতথ্য জানিয়েছে। এতে জনশক্তি রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বায়রার নেতৃবৃন্দ।
বিএমইটির সূত্র জানায়, মহিলা গৃহকর্মী নিয়োগের সর্বোচ্চ দেশ হচ্ছে সউদী আরব। ১৯৯১ সাল থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশটিতে ৪ লাখ ৬২ হাজার ১৩৮ জন মহিলা গৃহকর্মী চাকরি লাভ করেছে। একই সময়ে বিভিন্ন দেশে সর্বমোট মহিলা গৃহকর্মী চাকরি লাভ করেছে ১০ লাখ ৮৫ হাজার ২৫০ জন।
বিএমইটির মহাপরিচালক হঠাৎ বিদেশগামী নারী গৃহকর্মীদের ট্রেনিং ১ মাসের স্থলে দু’মাস নির্ধারণ করায় জনশক্তি রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দু’মাস ট্রেনিংয়ে সময় ব্যয় করা হলে নারী গৃহকর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়াসম্পন্ন করতে আরো দু’মাস সময় লেগে যাবে। এতে একজন মহিলা গৃহকর্মীকে বাংলাদেশ থেকে নিতে দীর্ঘ ৪ মাস অপেক্ষা করতে নারাজ সউদী নিয়োগকর্তারা। ইতিমধ্যেই সউদী সরকার ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, আফ্রিকা মহাদেশের কেনিয়া, উগান্ড, ইউথিপিয়া ও ঘানা থেকে মহিলা গৃহকর্মী নিয়োগের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। সহজে এবং স্বল্পসময়ে মহিলা গৃহকর্মী সরবরাহ করতে উল্লেখিত দেশগুলো সজাগ দৃষ্টি রাখছে।
সউদী নিয়োগকর্তারা এসব দেশ থেকে একজন মহিলা গৃহকর্মীকে মাত্র ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যেই নিতে পারছে। ফলে বাংলাদেশের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সউদী নিয়োগকর্তারা। বাংলাদেশ থেকে একজন মহিলা গৃহকর্মী নিতে সউদী নিয়োগকর্তাদের তিন থেকে ৪ মাস অপেক্ষা করতে হয়। এতে সউদী নিয়োগকর্তারা বাংলাদেশের মহিলা গৃহকর্মীর জন্য ৪ মাস অপেক্ষা না করে অন্যান্য দেশ থেকে দ্রুত মহিলা গৃহকর্মী নিয়োগের স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সউদী আরবে নারী কর্মীর পাশাপাশি পুরুষ কর্মী গমনেও যথেষ্ট ভাটা পড়েছে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু হওয়ায় হাজার হাজার কর্মী সউদীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মালয়েশিয়ার দিকে ঝুঁকছে। রিক্রুটিং এজেন্সিজ ঐক্যপরিষদ (আরএওপি) এর সাংগঠনিক সম্পাদক মাকবুল আহমাদ পাটওয়ারী গতকাল সোমবার ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকাস্থ রাজকীয় সউদী দূতাবাসে ৫ মাস আগেও প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ হাজার ভিসা স্ট্যাম্পিং হতো। কিন্তু বর্তমানে এই সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
তিনি বলেন, সউদী আরবে অনেক নিয়োগকর্তাই ঠিক মত কাজ এবং বেতন দিচ্ছে না। যে কারণে কর্মীরা এখন সউদী আরবে যেতে অনীহা প্রকাশ করছে। অনেক সউদী নিয়োগকর্তা অভিবাসী কর্মীদের পাশাপাশি বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদেরও হয়রানি করছে। তিনি উল্লেখ করেন যে, ইনাকাতুল আমার নামে সউদী আরবের রাজধানী রিয়াদের একটি কোম্পানিতে ২০০ জন কর্মী প্রেরণ করা হয়। কর্মী যাওয়ার পর কোম্পানি ঠিকমতো রিসিভ করছে না, থাকার জায়গা খুব সীমিত, খাবার ঠিকমতো দিচ্ছে না। রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক মাকবুল আহমাদ কর্মীদের অনুরোধে সউদীগমন করলে সউদী কপিল ক্যাম্প থেকে পুলিশ দিয়ে তাকে গ্রেফতার করে ২ দিন থানা হাজতে রাখেন।
এতে তিনি সউদী কপিলের অনৈতিক আচরণে হতবাক হন। পরবর্তীতে ওই কপিল বলে ৩ লক্ষ্য সউদী রিয়েল দিলে সে মামলা তুলে নেবে তা না হলে ৫ বছর জেল খাটিয়ে ছাড়বে। কোনো উপায় না দেখে ২ লাখ ২৯ হাজার রিয়েল কপিলকে দিয়ে কোনো রকম দেশে ফেরত আসেন রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক মাকবুল আহমাদ। দেশে এসে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে এবং ঢাকার সউদী দূতাবাসকেও লিখিত চিঠি দিয়েও পর্যন্ত কোনো উত্তর পাননি। কোনো উপায় না দেখে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক কিছুসংখ্যক কর্মী দেশে ফেরত নিয়ে এসেছেন এবং কিছু কর্মী অন্য কোম্পানিতে ট্রান্সফার দিয়েছেন। সউদী লেবার কোর্টে মামলা করেও কোনো সুরাহা হয়নি। কর্মীদের ক্ষতিপূরণ এবং কপিলের প্রতারণা বাবদ সর্বসাকুল্যে ৩ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, শত শত রিক্রুটিং এজেন্সি সউদী শ্রমবাজার হতে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এই সঙ্কট উত্তোরণের জন্য উভয় সরকার বসে ন্যূনতম বেতন ঠিক করা এবং ব্যাংক কার্ডের মাধ্যমে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করলে এই সমস্যা হতে কিছুটা মুক্তি পাওয়া যাবে বলে রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক মনে করেন।
এদিকে, সউদী গমনেচ্ছু নারী গৃহকর্মীদের ভিসার সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে রিক্রুটিং এজেন্সিজ ঐক্যপরিষদের সভাপতি ও বায়রার যুগ্ম মহাসচিব এম টিপু সুলতান গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, বিপুলসংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক বায়রায় লিখিত অভিযোগ পেশ করেছেন, যে সব মহিলা গৃহকর্মী সউদী নিয়োগকর্তা রিসিভ করেছে, তাদের সংখ্যা অনুযায়ী বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর পাওনা সার্ভিস চার্জ দিচ্ছে না। বরং মুসানেদ সিস্টেমে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে কর্মী প্রেরণের সার্ভার লক করে রাখছে। মহিলা গৃহকর্মী সউদীতে পাঠানোর পরেও সার্ভিস চার্জের অর্থ প্রদান না করায় সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো চরম আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়েছে। বায়রার যুগ্ম মহাসচিব এম টিপু সুলতান বলেন, সউদী নিয়োগকর্তাদের এ ধরনের আচরণে জনশক্তি রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তিনি বলেন, মহিলা গৃহকর্মীদের ২ বছর মেয়াদে সউদী পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ সউদী নিয়োগকর্তারা মহিলা গৃহকর্মীদের নিয়ে দু’বছর পর দেশে ছুটি না পাঠিয়ে জোরপূর্বক চার বছর পর্যন্ত কাজ করাতে বাধ্য করছে। এতে সউদী নিয়োগকারীরা চুক্তি লঙ্ঘন করছে।
এছাড়া অনেক নিয়োগকর্তা ঠিকমতো বেতনও পরিশোধ করছে না। তিনি সউদীতে মহিলা গৃহকর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন এবং মহিলা শ্রমবাজার ধরে রাখতে সউদী সরকারের সাথে দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকের মাধ্যমে বাস্তবমুখী উদ্যোগ নেয়ার জন্য সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। সউদীতে মহিলা গৃহকর্মীরা প্রতি মাসে ১ হাজার থেকে ১২০০ সউদী রিয়াল বেতন পাচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে এম টিপু সুলতান বলেন, জর্ডান, ওমান, কাতারের শ্রমবাজাপর স্থবির হয়ে পড়েছে। এসব শ্রমবাজার চাঙা করতে বাস্তবমুখী উদ্যোগ নেয়ার জন্য প্রবাসী মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি। বায়রার সাবেক ইসির সদস্য ও অ্যাক্টিভ ম্যানপাওয়ার সার্ভিসেসের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী ইনকিলাবকে বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ২ মাসের ট্রেনিং গ্রহণের মহিলা গৃহকর্মীদের অনীহা, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পেতে বিড়ম্বনা এবং পাসপোর্ট পেতে অহেতুক বিলম্বের দরুন কর্মী প্রেরণে দীর্ঘসূত্রিকায় সউদী নিয়োগকর্তারা বাংলাদেশের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সম্প্রতি সউদী সরকার বিভিন্ন সোর্স কান্ট্রি থেকে মহিলা গৃহকর্মী নিয়োগের সুযোগ দেয়ায় নিয়োগকর্তারা ওইসব দেশ থেকে মহিলা কর্মী নিতে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করছে। ওইসব দেশ থেকে মাত্র ১৫ থেকে ২০ দিনে মধ্যে মহিলা কর্মী নেয়ার সুযোগ পাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে আগ্রহ হারাচ্ছে। তিনি বলেন, বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যেই সম্প্রতি নারী কর্মীদের ট্রেনিং দুই মাস করা হয়েছে। অধিকাংশ নারী কর্মীরা দুই মাসের ট্রেনিং গ্রহণ করতে আগ্রহী নয়। আগে এক মাসের ট্রেনিং করানো হতো, তখনও কেউ কেউ নারী কর্মীদের নেতিবাচক কথাও বলা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি নারী গৃহকর্মীর শ্রমবাজার ধরে রাখতে অবিলম্বে দুই মাসের ট্রেনিংয়ের সিদ্ধান্ত বাতিল করে পূর্বের এক মাসের ট্রেনিং বহাল রাখার জোর দাবি জানান।
ভিশন-২০৩০-এর আওতায় ইতিপূর্বেই সউদী আরবে শ্রম আইন সংস্কার করা হয়েছে। নতুন সিদ্ধান্তে কর্মস্থল পরিবর্তনের সুযোগ পাবেন গৃহকর্মীরা। দেশটির মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন বিভাগ এ সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে খবরের শিরোনাম হয়েছে সউদী আরবে গৃহকর্মীদের নির্যাতন ও নিগৃহীত হওয়ার খবর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে দেশটিতে যান, অনেক ক্ষেত্রে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হন। এদের বেশিরভাগই বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ফিলিপিন্সসহ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশের দরিদ্র নারী কর্মী। বছরের পর বছর নির্যাতনের শিকার হয়েও একই বাড়িতে কাজ করতে বাধ্য হন তারা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন