‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী/ আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতার এ চরণের মতোই বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে ঠাঁই নেই। বন্দিতে ভরে গেছে দেশের ৬৮ কারাগার। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ের কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৬২৬ জন। অথচ বর্তমানে বন্দি রয়েছেন ৮৪ হাজার ১১৫ জন। এর মধ্যেই গত পহেলা ডিসেম্বর থেকে পুলিশের গ্রেফতার অভিযান চলছে। চলছে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ১০ ডিসেম্বরে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ উপলক্ষ্যে প্রতিদিন শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মোহাম্মদ এমরান হোসেন মিঞা বলেন, কারাগারে ধারণক্ষমতা ২ হাজার ২৪৯ জন হলেও এখন প্রায় ৫ হাজারের বেশি বন্দি রয়েছেন। জানতে চাইলে আইন ও সালিস কেন্দ্রের মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন ইনকিলাবকে বলেন, দেশের কারাগারগুলোতে বন্দির সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হওয়াটা বড় ধরনের মানরবাধিকার লঙ্ঘন। দেশে দীর্ঘদিনের কালচার হচ্ছে বিরোধীদল রাজনৈতিক কর্মসূচি দিলে গায়েবি মামলা দিয়ে গণহারে গ্রেফতার করা। এসব মামলায় যাদের সাক্ষী করা হচ্ছে তারা বলছেন কিছুই জানেন না।
দেশের কারাগারগুলো বর্তমানে বন্দিতে ঠাঁসা; প্রতিটি কারাগারে দ্বিগুণের বেশি বন্দিকে রাখা হয়েছে। ঢাকা কারাগার থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ের ছোট্ট কারাগারে একই চিত্র। প্রতিটি কারাগারে ঠাঁই নেই অবস্থা বিরাজ করছে। বিএনপির সভা-সমাবেশকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের ফলে বন্দিতে ঠাঁসা কারাগারগুলোতে প্রতিদিন বন্দির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। দ্বিগুণ বন্দি সামাল দিতে বেসামাল হয়ে পড়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। সেইসঙ্গে দেখা দিয়েছে নানা সমস্যা। দেশের ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগারে ও ৫৫টি জেলা কারাগারের বেশিরভাগেই ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ বন্দি অবস্থান করছে। বছরের বেশিরভাগ সময়ে দ্বিগুণসংখ্যক বন্দি অবস্থান করলেও সম্প্রতি সময়ে পুলিশের বিশেষ অভিযানের কারণে বন্দির সংখ্যা বাড়ছে।
কারা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশের কেন্দ্রীয় কারাগারসহ ৬৮টি কারাগারের ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৬২৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ বন্দি ৪০ হাজার ৬৯৭ জন এবং মহিলা বন্দি ১ হাজার ৯২৯ জন। তবে বর্তমানে মোট ৮৪ হাজার ১১৫ জন বন্দি রয়েছে বিভিন্ন কারাগারে। এর মধ্যে বিদেশি বন্দি রয়েছে ৪৭২ জন, শিশু রয়েছে ৩৪১ জন, যুদ্ধাপরাধী ১২৫ জন এবং জেএমবি ৫৭৪ জন।
কারাগারের একাধিক সূত্র জানায়, সম্প্রতি রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন মামলায় পুলিশ ও র্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা বিরোধীদলীয় (বিএনপি) নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় চালাচ্ছে। গত ২৯ নভেম্বর পুলিশের কেন্দ্রীয় সদর দফতর ১৫ দিন ব্যাপী সারাদেশে গ্রেফতার অভিযানের নির্দেশনা দেয়। সে নির্দেশনা অনুযায়ী পহেলা ডিসেম্বর অভিযান শুরু হয়। গ্রেফতারকৃতদের আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন কারাগারে পাঠানো হয়। এ কারণে বন্দির সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে।
অন্যদিকে এ পরিস্থিতিতে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন- দেশের কারাগারগুলোতে এমনিতেই বন্দির বাড়তি চাপ রয়েছে। তাছাড়া কারাবন্দিদের সুযোগ-সুবিধাও খুব কম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অমানবিকও। কিন্তু তারপরও কারাগারগুলোতে বন্দির সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ফলে দেশের কারাগারগুলোতে বন্দিদের জীবনযাপন নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে। মানবাধিকারকর্মীরা ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অধিক বন্দিকে রাখা মানবাধিকার লংঘনের নামান্তর মনে করছেন।
কারাগার সূত্রে জানা গেছে, খুলনা কারাগারের ধারণ ক্ষমতা ৬৭৮ জন। অথচ গতকাল সোমবার বন্দির সংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ তথা ১ হাজার ২১৪ জন। বাগেরহাট কারাগারের বন্দি ধারণ ক্ষমতা ৫৬৫ জন হলেও গতকাল ছিল ৬১৪ জন। সাতক্ষীরা জেলা কারাগোরের ধারণক্ষমতা ৪০০ জন বন্দি হলেও গতকাল ছিল ৫৮০ জন। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের ধারণ ক্ষমতা ২ হাজার জন বন্দি হলেও গতকাল ছিল ২ হাজার ৬০০ জন।
কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক ইনকিলাবকে বলেন, দেশের কারাগারগুলোতে বন্দির সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম দৃষ্টান্ত। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে এখন প্রতিদিন যে গ্রেফতার চলছে তা নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এ ধরনের গ্রেফতার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। কারাগারগুলোতে বন্দি বেড়ে যাওয়ায় কারা কর্মকর্তাদের মধ্যে মানসিক চাপ ও অতিরিক্ত কাজ করার চাপ বেড়ে গেছে। বিষয়টি কারো জন্যই মঙ্গল নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কারা কর্মকর্তা ইনকিলাবকে জানান, সাধারণত কারাগারগুলোতে প্রতিদিন যে সংখ্যক আসামি আদালতের মাধ্যমে কারাগারে আসে, সমান সংখ্যক আসামি জামিনে মুক্তি পায়। সম্প্রতি বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার আসামির সংখ্যা বেড়েছে; কিন্তু সে অনুযায়ী জামিন হচ্ছে না। ফলে কারাগারগুলোতে বন্দির সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে।
এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইনকিলাবকে বলেন, জনসাধারণের কাছে এটা একটা বড় চিন্তার বিষয় যে, কারাগারে পর্যায়ক্রমে বন্দির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর সাথে অনেকগুলো কারণ জড়িত। প্রথম কারণটি হলো, রাজনীতির মধ্যে যত বেশি পরস্পর আস্থাহীনতা, পরস্পর বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক এবং যত বেশি দুর্বৃত্তায়নের প্রক্রিয়া জোরালো হচ্ছে, তত বেশি মামলা হচ্ছে। ঠিক সে কারণেই তত বেশি কারাগারে বন্দির সংখ্যাটা বেড়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ক্ষমতাসীনদের আন্দোলকারী দলগুলোর ওপর প্রতিহিংসার বিষয়টি বেশ লক্ষণীয়। আবার যখন কেউ কোনো অপরাধ করবে বা হামলা করবে, তখন অবশ্যই তার বিরুদ্ধে মামলা হবে এবং তাকে কারাগারে বন্দি হিসেবে পাঠানো হবে। তিনি বলেন, বন্দি বেড়ে যাওয়া দেখে স্বাভাবিকভাবে এটা মনে হয় যে, আমাদের দেশে অপরাধ এবং সহিংসতার মাত্রা বাড়ছে। তবে এটাও ঠিক যে বর্তমান সময়ে কমিউনিটি ক্রাইমের মামলার চেয়ে রাজনৈতিক মামলার সংখ্যা বেশি। এর অবশ্য বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যাও রয়েছে। এখন যেখানে ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার, সেখানে আছে প্রায় ৮৫ হাজারের মতো। তাহলে বোঝা যায় যে, ৪২ হাজার বন্দির জন্য যে ব্যবস্থা, সেটাই ব্যবহার করছে ৮৫ হাজারের বন্দি। সে কারণে আসলে সেখানে সংশোধনের কোনো সুযোগই তৈরি হয় না।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, অতিরিক্ত বন্দির ভারে টালমাটাল চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার। বন্দির সংখ্যার দিক দিয়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই কারাগারে গতকাল সোমবার ৫ হাজার ৪৫৮ জন বন্দি ছিলেন। যা ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি। কারাগারের বর্তমান ধারণক্ষমতা ২২৪৯ জন। জানা গেছে গত কয়েক দিন থেকে কারাগারে বন্দি আসার হার বাড়ছে। আবার আগের তুলনায় বন্দিদের মুক্তির সংখ্যা কমেছে।
গত ৮ থেকে ১০ দিনে সারাদেশ থেকে বিরোধী দলের কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের মাধ্যমে সমাজে ভয়ের সৃষ্টি করা হচ্ছে। মানুষ তার নিজের কথা বলতে পারছেন না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন