রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও ডলার সঙ্কটে আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে দেশের অনেক ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর অনীহার কারণে ধারাবাহিকভাবে কমছে এলসি খোলার হার। এমনকি দেশের অন্তত ২০টি ব্যাংকের কাছে ঋণপত্র (এলসি) দায় মেটানোর মতো কোনো ডলার নেই। আমদানি দায় পরিশোধ করতে গিয়েই ঘাটতিতে পড়েছে এসব ব্যাংক। দেশের একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী এবং বেসরকারি প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী এক আলোচনায় বলেছেন, ডলার সঙ্কটের কারনে আমরা এখন এলসি করতে পারছি না। ২০টি এলসি অপেক্ষমান। কোনদিন এলসি খুলতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে হয়নি। ২০টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেও এলসি খোলা সম্ভব হয়নি। বিশিষ্ট এ শিল্পপতি বলেন, যদি এলসি করতে না পারি, তাহলে কিভাবে ব্যবসা করবো?
সূত্র জানায়, রেমিট্যান্স (প্রবাস আয়) ও রফতানি আয় থেকে আসা ডলার দিয়েও নিজেদের আমদানি দায় এবং গ্রাহকদের বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এ কারণে আমদানির নতুন এলসি খোলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। যে কয়েকটি ব্যাংকের কাছে এখনো ডলার আছে, সেগুলোও কমে আসছে। আর এই সঙ্কটের কারণে প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে আন্তব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজার। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও আমদানি করতে পারছেন না দেশের আমদানিকারকরা। এতে দেশে ভোগ্যপণ্য সঙ্কটের পাশাপাশি দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। ২-৩ লাখ ডলারের এলসি খুলতেও চাচ্ছেন না ব্যাংক কর্মকর্তারা। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ভোগ্যপণ্য আমদানির এলসি খোলায় কোনো বিধিনিষেধ নেই। সূত্রগুলো জানায়, ডলার সংকটের কারণে বিলাসী পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করে সরকার। এরপর থেকে আমদানির পাশাপাশি এলসি খোলার হার হ্রাস পেতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা জানান, বিদেশি মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে গত ৪ঠা জুলাই আমদানি ঋণপত্র খোলার ওপর কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়। গাড়ি, স্বর্ণ, টিভি, ফ্রিজসহ ২৭ ধরনের পণ্য আমদানির এলসি মার্জিন নির্ধারণ করা হয় শতভাগ। সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য মতে, সম্প্রতি বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংক বহুজাতিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক মাশরেক ব্যাংক, আবুধাবি কমার্শিয়াল ব্যাংক (এডিসিবি), জার্মানিভিত্তিক কমার্জ ব্যাংক, ভারতের অ্যাক্সিস ব্যাংকের বেশ কিছু এলসি দায় নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের ব্যাংকও রয়েছে ব্যর্থ হওয়ার তালিকায়। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মতো দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংকও নির্ধারিত সময়ে এলসি দায় পরিশোধ করতে পারেনি।
সূত্র মতে, ডলার সঙ্কট দিনের পর দিন বাড়ছেই। চলতি বছরের নভেম্বরে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় কিছুটা বাড়লেও এ সঙ্কট ভয়ানক আকার ধারণ করতে পারে বলে ধারণা অর্থনীতিবিদদের। সঙ্কটের কথা বিবেচনা করে অনেক ব্যাংক খুলছে না আমদানির ঋণপত্র (এলসি)। ইতোমধ্যেই প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে স্টুডেন্ট ফাইল বা বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদের খরচ পাঠানোর সুযোগ। এ অবস্থা আর ৬ মাস অব্যাহত থাকলে রিজার্ভের অবস্থা আরও নাজুক হয়ে উঠবে বলে শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তবে ব্যাংকগুলো বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে শিক্ষার্থীদের ফাইল খুলছে না। এভাবে প্রচুর ডলার প্রয়োজন হয়, তাই এখন এ সঙ্কটের সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এমন নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানায় কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক।
চলতি বছরের শুরু থেকেই ডলারের চাহিদা তীব্র হয়ে উঠেছে। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে ইতিহাসের সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। এ সঙ্কট আরও তীব্র করছে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের নীতি সুদহার বৃদ্ধি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে নীতি সুদহার। ২০০৮ সালের পর সর্বোচ্চ ৪ শতাংশে অবস্থান করছে সুদ। এ কারণে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ না করে ঋণপত্র কিনছে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের। ফলে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না বিশ্ববাজারে।
সুদহার ৪ শতাংশ হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা ডলার আমানত হিসেবে রাখছেন ফেডারেল ব্যাংকে। এ কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ কমে গেছে। চাহিদা বাড়ায় দাম বেড়েছে মুদ্রাটির। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে।
চাহিদা বাড়ার খবরে একটি পক্ষ মজুদ করা শুরু করে এ বৈদেশিক মুদ্রা। এতে হুট করেই কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি হয় খোলাবাজারে। এক লাফে ৯১ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকা পর্যন্ত ডলার বিক্রি হয় খোলাবাজারে। শুধু ডলারই নয়, অন্যান্য মুদ্রার দামও বাড়ে এ সময়। রিয়াল, দিনার, রিঙ্গিত সবকিছুর দামই বেড়ে যায়। এ অবস্থায় ডলার মজুদের পাশাপাশি অস্বাভাবিক বেড়ে যায় আমদানির জন্য এলসি খোলা, যা ডলারকে আরও দুর্মূল্য করে তোলে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলায় অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে ভোগ্যপণ্যের বাজার। জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ৭৪ ডলার থেকে ১২০ ডলারে পৌঁছে যায়। এ কারণে বাংলাদেশেও বাড়ে জ্বালানি তেলের দাম, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেয়। গত তিন মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ শতাংশের বেশি।
এমন অবস্থায় দেশের আমদানি এত বেড়ে যায়, রিজার্ভ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে কমে যায় ১৩ বিলিয়ন ডলার। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ সংরক্ষণে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে। এ কারণে গত পাঁচ মাসে আমদানি কিছুটা কমে কিন্তু আগের এলসির (লেটার অব ক্রেডিট) দায় শোধ করতে গিয়ে ডলার খরচের হার প্রায় আগের মতোই থেকে যায়।
এছাড়া ডলার সঙ্কটের কারণে দেশের অনেক ব্যাংকই নির্ধারিত তারিখে এলসি দায় পরিশোধ করতে পারছে না। কোনো কোনো দায় পরিশোধে এক মাসও বিলম্ব হচ্ছে। এ অবস্থায় এলসির নিশ্চয়তা দেয়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। বিদেশি অনেক ব্যাংকই এখন বাংলাদেশের জন্য নিজেদের ক্রেডিট লাইন কমিয়ে দিতে শুরু করেছে।
ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, বিদ্যমান ডলার সঙ্কট পরিস্থিতি ভয়াবহ। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পারছেন না। প্রতিদিনই কোনো না কোনো ব্যাংক এলসি দায় পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর ডলার ঘাটতির পরিমাণও বাড়ছে। রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ যে হারে কমছে, তাতে ডলার সঙ্কট আরো তীব্র হবে। ব্যাংকগুলো এলসি দায় পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় বিদেশি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের এলসি নেয়াই বন্ধ করে দিতে পারে। দেশের অন্তত পাঁচটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী প্রায় একই কথা বলেছেন। তবে কেউই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
এদিকে এলসির পেমেন্ট করতে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিকে তাকিয়ে থাকে। গত অর্থবছরে বাজারকে সহযোগিতা করতে গিয়ে ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই পাঁচ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এভাবে ডলার বিক্রি করতে থাকলে রিজার্ভ আরও নাজুক হয়ে পড়বে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
এদিকে দেশের মার্কিন ডলার জোগানের প্রধান দুটি খাত রফতানি ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। এ দুটি খাতই ধুঁকছে। চলতি বছরের নভেম্বরে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা গত ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে অক্টোবরে এর পরিমাণ ছিল ১৫২ কোটি ৫৪ লাখ মার্কিন ডলার। এর আগের মাস সেপ্টেম্বরে রেমিট্যোন্স এসেছিল ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ মার্কিন ডলার। এর আগে জুলাই ও আগস্ট মাসে রেমিট্যান্সে ৪১৩ কোটি ডলার আয় হয়।
এছাড়া রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অক্টোবর শেষে সামগ্রিকভাবে পণ্য রফতানিতে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। নভেম্বর শেষে সেটি বেড়ে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ হয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ২ হাজার ১৯৫ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে রিজার্ভের পরিমান ৩৩ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। যদিও আইএমএফের হিসেবে এই রিজার্ভের পরিমাণ আরো ৮ বিলিয়ন ডলার কম।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুুবুর রহমান বলেছেন, ডলার সঙ্কটের কারণে এলসি খোলার পরিমাণ অনেক কমানো হয়েছে। আমাদের ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ৭০ শতাংশই রেমিট্যান্স থেকে আসে। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহের হার কিছুটা কমে গেছে। এ কারণে আমদানির এলসি খুলতে বাড়তি সতর্কতা নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী নতুন এলসি খোলা কমিয়ে আনা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন