সারা দেশে রেলের লেভেল ক্রসিংগুলো মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার অবৈধ ও বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে ঝরছে তাজা প্রাণ। দিন দিন নিরাপদ বাহনের তকমা হারাচ্ছে রেল। নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ডুবতে বসেছে রেলের সুনাম। সারা দেশে রেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ৮৯ শতাংশই অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে। রেলপথের ওপর দিয়ে কোথাও কোথাও সড়ক চলে গেছে। লেভেল ক্রসিং এগুলোকে বৈধ, অবৈধ, পাহারাদার আছে, পাহারাদার নেই এভাবে শ্রেণিবিন্যাস করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। কখনো বাসের সঙ্গে, কখনো মাইক্রোবাসসহ অন্য যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটে। অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে ছোট একটি সতর্কীকরণ নোটিস ঝুলিয়ে কর্তৃপক্ষ দায় সেরেছে।
জানা যায়, রেলের আইন অনুসারে লাইনের দুই পাশে ১০ ফুট করে মোট ২০ ফুট এলাকায় যেকোনো মানুষ প্রবেশ করলেই তা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। এমনকি ২০ ফুটের মধ্যে কোনো গবাদিপশু প্রবেশ করলেও তা আটকের মাধ্যমে বিক্রি করে রেলওয়ের কোষাগারে জমার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এসব আইন মানেন না কেউই। আবার আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। রাজধানীরসহ সারাদেশের রেললাইনের পাশে গড়ে উঠেছে বাজার। ট্রেন আসার আগ মুহূর্তে লাইনম্যান দুদিকে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা পারাপার বন্ধ করে দেন। কিন্তু ব্যারিকেডের নিচ দিয়ে কিংবা একটু দূরে লোহার বার তুলে ঢুকে পড়েন পথচারী এবং সাইকেল-মোটরসাইকেল চালকদের অনেকেই। দায়িত্বরত গেটম্যানরা বাঁশি বাজালেও তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। আর অনেক লেভেল ক্রসিং আছে যেখানে নেই কোন গেটম্যান অথবা নেই কোন প্রতিবন্ধকতা।
গত ৩৪০ দিনে ১ হাজার ৫৩৫টি দুর্ঘটনায় নিহত ২৬১ জন এবং আহত হয়েছেন ১ হাজার ৭১৩ জন। দেশের সড়ক ও রেলপথ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন সেভ দ্যা রোড এ তথ্য জানায়। অবৈধ লেভেল ক্রসিং সমস্যা সমাধান না করায় সর্বশেষ কুমিল্লার দক্ষিণ খিলা তুগুরিয়ায় রেলপথে চারজন নিহত হন। অধিকাংশ দুর্ঘটনাই অবৈধ লেভেল ক্রসিং, গেট কিপারদের দায়িত্বে অবহেলা এবং অসাবধানতার কারণে বলে জানিয়েছেন সেভ দ্য রোডের মহাসচিব শান্তা ফারজানা। রেলের ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে অবৈধ ১ হাজার ৩৬১টির সমস্যা সমাধানে কার্যত কোনো উদ্যোগ না নেয়া প্রায় ৪৮ শতাংশ অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মিছিল বড় হচ্ছে, যা জাতীয় জীবনে নির্মমতা তৈরি করছে বলেও জানান তিনি।
সেভ দ্য রোডের গবেষণা সেলের তথ্য মতে, বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে ৬৩২টিতে গেটকিপার নেই। অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোয় যেমন গেটকিপার নেই, নেই কোনো সুরক্ষা সরঞ্জামও। রেল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা দায়িত্বে অবহেলার কারণে চলতি বছরের জানুয়ারিতে রেলপথ দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৬টি, আহত হয়েছে ৫২, নিহত হয়েছে ১৪ জন, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রেলপথ দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪১টি, আহত হয়েছে ১১১ জন, নিহত হয়েছেন ২৭ জন। মার্চ পর্যন্ত রেলপথে দুর্ঘটনা ঘটেছে ২২২ টি, আহত হয়েছে ১৮৬ জন, নিহত হয়েছে ৩১ জন, এপ্রিল পর্যন্ত রেলপথ দুর্ঘটনা ঘটেছে ১১২ টি, আহত হয়েছে ১৬৬ জন, নিহত হয়েছে ৪২ জন, মে মাসে আহত ২২১ জন, নিহত হয়েছেন ২৩ জন, দুর্ঘটনা ঘটেছে ২১২ টি। জুন মাসে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৯৭টি, আহত হয়েছেন ১৭২ জন, নিহত হয়েছেন ১৭ জন এবং জুলাই মাসে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৪২টি, আহত হয়েছে ২৩২ জন, নিহত হয়েছে ২৪ জন, আগস্টে ১৬৬টি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৭৪ জন এবং নিহত হয়েছেন ১৯ জন। সেপ্টেম্বরে ১৭৮টি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৭৪ জন এবং নিহত হয়েছেস ১৪ জন, অক্টোবরে ৯৯টি দুর্ঘটনায় ১১১ জন আহত এবং ২৬ জন নিহত হয়েছেন। নভেম্বরে ১১১টি দুর্ঘটনায় ৯৮ জন আহত এবং ১৯ জন নিহত হয়েছেন এবং ১ ডিসেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮টি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৬ জন, নিহত ৫ জন।
এ পর্যন্ত সব রেলপথ দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি নিহতদের পরিবারকে কমপক্ষে ১০ লাখ এবং আহতদের সরকারি অর্থায়নে চিকিৎসার দাবি জানিয়েছেন সেভ দ্য রোড নেতারা। একই সঙ্গে রেলের বর্তমান পরিস্থিতির উত্তরণে সেভ দ্য রোডের পক্ষ থেকে ৭টি সুপারিশ দেয়া হয়েছে। সুপারিশগুলো হলো- ১. অবৈধ ক্রসিংগুলোর সমাধান ও অবৈধ দখল থেকে রেলের সব সম্পত্তি মুক্ত করা। ২. সেবা সপ্তাহসহ বিভিন্ন ইস্যুতে অপচয়-দুর্নীতি বন্ধের লক্ষ্যে দুর্নীতিবাজ রেল কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া। ৩. সরকারি লেজুরভিত্তিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক লীগ’র নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করে রেলকে গণমুখী বাহন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। ৪. যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশ রেলকে বেসরকারি খাত থেকে মুক্ত করে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধায়নে পরিচালনার সুপরিকল্পিত উদ্যেগ গ্রহণ করা। ৫. সচিব-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব রকম আরাম-আয়েশ বাতিল করে সারাদেশে রেলের উন্নয়নে জনসাধারণের সেবার নিমিত্তে নিবেদিত রাখা। ৬. টিকিট কালোবাজারি বন্ধ করে যাত্রী সেবার মান উন্নয়নে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপর নজরদারি বাড়ানো এবং সারাদেশের সব স্থানে কার্যকর সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা। ৭. ৩ কিলোমিটার অন্তর অন্তর রেলওয়ে পুলিশের বিশেষ পর্যবেক্ষণ বুথ স্থাপন করা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক ইনকিলাবকে বলেন, শুধু যে লেভেল ক্রসিং ঝুঁকিপূর্ণ তা নয়। রেল লাইনের আশেপাশের এলাকাও ঝুঁকিপূর্ণ। সড়কের সঙ্গে রেলের কোনো সমন্বয় নেই। প্রতিবন্ধক বা পাহারাদার ছাড়া কোনো লেভেল ক্রসিং রাখার কোন অর্থ নেই। মানুষ বাঁচানোর উন্নয়ন করতে হবে। নগরায়নের জন্য রেল লাইনের প্রতি কিলোমিটারের মধ্যে একটি করে লেভেল ক্রসিং তৈরি হয়ে গেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন