মাওলানা আব্দুল্লাহ আল হাদী
॥ দুই ॥
হাদীস : মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়- বুখারী শরীফ। মুসলিমকে হত্যা করা-ই- নয়, অন্যায়ভাবে কোন অমুসলিমকে হত্যা করাও ইসলামে নিষিদ্ধ এমনকি শিশুদের এবং বৃদ্ধদেরকেও হত্যা করা হারাম।
হাদীস : শান্তির পরিবেশ নিশ্চিত করতে মহানবী (সা.) ঘোষণা করেছেন- তোমরা একে অন্যকে হিংসা করবে না, একে অন্যের প্রতি শত্রুতা পোষণ করবে না, একে অন্যের পিছনে দোষ খুঁজে বেড়াবে না। একে অন্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে না। আল্লাহ্র বান্দা সবাই ভাই ভাই হয়ে যাও। (বুখারী শরীফ)
কোন সমাজে বা রাষ্ট্রে এ নির্দেশগুলো যথাযথভাবে পালিত হলে সে সমাজে বা রাষ্ট্রে মারামারি হানাহানী সন্ত্রাসী দূর হয়ে শান্তির রাজ্য কায়েম হবে।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রাসূল (সা.)-এর ভূমিকা
মহানবী (সা.) শান্তি প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে আরব দেশে আগমণ করেছিলেন। মহানবী (সা.)-এর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল শান্তি ও কল্যাণের জন্য। তাই আল্লাহ্ তা’আলা বলেন- আমি তো আপনাকে বিশ্ব জগতের প্রতি কেবল রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়া-১০৭) সমাজের সকল মানুষ যাতে সুখে-শান্তি ও নিরাপদে জীবন-যাপন করতে পারে সেজন্য তিনি বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন যথা-
হিলফুল ফুযুল সংগঠন :
সমাজে যখন অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, লণ্ঠন, হত্যা প্রভৃতি সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মতো জঘন্য অপরাধে আরববাসী লিপ্ত ছিল। তখন নবী করীম (সা.) তার প্রতিকারার্থে কতিপয় যুবককে নিয়ে গড়ে তুললেন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠন হিলফুল ফুযুল। মাত্র ২০ বছর বয়সে গড়ে তোলা এই সংগঠনের মূল্য উদ্দেশ্য ছিল সমাজ থেকে সন্ত্রাস নির্মূল করা। হিলফুল ফুযুলের শর্ত সমূহের প্রথম শর্ত ছিল আল্লাহ্র হুকুমে মক্কা নগরীতে কারো উপর অত্যাচার হলে আমরা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে অত্যাচারিতকে সাহায্য করব। চাই সে উঁচু শ্রেণীর লোক হোক বা নীচু শ্রেণীর, স্থানীয় হোক বা বিদেশী। (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ-২২৮ পৃষ্ঠা) এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে নবী করিম (সা.) সন্ত্রাস নিমূর্লের প্রয়াস চালিয়েছেন।
মদীনার সনদ প্রণয়ন করা :
হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে মদীনা হিজরত করে মদীনা বসবাসরত বহু জাতীয় নাগরিকদের নিয়ে সন্ত্রাস দুর্নীতি শংকামুক্ত একটি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হওয়া সত্ত্বেও সকল ধর্মের অনুসারী নাগরিকদের সার্বিক নাগরিক ভার সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে অর্থাৎ- বুনু কুরায়জা বুনু নজীর বুনু কায়নুকা। তিনি একটি ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করেন। ইতিহাসে তা মদীনা সনদ হিসেবে খ্যাত। এই সনদের উল্লেখযোগ্য ধারাগুলো ছিল।
১। সনদে স্বাক্ষরকারী মুসলমান, ইয়াহুদী, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক সকল সম্প্রদায়ের নাগরিকরা সমান অধিকার লাভ করবে। তারা এক জাতি হিসাবে বিবেচিত হবে।
২। সকলের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে। মুসলিম- অমুসলিম সকলে স্ব-স্ব ধর্ম পালন করতে পারবে। কেউ কারো ধর্মে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
৩। হত্যা রক্তপাতসহ সকল প্রকার অপরাধমূলক কার্যকলাপ একেবারেই নিষিদ্ধ। এবং উক্ত সনদের ২১নং ধারায় উল্লেখ আছে যে, ব্যক্তি কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে হত্যা করবে এবং সাক্ষ্য প্রমাণে তা প্রমাণিত হবে তার উপর কিসাস গ্রহণ করা হইবে। এভাবে নবী করীম (সা.) জাতি, ধমর্, বর্ণ নির্বিশেষে মদীনায় বসবাসরত সকল জনসাধারণের সন্ত্রাসমুক্ত জীবন-যাপনের পথ নিশ্চিত করেন। মদীনার সনদ হচ্ছে মানব ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান ৪৭টি ধারা সম্বলিত মদীনা সনদটি সন্ত্রাস প্রতিরোধে অনন্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত।
সমাজ বা রাষ্ট্র থেকে সন্ত্রাস প্রতিরোধে আমাদের করনীয় :
সন্ত্রাস নিমূর্লে মহানবী (সা.) যে সব ভূমিকা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তার আলোকে নি¤েœাক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে ফিতনা-ফ্যাসাদ, সন্ত্রাস নিমূল করা যাবে ইনশাল্লাহ।
১। নৈতিক শিক্ষার প্রসার : মানবিক ও নৈতিক গুণাবলীর অভাবে একজন মানুষ সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে। সেইজন্য নৈতিক তথা প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। যাতে মানুষ তা নিজের মধ্যে রপ্ত করে খাটি মানুষ বা ইনসানে কামেল হতে পারে।
২। যুব শ্রেণীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা : সমাজ ও রাষ্ট্রের যুবকরাই চালিত শক্তি, যুবকরাই পারে এ সমাজ ভেঙে আবার নতুন করে গড়ে তুলতে। এজন্য মহান আল্লাহ্ও যুব শ্রেণীকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। কিয়ামতের ময়দানে যেদিন আল্লাহ্র আরশের ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। সাত শ্রেণীর লোককে ছায়া দিবেন তন্মধ্যে এক শ্রেণী সেই যুবক যে আল্লাহ্র ইবাদতে কাটিয়েছে। তাই যুবকদেরকে নৈতিক ও উন্নত চরিত্র গঠনে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
৩। পরকালীন জবাবদিহিতা ও শাস্তির ভয় সম্পর্কে জনগণকে অবহিতকরণ : আল্লাহ্ মানুষের কল্যাণের জন্য কোরআন, নবী (সা.) উপর অবর্তীণ করে জানিয়ে দিয়েছেন যে, সীমালঙ্ঘন করা এবং দুনিয়াবী জীবন যাত্রাকে অগ্রাধিকার দেয়ার পরিণাম জাহান্নাম পক্ষান্তরে আল্লাহ্কে ভয় করা এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখা আখিরাতকে প্রধান্য দেয়ার পরিণাম চির শান্তির নিবাস জান্নাত। যেমন সূরা নাজিআত ৩৭নং আয়াতে উল্লেখ আছে- অন্তর যে সীমালঙ্ঘন করে এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দেয় জাহান্নামই হবে তার আবাস। পক্ষান্তরে যে স্বীয় প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত হবার ভয় রাখে প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে জান্নাত হবে তার আবাস এবং সাথে সাথে দুনিয়ার ফ্যাসাদ- বিপর্যয় ও সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য আল্লাহ্ আখিরাতে যে ভয়াবহ শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন তা জনগণকে অবহিত করতে হবে। যাতে তা স্মরণ করে সন্ত্রাসী থেকে বিরত থাকে।
৪। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা : কঠোর আইন প্রণয়ন করলেই হবে না। তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কোন সন্ত্রাসী যেন আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে বা অবৈধ পন্থার আশ্রয় নিয়ে মাফ পেয়ে না যায় সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। সন্ত্রাসীদের অর্থ বিত্তের অভাব নেই। সকল অবৈধ পথ যদি বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে কঠোর শাস্তির ভয়ে সন্ত্রাসী কর্মকা- থেকে নিবৃত্ত থাকবে।
৫। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান কায়েম করা : যে সমস্ত লোকেরা সমাজে, রাষ্ট্রে ফিৎনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টির সাথে জড়িত তাদেরকে জনসমক্ষে এমন শাস্তির বিধান করতে হবে যা দেখে অন্য লোক সংশোধন হয়ে যায়।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ কয়েকটি কারণে হতে পারে :
(ক) ধর্ম সম্পর্কে সত্যিকারের জ্ঞানের অভাবে, (খ) দুর্বল ঈমান ও তাকওয়ার অভাবে, (গ) চারিত্রিক বিভিন্ন ত্রুটির কারণে, (ঘ) নেতৃত্ব ও ক্ষমতার লোভের কারণে, (ঙ) অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা ও বেকারত্বের কারণে, (চ) দেশ ও জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাব। তলোয়ার বা অস্ত্রের দ্বারা কোথাও ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারত সহ এ উপমহাদেশের অসংখ্য আউলিয়া কেরামের মাজার রয়েছে। তারা নিজেদের মাতৃভূমি ছেড়ে এদেশে আস্তানা গেড়েছিল। মানুষের কলবে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছিয়ে দিয়ে তাদেরকে আল্লাহ্র পথে আনার জন্য। তাদেরকেও তলোয়ার বা অস্ত্র দিয়ে মানুষকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেননি। বরং সঠিক দাওয়াত ও আদর্শের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন