কোরআন মাজিদে ‘আন নিসা’ তথা ‘নারী’ শিরোনামে বিশেষ সুরা রয়েছে। কিন্তু ‘রিজাল’ তথা ‘পুরুষ’ শিরোনামে কোনো সুরা নেই। এটিই ইসলামে নারীর মর্যাদা বোঝার সহজ বোধোদয়। ইসলাম মানবতার শ্রেষ্ঠ ধর্ম। বিশ্বমানবতার কল্যাণে ইসলামের আবির্ভাব। নারী-পুরুষের অধিকার সুনিশ্চিত করতে ইসলামের অবদান সবচেয়ে বেশি। ইদানীংকালের সবচেয়ে বড় আলোচিত বিষয় নারী নির্যাতন। এ নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ইসলামের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশসহ বিশ্ব মিডিয়ার দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও অহরহ ঘটে চলেছে নারীর প্রতি অমানুষিক নির্যাতন। অথচ ইসলাম নারীকে দিয়েছে যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান। ইসলাম নারীকে মা, স্ত্রী, বোন ও কন্যার পরিচয়ে সংরক্ষণ করে দিয়েছে মর্যাদা সব অধিকার।
নারীর মর্যাদা : ‘এই পৃথিবীর যত মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ হ্যাঁ! নারীরা একে অপরের সাহায্যকারী বন্ধু হওয়া, সৎকর্মশীল হওয়া, অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকা, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করা, বার্ষিক হজ পালন, জাকাত দেওয়াসহ ইবাদত-বন্দেগি পালন ও সামাজিক প্রায় সব কাজেই পুরুষের মতো নারীদের অংশগ্রহণ ও কার্যক্রম পরিচালনা বাধ্যতামূলক। এসব কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারীরা তাদের নৈতিক উৎকর্ষ বৃদ্ধি করতে পারে এবং আল্লাহমুখী আধ্যাত্মিক চেতনা গড়ে তুলতে পারে। পবিত্র কুরআনের বর্ণনায় বিষয়টি সুস্পষ্ট। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনÑ হে নবি! ঈমানদার নারীরা যখন আপনার কাছে এসে আনুগত্যের শপথ করে যে, তারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, জারজ সন্তানকে স্বামীর ঔরস থেকে আপন গর্ভজাত সন্তান বলে মিথ্যা দাবি করবে না এবং ভালো কাজে আপনার অবাধ্যতা করবে না, তখন তাদের আনুগত্য গ্রহণ করুন এবং তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল অত্যন্ত দয়ালু।’ (সুরা মুমতাহিনা, আয়াত ১২)।
কুরআন-সুন্নাহে নারীর প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি : সমাজে যখন নারীর অবস্থান ছিল অমানবিক; তখন থেকেই ইসলাম নারীর অধিকার ও মর্যাদা উন্নয়নের জন্য নজিরবিহীন পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশ্বজুড়ে নারী নির্যাতনের কিছু দিক তুলে ধরে তা প্রতিরোধে ইসলামের বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ তুলে ধরা হলোÑ ১. নারী সৃষ্টিতে সেরা : মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ অত্যন্ত সম্মানিত ও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। ইসলাম জন্মগতভাবে মানুষকে এ মর্যাদা দিয়েছে। কেননা ইসলামের বিধিবিধান নারী-পুরুষ সবার জন্য সমানভাবে শাশ্বত ও চিরন্তন। আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘আর নিশ্চয় আমি আদম সন্তানদেরকে সম্মানিত করেছি।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৭০)।
এ আয়াত থেকে প্রমাণিত মানবিক সম্মান ও মর্যাদার বিচারে নারী ও পুরুষের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। কোনো নারীকে শুধু নারী হয়ে জন্মানোর কারণে পুরুষের তুলনায় হীন ও নীচ মনে করা সম্পূর্ণ অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে নারীরাও মহান আল্লাহর সম্মানিত সৃষ্টি।
২. ঈমান-আমলে নারীর মর্যাদা : ইসলামের দৃষ্টিতে ঈমান-আমলে নারী-পুরুষের মর্যাদাগত কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য আছে বলে মনে করাও অজ্ঞতা। ইসলাম সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে যে, মর্যাদা-লাঞ্ছনা এবং মহত্ত¡-নীচতার মাপকাঠি হচ্ছে- তাকওয়া তথা পরহেজগারি এবং চরিত্র ও নৈতিকতা। তাকওয়া ও চরিত্রের মাপকাঠিতে যে যতটা খাঁটি প্রমাণিত হবে আল্লাহর কাছে সে ততটাই সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমানদার পুরুষ হোক কিংবা নারী হোক; আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরস্কার দেব; যা তারা করত।’ (সুরা নাহল, আয়াত ৯৭)। এ প্রসঙ্গে আরও ইরশাদ হয়েছেÑ ‘অতঃপর তাদের পালনকর্তা তাদের দোয়া (এই বলে) কবুল করে নিলেন যে, আমি তোমাদের কোনো পরিশ্রমকারীর পরিশ্রমই বিনষ্ট করি না, তা সে পুরুষ হোক কিংবা স্ত্রীলোক। তোমরা পরস্পর এক।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৯৫)।
৩. সমাজ বিনির্মাণে নারী : জীবনের সকল কর্মতৎপরতা ও উত্থান-পতনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সব সময় একে অপরকে সহযোগিতা করে থাকে। আল্লাহ তায়ালা এক্ষেত্রেও উভয়কে সমমর্যাদা দান করেছেন। তাদের পারস্পরিক বন্ধনে জীবনের কঠিন কাজগুলো সহজ হয়ে যায়। উভয়ের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সভ্যতা ও তমদ্দুনের ক্রমবিকাশ ঘটেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভালো কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই প্রতি আল্লাহ তায়ালা দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশীল, সুকৌশলী।’ (সুরা তাওবা, আয়াত ৭১)।
৪. নারীকে দোষারোপ থেকে মুক্তি : সমগ্র পৃথিবী যখন নারীকে একটি অকল্যাণকর তথা সভ্যতার অপ্রয়োজনীয় উপাদান মনে করত তখন ইসলাম নারীকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা। যেসব দোষ নারীকে দেওয়া হতো আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে আয়াত নাজিল করে নারীকে সেসব দোষ অপনোদন থেমে মুক্তি দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছেÑ ‘নভোমÐল ও ভূমÐলের রাজত্ব আল্লাহ তায়ালারই। তিনি যা ইচ্ছা, সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা-সন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল।’ (সুরা শুরা, আয়াত ৪৯-৫০)। এ কারণে হজরত ওমর রা. আনহু বলেন, ‘নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে আমরা আমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে এবং প্রাণ খুলে মেলামেশা করতেও ভয় পেতাম এ ভেবে যে, আমাদের সম্পর্কে কোনো আয়াত যেন নাজিল না হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর আমরা প্রাণ খুলে তাদের সঙ্গে মিশতে শুরু করলাম।’ (সহিহ বুখারি)।
৫. কন্যা সন্তান হত্যা রোধে পুরস্কারের ঘোষণা : জাহেলি যুগে নারীর বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত ছিল না। ইসলামের ঘোষণা এলো এভাবে যে, না! তারাও জীবিত থাকবে এবং যে ব্যক্তিই তার অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে মহান আল্লাহর কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন জীবন্ত প্রোথিত কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবেÑ কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হলো?’ (সুরা তাকভির, আয়াত ৮-৯)। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কন্যাসন্তানদের হত্যা প্রতিরোধে বিশেষ ঘোষণা দেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তির কন্যাসন্তান আছে, আর যে তাকে জীবন্ত কবর দেয়নি কিংবা তার সঙ্গে লাঞ্ছনাকর আচরণ করেনি এবং পুত্র সন্তানকে তার উপর অগ্রাধিকার দেয়নি; আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ (সুনানু আবি দাউদ)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তিনটি কন্যাসন্তান লালনপালন করেছে, তাদেরকে উত্তম আচরণ শিখিয়েছে, বিয়ে দিয়েছে এবং তাদের সঙ্গে সদয় আচরণ করেছে সে জান্নাত লাভ করবে।’ (সুনানু আবি দাউদ)
৫. নারীর প্রতি সদয় আচরণের নির্দেশ : আল্লাহ তায়ালা নারীর প্রতি কোমল ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘নারীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন কর।’ (সুরা নিসা, আয়াত ১৯)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীদের কাচের সঙ্গে তুলনা করে তাদের প্রতি সদয় হওয়ার তাগিদ দিয়ে বলেন, ‘কাচগুলোকে (স্ত্রীদেরকে) একটু দেখেশুনে যতেœর সঙ্গে নিয়ে যাও।’ (সহিহ মুসলিম)।
আধুনিক সমাজেও নারীরা নির্যাতিত : আধুনিক সমাজব্যবস্থার নামে নারীকে অগ্রসর ভাবা হলেও নারীরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। আধুনিক সমাজব্যবস্থায় নারীরা অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং বহু ক্ষেত্রে তারা নির্যাতিত। যেসব ক্ষেত্রে আধুনিক সমাজব্যবস্থা নারীর পাশে দাঁড়াতে পারেনি। এসব কারণে নারীরাÑ ১. নিরাপদে ঘরতে বের হতে পারে না। ২. তারা পাচারের শিকার হয়। ৩. তাদের জোরপূর্বক বেশ্যাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়। ৪. তারা অহরহ যৌন হয়রানির শিকার হয়। ৫. গর্ভবতী নারীও স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর ও ননদদের নির্যাতন থেকে মুক্তি পায় না। ৬. অনেক নারীকে যৌতুকের বলি হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়। ৭. তারা স্বামী ও পিতার সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। ৮. অধিকাংশ নারীই পায় না মোহরানার অধিকার। ৯. শিশুকন্যাদের ঝুঁকিপূর্ণ গৃহপরিচারিকার কাজে বাধ্য করা হয়। ১০. নারীদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না। ১১. আধুনিক সভ্যতায় উচ্চ মর্যাদার নারীদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ১২. এমনকি ধর্মীয় অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয় নারীকে। ১৩. নারীর প্রতি তালাকের অপব্যবহার হয় অহরহ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন