১০ ডিসেম্বর বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে মাঠের রাজনীতিতে সংঘাত-সংঘর্ষের ডামাডোলে রাজধানীবাসীর নিত্যযন্ত্রণা গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কট, পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডলার সঙ্কট, ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতিসহ অসংখ্য ইস্যু কর্পোটে চাপা পড়ে গেছে। সেই সঙ্গে চাপা পড়েছে, রাজধানী ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে মশার যন্ত্রণা। এডিস মশার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কিউলেক্স মশা। বড় আকৃতির এই মশার যন্ত্রণায় ঘরে থাকাই দায় হয়েছে। সন্ধ্যা হলেই এই মশার ভঁনভঁন শুরু হয়। রাতে শুধু বাসায় নয়, দিনেও অফিস-আদালত, মার্কেট, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশনসহ মানুষের উপস্থিতি স্থানে মশার উপদ্রব অস্বভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
গোটা রাজধানী যেন মশার দখলে চলে যায়। মশার যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে মানুষ কয়েল, মশা তাড়ানোর এক্সপ্রে, ইলেক্ট্রোনিক্স ব্যাট কিনে মশা থেকে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে। ফলে বাজারে মশা তাড়ানোর ওষুধ ও পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। আগে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে পাড়া-মহল্লায় মশার ওষুধ ছিঁটানো যে দৃশ্য দেখা যেত তা এখন চোখে পড়ছে না। ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১০ থেকে ১২টি মহল্লায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গত এক মাসে কোথাও সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধনের ওষুধ ছিঁটানো হয়নি। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এক সেমিনারে বলেছেন, আমি বারিধারায় থাকি। সেটা অভিজাত এলাকা। সেখানেও মশার যন্ত্রণায় থাকা যায় না। সন্ধ্যা হলেই ঝাঁকে ঝাঁকে মশা বাসাবাড়িতে হানা দেয়।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, এ বছর ফেব্রুয়ারিতে মশার ঘনত্ব বেড়েছে চার গুণ। বছরের ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত কিউলেক্স মশার প্রজনন মৌসুম। এ সময়ে একই চিত্র থাকে কিউলেক্স মশার উপদ্রবের। কিউলেক্স মশার প্রজননস্থলগুলো সঠিকভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে উপদ্রব কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য ডোবা-নালা বা জলাশয়গুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। সঠিক নিয়মে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, আরামবাগ, গোপীবাগ, সায়েদাবাদ, শনির আখড়া, ধোলাইপাড়সহ পুরান ঢাকার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে গত মাসের চেয়ে চলতি মাসে রাজধানীতে মশার উপদ্রব বেড়েছে। প্রতিটি পাড়া-মহল্লার মানুষ কিউলেক্স মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ ঢাকাবাসী। আগে এডিস মশা ছিল। এখন সে মশার কিছুটা কম দেখা গেলেও বড় আকৃতির কিউলেক্স মশা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কিউলেক্স মশার কারণে ফাইলেরিয়া ও ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। নভেম্বর থেকে শুরু করে মার্চ পর্যন্ত এর উৎপাত থাকে বেশি। দুই সিটি কর্পোরেশনে কিউলেক্স মশার উপদ্রব বেশি। এতে ভোগান্তিতে পড়ছে রাজধানীবাসী। তাদের অভিযোগ, গোটা নগরজুড়েই মশার উপদ্রব অসহনীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সূর্য ঢলে পড়তেই ঘরে-বাইরে মশার যন্ত্রণা শুরু হয়। আর মশক দমনে করপোরেশনের কার্যক্রম আগে ‘নামমাত্র’ দেখা গেলেও এখন দেখাই যায় না। কয়েক মাস আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে রাজধানী ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মশক ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোর নাম তুলে ধরা হয়। ওই জরিপ অনুযায়ী, দুই সিটির মোট ১১টি ওয়ার্ডকে মশক ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এরমধ্যে উত্তর সিটির ৫টি এবং দক্ষিণ সিটিতে ৬টি ওয়ার্ডে মশার উপদ্রব ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওই গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, ঢাকা উত্তর সিটির ১, ১২, ১৬, ২০ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ড মশকঝুঁকি বেশি। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫, ৬, ১১, ১৭, ৩৭ এবং ৪২ নম্বর ওয়ার্ড মশা অসহনীয় পর্যায়ে বেড়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির কয়েকটি এলাকা সরেজমিনে দেখা গেছে, খাল ও নর্দমা ছাড়াও বস্তি, রাস্তার পাশের ময়লার ভাগাড়, বাসস্ট্যান্টের বিভিন্ন খোসা, ঝোপঝাঁড়, টায়ারের দোকান, দীর্ঘদিন ধরে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা মোটর যান মশা জন্মানোর উপযুক্ত স্থান। এছাড়া ঢালাই মেশিন, রাস্তার পাশে পরে থাকা পলিথিন, কর্কসীট, বিভিন্ন মার্কেটের পরিত্যাক্ত ছাদ, দুই বাড়ির মাঝের পেসেজে বৃষ্টির পানি ও ভবনের টাংকীর পানি জমে সেখানে মশা জন্মাচ্ছে। এ ছাড়াও ছাদকৃষি যারা করেন তাদের বাগানে ফুলের টবে পানি জমে মশার লার্ভা জন্মায়। নির্মাণাধীন ভবনে বেশি মশা দেখা যায়। নির্মাণাধীন ভবনে ঠিকাদার ও বাড়ি মালিকদের অসচেতনায় সেখানে জন্ম নিচ্ছে এডিস ও কিউলেক্স উভয় ধরনের মশা। এসব মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশন কোনো কার্যকারী পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অ.দা.) ডা. ফজলে শামসুল কবির ইনকিলাবকে বলেন, এখন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনেকটা কমে এসেছে। বর্তমান সময়ে কিউলেস মশার মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। কিউলেস ও এডিস মশা নিধনের জন্য আমরা খাল, বিল, নালা-নর্দমা পরিষ্কার রাখছি। ইতোমধ্যেই আদি বুড়িগঙ্গাও পরিষ্কারের কার্যক্রম চলছে। মশা নিধনে লার্বি সাইট প্রয়োগ করছি। আমরা অব্যাহত মশা নিয়ন্ত্রণে কর্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীর চর, লালবাগ, হাজারীবাগ, পোস্তগোলা, ডেমরা, শ্যামপুর, দনিয়া, পল্টনসহ অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা, মোহাম্মদপুরের বাসিন্দারাও মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ। দুই সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে যোগ হওয়া নতুন ওয়ার্ডগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। মশার প্রজনন স্থান খাল ও নর্দমা পরিষ্কার করা বা সেখানে ওষুধ প্রয়োগ নাগরিকদের পক্ষে সম্ভব নয়। ওয়ার্ডভিত্তিক মশক নিধন শ্রমিকদের দিয়ে যেভাবে ডেঙ্গু ভাইরাসবাহিত এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ হয়েছে, এখন তেমন কোনো তৎপরতা নেই। এ কারণে কিউলেক্স মশার প্রজনন বেড়ে যাওয়া দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার ব্যর্থতা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ দরকার সেসব ক্ষেত্রে দুই সিটি কর্পোরেশনের দুর্বলতা রয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদন করা গেলে মশার উপদ্রব এত বৃদ্ধি পেত না।
জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগে. জেনা. মো. জোবায়দুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, আমরা ৫৪টি ওয়ার্ডে একযুগে এই মশক নিধন অভিযান পরিচালনা করছি। এখন এডিস মশার পাশাপাশি কিউলেস মশা বেড়ে গেছে যার জন্য আমরা মূল ফোকাস দিয়েছি কিউলেস মশার বিরুদ্ধে। যতগুলো নালা নর্দমা আছে সবগুলো পরিষ্কার করছি। গাপ্পি মাছ ছাড়া হয়েছে, কালো তেল দেয়া হয়েছে এটা খুব কার্যকর। কচুরিপানা পরিষ্কার করার পর এসব স্থানে লার্বি সাইট প্রয়োগ করছি। প্রত্যেকটি বাড়িতে পানির মধ্যে ট্যাবলেট প্রয়োগ করছি। যতগুলো মশার হটস্পট আছে সেগুলোকে নির্দিষ্ট করে মূলত আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রত্যেকটি অঞ্চলে আমরা আলাদাভাবে জনপ্রতিনিধিদের সাথে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। মশক নিয়ন্ত্রক সুপারভাইজারদের সাথে নিয়ে মিটিং করেছি। এ বিষয়টি নিয়ে মেয়রের সাথেও মিটিং হয়েছে। তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন কীভাবে কাজটি করতে হবে। আমরা রাজধানীর বড় বড় প্রতিষ্ঠানের লোকজনের সাথেও মিটিং করব। ইমাম, বাড়ির মালিক, শিক্ষক ও বিশিষ্টজনদের নিয়ে মিটিং করব। এছাড়াও জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমরা মাইকিং করা অব্যাহত রেখেছি।
জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) আয়তন ১০৯ দশমিক ২৫১ বর্গকিলোমিটার। সাধারণ ওয়ার্ড ৭৫টি। কিন্তু এসব ওয়ার্ডের আয়তন অনুযায়ী জনবল, মশার ওষুধ, ফগার মেশিনের সঙ্কট আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) এলাকার আয়তন ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ৫৪টি সাধারণ ওয়ার্ড। প্রতিটি ওয়ার্ডে গড়ে ১২ জন কর্মী সকাল-বিকাল দুই শিফটে মশা মারার ওষুধ ছিটান। কিন্তু ওয়ার্ডের আয়তন অনুযায়ী লোকবল অনেক কম। তবে সম্প্রতি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নগরে মশক নিধনে চলমান নানা কর্মসূচির কথা গণমাধ্যমে জানিয়েছেন। তাদের দাবি করেছেন, আগের বছরের তুলনায় এবার যথাযথভাবে মশক নিধন কার্যক্রম চলছে। জানা যায়, ঢাকা শহরের সর্বত্রই এখন কিউলেক্স মশার মাত্রাতিরিক্ত উপদ্রব।
কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দুই সিটি কর্পোরেশনের। এটা নগরবাসীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কিউলেক্স মশার প্রজননস্থল ডোবা-নালায় জমে থাকা পানি। দুই সিটি করপোরেশন মশা নিধনে তাদের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করলে কিউলেক্সের উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ডোবা, নালা বা জলাশয়ের পানি পচে গেলে সেখানে মশার প্রজনন ঘটে। শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার ডোবা-নালাগুলোর পানি পচে যায়। আর এসব স্থানে কচুরিপানা থাকলে তা কিউলেক্স মশার প্রজননে আরও সহায়ক হয়।
রমরমা ব্যবসা : মশার কয়েল, এ্যারোসল ও সব ধরনের স্প্রে থেকে শুরু করে মশা তাড়ানোর ইলেকট্রিক ব্যাট পর্যন্ত সবধরনের পণ্যের এখন রমরমা ব্যবসা চলছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। মশার উৎপাতে ঢাকাবাসীর যেমন ত্রাহি অবস্থা, পাশাপাশি বাজারে থাকা মশা মারার উপকরণের রমরমা। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীর মুখ উজ্জ্বল। সবার একটাই কথা : আগের থেকে ব্যবসা ভালো। কয়েকজন ব্যবহারকারী জানালেন, মশার ওষুধে এবং কয়েলে কোনো কাজ হচ্ছে না। স্প্রে করার কয়েক মিনিট পর ফের মশা ভনভন করে। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ শনির আখড়ার অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘মশার কয়েল সারা ঘরে জ্বালালেও মশা যেতে চায় না। ইন্ডিয়ান গুডনাইট অন করে রাখলে মশা গুডনাইটকে ঘিরে ঘুরতে থাকে। কয়েল জ্বালালে কয়েলের উপর দিয়ে ঘোরে। আবার ঘরে কয়েল জ্বালালে ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট হয়। এ কারণে মশা মারার ইলেকট্রিক ব্যাট ক্রয় করে ব্যবহার করছি।
গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটের কয়েকটি দোকানোর পাইকারি ইলেকট্রিক ব্যাট বিক্রেতারা জানান, আগে ব্যাট বিক্রি হতো সর্বনিম্ন ২২৫ থেকে ২৩০ টাকায় এবং সর্বোচ্চ ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকায়। এখন সর্বনিম্ন ২৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩৫০ টাকায় ব্যাট বিক্রি করা হচ্ছে। মশার বৃদ্ধির কারণে পণ্যের সরবরাহে টান পড়ায় প্রতি ব্যাটে দাম ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, এখন তারা প্রতিদিন ২ থেকে ৩ হাজার ব্যাট বিক্রি করছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন