শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

চিকিৎসা বর্জ্যে মরণব্যাধির ঝুঁকি

‘মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা’ বিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদন

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১৩ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০১ এএম

সংশোধনের অপেক্ষায় ১৫ হাসপাতালে হচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের কাজ
দেশে চিকিৎসা বর্জ্যরে ৯৩ ভাগই সঠিক ব্যবস্থাপনার বাইরে। ৮৩ দশমিক ৭ ভাগ ভুক্তভোগীর মতে, অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসা বর্জ্যরে সঠিক অপসারণ সম্পর্কে সচেতন নন এবং প্রায় ৮৮ দশমিক ৪ ভাগ মানুষ মনে করেন, বাসাবাড়ির বর্জ্যরে সঙ্গে চিকিৎসা বর্জ্য মেশানো উচিত নয়। এসব বর্জ্যরে জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি দরকার বলে মনে করেন ৯২ দশমিক ৪ ভাগ মানুষ। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের ‘মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা’ বিষয়ক এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের বেশিরভাগ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মেডিক্যাল বর্জ্য পরিশোধনের যেমন ব্যবস্থা নেই, তেমনি এসব বর্জ্য পরিশোধনের জন্যও নেই আধুনিক প্রযুক্তি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পরিবেশ অধিদফতরের নির্দেশনা থাকলেও প্রতিষ্ঠানগুলোয় সেগুলো মানা হচ্ছে না। বিভিন্ন হাসপাতালের মোট ৯২ শতাংশ বর্জ্য রাজধানীর চারপাশের নদীসহ হাসপাতালগুলোর সামনের খোলা ডাস্টবিন কিংবা নর্দমায় ফেলা হয়। এসব বর্জ্যরে ভেতর রয়েছে, সিরিঞ্জ, সূচ, রক্ত, পুঁজযুক্ত তুলা, টিউমার, ব্যান্ডেজ-গজ, হ্যান্ডগ্লাভস, ওষুধ ও ওষুধের বোতল-শিশি, ব্লাড ব্যাগ, স্যালাইন ব্যাগসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে হাসপাতাল বর্জ্য পরিশোধনের সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, যক্ষ্মা, চর্মরোগ, ডিপথেরিয়া, এমনকি এইডসের মতো মরণব্যাধির ঝুঁকি বাড়ছে। এসব রোগব্যাধি এড়াতে তাই দ্রুত হাসপাতালের বর্জ্য সঠিকভাবে অপসারণ জরুরী হয়ে পড়ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ডা. রশীদ ই-মাহবুব বলেছেন, বাংলাদেশে সঠিক উপায়ে বর্জ্য পরিচালনা না করায় তা একটি বড় পরিবেশগত হুমকি তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এবং পুনরায় উদ্ভূত সংক্রমণের একটি সম্ভাব্য উৎস হতে পারে।
ব্র্যাকের ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে, সারা দেশের হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন মোট ২৪৮ টন চিকিৎসা বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩৫ টন (১৪ দশমিক ১ শতাংশ) বর্জ্য যথাযথ ব্যবস্থাপনার অধীনে রয়েছে এবং এই ব্যবস্থাপনা রাজধানী ঢাকার মধ্যেই সীমিত। এই বর্জ্য শোধন একটি একক বেসরকারি সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়। যদিও দেশের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং হাসপাতালে বর্জ্য পৃথকীকরণের সুবিধা পাওয়া যায়, তবে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো চিকিৎসা বর্জ্য নিষ্কাশন বা চিকিৎসার সুবিধা নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে ব্র্যাক’র গবেষণায়।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এতোদিন রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাঠামো না থাকায় বেসরকারি সংস্থা প্রিজম বাংলাদেশ সংক্রামক বর্জ্য সংগ্রহ করে বিনষ্ট করে। আর অসংক্রামক বর্জ্য অপসারণ করে দুই সিটি করপোরেশন। যদিও ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সামনে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা বর্জ্য যথাযথভাবে শোধন ও নিষ্পত্তির জন্য বিভিন্ন রঙের কন্টেইনার রাখা হলেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও দক্ষ জনবলের অভাবে হাসপাতালটি সুষ্ঠুভাবে বর্জ ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না। এমনকি, বর্জ্য সংরক্ষণের কনটেইনার ঢাকনা আটকে রাখার কথা থাকলেও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের অধিকাংশ কনটেইনারই খোলা থাকে। সংক্রামক বর্জ্যরে খোলা কনটেইনারে সাধারণ বর্জ্য আবার সাধারণ বর্জ্যরে কনটেইনারে মাস্ক, সিরিঞ্জ, ওষুধের বোতলসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যও ফেলা হয়। সাধারণত হলুদ কনটেইনারে ক্ষতিকারক, লাল কনটেইনারে ধারালো, নীল কনটেইনারে তরল, সিলভার কনটেইনারে তেজস্ক্রিয়, সবুজ কনটেইনারে পুনঃব্যবহারযোগ্য সাধারণ বর্জ্য এবং কালো কনটেইনারে সাধারণ বর্জ্য রাখার নির্দেশনা থাকলেও একটির বর্জ্য ফেলা হচ্ছে অন্যটিতে। মানা হচ্ছে না কনটেইনারে বর্জ্যরে নাম ও সাংকেতিক চিহ্ন রাখার নির্দেশনাও। অবশ্য শুধু শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালই নয়, ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা বর্জ্যরে যথাযথ ব্যবস্থাপনা ছাড়াই চলছে দেশের প্রায় সব হাসপাতাল। মেডিকেল বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ছে।
যদিও এ সমস্যা সমাধানে ২১৪ কোটি ৪৭ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ব্যয়ে দেশের ১৫টি সরকারি হাসপাতালে হাসপাতাল ভিত্তিক চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে সরকার। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সাপ্তাহিক বৈঠকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। অনুমোদনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যন্ত্রপাতি ক্রয়ের পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য জনবল প্রস্তুত করতে বলেন। তিনি বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে চিকিৎসা বর্জ্য যথাযথভাবে নিষ্কাশনে বাধ্য করতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। ১৫ সরকারি হাসপাতালে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেম প্রতিষ্ঠা শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকার শেরেবাংলা নগর এলাকার সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ এবং মুন্সীগঞ্জ, বান্দরবান, লক্ষ্মীপুর, ঝিনাইদহ, বাগেরহাট, লালমনিরহাট, জয়পুরহাট, পঞ্চগড়, পিরোজপুর ও শেরপুরের ১০টি সরকারি হাসপাতাল থেকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো তৈরি করা হবে। প্রকল্প শেষে স্থাপিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রে আধুনিক চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনবল সৃষ্টি করা হবে। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে প্রকল্প হোতে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে প্রকল্পের স্বাভাবিক কাজে ইতোমধ্যে বিপত্তি দেখা দিয়েছে। কারণ সরকারি হাসপাতাল থেকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো তৈরি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পাশ হয়েছে ২০১৮ সালের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পাবলিক ওয়াকস ডিপার্টমেন্ট (পিডাব্লিউডি) রেট শিডিউল অনুযায়ী। বর্তমানে চলছে পিডাব্লিউডি ২০২২ রেট শিডিউল অনুযায়ী। পাশাপাশি বৈশ্বিক মহামারি করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে প্রকল্প খরচ আগের থেকে অনেকটা বেড়েছে। এছাড়া প্রকল্প পাশের সময়ে ডলারের রেট ছিল ৮৫ দশমিক ৬০ টাকা। যা বর্তমানে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা। তাই যন্ত্রপাতি রেট সমন্বয় করে সংশোধিত প্রকল্প একনেকে পাশা হলেই পুরোদমে কার্যক্রম শুরু হবে। যদিও ইতোমধ্যে সরকারি জনবল ও অফিস পাওয়ায় অন্যান্য কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এখন বাকী অন্যান্য জনবল আউটসোসিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগের প্রচেষ্টা চলছে।
সূত্র মতে, প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হচ্ছে, ৪৫টি চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ক্রয়, ১৫টি ক্যাটাগরি এ, বি, ও সি’ভুক্ত অনাবাসিক ভবন, সরবরাহ সেবা, ২টি যানবাহন ভাড়া, ৫টি আউটসোর্সিং সেবা, ৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন ভাতা, ৪৭টি আসবাবপত্র ক্রয়, ১২টি কম্পিউটার এবং আনুষঙ্গিক ক্রয়, মেরামত, সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন করা।
সার্বিক বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো নির্মাণ করার কাজ চলমান। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর কোনো বিরূপ প্রভাব ছাড়াই বিভিন্ন চিকিৎসা বর্জ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও অপসারণের সক্ষমতা তৈরি হবে এবং সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন ও সংক্রমণমুক্ত পরিবেশে চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব হবে। তিনি বলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে এখন যে সঙ্কট আছে তা কাটবে। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমবে।#

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন