ইউরোপে শীতকালের শুরু এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অব্যাহত থাকার সাথে সাথে ইইউ সদস্য দেশগুলিকে আরও অনেক নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। কোভিড-১৯ বিধিনিষেধ সহজতর হয়ে ওঠায় এবং অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায়, ইউরোপ ২০১৫-১৬ সালে অভিবাসন সঙ্কটের পর থেকে উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়া থেকে নতুন আগত অভিবাসীদের সর্বোচ্চ আগমন অবলোকন করছে। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছে এবং এর রাজনৈতিক ঐক্যকে পরীক্ষার মুখে ফেলেছে। ইউরোপিয়ান পলিসি সেন্টারের অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আলবার্তো-হর্স্ট নিডহার্ট বলেছেন, ‘ইউরোপের চারপাশে এখন অভিবাসনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বক্তৃতা বাড়ছে, যা অনেক সদস্য রাষ্ট্রের সমন্বিত সমাধান নিয়ে আসার ক্ষেত্রে অসুবিধাগুলিকে প্রতিফলিত করে।’
এবছর ইউক্রেন এবং বিশে^র অন্যান্য স্থান থেকে ইউরোপে আসা শরণার্থীদের সংখ্যা লক্ষণীয়। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অস্থায়ী সুরক্ষার জন্য ৪৪ লাখ ইউক্রেনীয় আবেদন করেছিল। এর উপর, ইইউ দেশগুলির পাশাপাশি নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, আইসল্যান্ড এবং লিসটেনস্টেইনও সিরিয়া, আফগানিস্তান এবং আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু দেশের নাগরিকদের কাছ থেকে আশ্রয়ের জন্য ৬৮হাজার ৬শ’ ৪০টি আবেদন পেয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৪ শতাংশ বেশি। আবাসন এবং শরণার্থীদের সহায়তা করতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষগুলি এখন খাবি খাচ্ছে। জার্মানিতে যেখানে এই বছর ১১ লাখেরও বেশি মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করেছে, সেখানে শহরগুলি ২০১৫-১৬ সালের শরণার্থী সঙ্কটের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কায় জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন এবং জিম এবং হোস্টেলগুলিকে আবাসনে রূপান্তর করছে।
শরণার্থী ঢলে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় জার্মানির পৌরসভাগুলিকে ভ্রাম্যমাণ বাড়ি তৈরি করতে এবং নতুন আগতদের জন্য হোটেলে কক্ষ ভাড়া দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষগুলি বলছে যে, তারা স্কুল এবং কিন্ডারগার্টেনগুলিতে জায়গা দিতে পারছে না এবং প্রাপ্তবয়স্ক উদ্বাস্তুদের খাপ খাইয়ে নেয়ার কোর্সগুলি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ব্রাসেলসের রাস্তায় হাজার হাজার শরণার্থী বসবাস করছে, কারণ কর্তৃপক্ষ আশ্রয় ব্যবস্থা প্রক্রিয়া করণের জন্য হিমশিম খাচ্ছে। নিডহার্ট বলেছেন, ‘আমরা ইইউর অনেক অংশে শরণার্থী অভ্যর্থনা ব্যবস্থায় জরুরি অবস্থা দেখছি। ইউক্রেন, সেইসাথে বিশ্বের অন্যান্য অংশ থেকে আরও আগমনের সম্ভাবনা কর্তৃপক্ষগুলির ওপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করতে পারে।’
পোল্যান্ডে, যেখানে ১৩ লাখেরও মিলিয়নেরও বেশি ইউক্রেনীয় বসবাসের জন্য নিবন্ধিত হয়েছে, প্রাথমিকভাবে স্বেচ্ছাসেবার আদর্শ হিসাবে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু কিয়েভের প্রতি ওয়ারশ-এর সমর্থন অটল থাকলেও, এই শীতে পোল্যান্ড পালিয়ে আসা ইউক্রেনীয়দের আগের মতো উদারভাবে স্বাগত জানাবে না। দেশটির কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই ইউক্রেনীয়দের দেওয়া অনেক প্রত্যক্ষ ভর্তুকি বন্ধ করে দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে গণপরিবহনগুলিকে বিনামূল্যে উপলব্ধ করা এবং ৩শ’ জ্লটি (৬৭ মার্কিন ডলার) এর এককালীন অর্থ প্রদান, যা ১০ লাখেরও বেশি নিবন্ধিত ইউক্রেনীদের দেয়া হয়েছে। সামেনের মার্চ থেকে পোল্যান্ডে ১শ’ ২০ দিনের বেশি সময় ধরে থাকা শরণার্থীদের সরকার প্রদত্ত আবাসন খরচের ৫০ শতাংশ পরিশোধ করতে হবে। ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস-এর ওয়ারশ অফিসের প্রধান পিওত্র বুরাস বলেছেন, ‹পোলরা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে শঙ্কিত এবং ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের প্রতি সুবিধাজনক আচরণের কারণে তারা আরও বেশি বিরক্ত হয়ে উঠছে।›
ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথাকথিত ডাবলিন চুক্তির অধীনে, আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদনগুলির সেই ইউরোপীয় দেশে পরীক্ষা এবং প্রক্রিয়া করা হবে, যেখানে তারা প্রথমে ঢুকেছে, যা ভূতাত্বিক কারণে ইতালি এবং অন্যান্য ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলির উপর বেশি চাপ সৃষ্টি করছে। ফলে, গত মাসে ইতালি, গ্রীস, সাইপ্রাস এবং মাল্টা নীতিটি পরিবর্তনের দাবিতে একটি যৌথ আবেদন নামায় স্বাক্ষর করেছে। বর্তমানে, ইইউ অভিবাসন নিয়ে গভীরভাবে বিভক্ত, যেমনটি সম্প্রতি ব্রাসেলসে একটি মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে দেখা গেছে, যখন অস্ট্রিয়া রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়া পর্যন্ত সীমান্ত-মুক্ত শেনজেন এলাকা সম্প্রসারণের প্রস্তাবে না-ভোট দিয়েছে। এতে রোমানিয়ায় একটি তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, সেখানে কিছু রাজনীতিবিদ অস্ট্রিয়ান সংস্থাগুলিকে বর্জন করার দাবি তুলেছে।
এদিকে, অভিবাসীদের সহায়তাকারী সুশীল সমাজ গোষ্ঠী ‘বাওবাব এক্সপেরিয়েন্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা আন্দ্রেয়া কস্তা বলেছেন যে তিনি ইউক্রেনীয় অভ্যর্থনার ক্ষেত্রে ইউরোপের উষ্ণ আলিঙ্গন এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত শরণার্থীদের ক্ষেত্রে তাদের বৈরি আচরণ দেখতে পান। এই দ্বিমুখি আচরণের প্রভাব মানবাধীকার কর্মীদের ওপর পড়ছে, যারা ভূমধ্যসাগরের ওপার থেকে আসা নতুন শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য মানব পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারে। কস্তা বলেন, ‹আমি এটা বলতে ভয় পাচ্ছি, কিন্তু আসলেই এর সাথে বর্ণবাদের অনেক সম্পর্ক আছে। এটা আমাকে খুব বিরক্ত করে। যদি আমার ভ্যান থাকে এবং এটি ইউক্রেন থেকে আসা স্বর্ণকেশী, নীল-চোখের বাচ্চাতে ভর্তি থাকে, তাহলে আমার কোন সমস্যা নেই। যদি আমার তাইগ্রে, সুদান বা সোমালিয়ায় যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা আটটি কৃষ্ণাঙ্গ অপ্রাপ্তবয়স্ক নাবালক থাকে, তাহলেই আমি সমস্যায় পড়ি, কারণ আমি এটা অবৈধ কাজ করছি।’
পোল্যান্ড এবং মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশেও দ্বিমুখি বৈষম্য মূলক নীতি রয়েছে। তারা যেসব ইউক্রেনীয়রা রাশিয়ার যুদ্ধ থেকে পালাতে পেরেছে তাদের নিরাপদ আশ্রয় দিতে এবং বাকি আশ্রয়প্রার্থীদের রুখতে নতুন সীমান্ত অবরোধ বসিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলি বলছে যে, এই প্রচেষ্টা মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য জায়গা থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের প্রতি আরোপ করা হচ্ছে। অভিবাসীদের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক ফিলিপ গনজালেজ মোরালেস জুলাতে পোল্যান্ড সফরের পর, যেখানে তিনি ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের স্বাগত জানানোর প্রশংসা করেছিলেন কিন্তু বাকিদের প্রতি দেশটির আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, বলেন, ‘আমি উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, এই দ্বিমুখি পদ্ধতির ফলে বৈষম্যের শিকার হওয়ার অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন