কালের আবর্তে ও যান্ত্রিক সভ্যতার গ্রাসে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য। বদলে যাচ্ছে মানুষের রুচিবোধ। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জনপদ জকিগঞ্জসহ ভারতের বরাক উপত্যকার প্রিয় ও প্রাচীর একটি মুখরোচক খাবার চুঙ্গাপোড়া বা চুঙ্গাপীঠা। চুঙ্গাপিঠা তৈরির প্রধান উপকরণ ঢলু বাঁশ ও বিন্নি ধানের চাল (বিরইন ধানের চাল)। তবে আগের মতো এখন আর গ্রামীণ এলাকার বাড়িতে বাড়িতে চুঙ্গাপোড়ার আয়োজন চোখে পড়ে না। শীতের রাতে খড়কুটো জ্বালিয়ে সারারাত চুঙ্গাপোড়ার দৃশ্যও এখন আর খুব দেখা যায় না।
একসময় মানুষজন জকিগঞ্জের বাজারগুলো থেকে মাছ কিনে কিংবা হাওর-নদীর হতে বড় বড় রুই, কাতলা, চিতল, বোয়াল,পাবদা, কৈ, মাগুর, মাছ ধরে নিয়ে এসে হাল্কা মসলা দিয়ে ভেজে (আঞ্চলিক ভাষায় মাছ বিরান) দিয়ে চুঙ্গাপোড়া পিঠা খাওয়া ছিলো জকিগঞ্জ এলাকার অন্যতম ঐতিহ্য। বাড়িতে মেহমান বা নতুন জামাইকে শেষ পাতে চুঙ্গাপোড়া পিঠা মাছ বিরান আর নারিকেলের পিঠা পরিবেশন না করলে যেনো লজ্জায় মাথা কাটা যেতো।
বর্তমানে সেই দিন আর নেই। বিরইন ধানের চাল জকিগঞ্জে এখনো পাওয়া গেলেও ঢলু বাঁশের সরবরাহ অনেক কমে গেছে। এই বাঁশগুলো আসতো সাধারণত নদীর ওপার ভারতের করিমগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের পাহাড়ী এলাকা থেকে। অনেক আগেই বনদস্যু ও ভ‚মিদস্যু এবং পাহাড় খেকোদের কারণে বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাওয়ায় হারিয়ে গেছে ঢলুবাঁশ। কিছু কিছু টিলায় এখন ও ঢলুবাঁশ পাওয়া যায়। পাহাড়ে বাঁশ নাই বলে বাজারে এই ঢলুবাঁশের দামও এখন তাই বেশ চড়া। ব্যবসায়ীরা দূরবর্তী এলাকা থেকে এই ঢলুবাঁশ ক্রয় করে নিয়ে আসার কারণে জকিগঞ্জের বাজারগুলোতে এর চড়া দাম।
এই বাঁশটিও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। ঢলুবাঁশ ছাড়া চুঙ্গাপিঠা তৈরি করা যায় না। কারণ ঢলুবাঁশে এক ধরনের তৈলাক্ত রাসায়নিক পদার্থ আছে, যা আগুনে বাঁশের চুঙ্গাকে না পোড়াতে সাহায্য করে। ঢলুবাঁশে অত্যধিক রস থাকায় আগুনে না পুড়ে ভিতরের পিঠা আগুনের তাপে সিদ্ধ হয়। ঢলুবাঁশের চুঙ্গা দিয়ে ভিন্ন স্বাদের পিঠা তৈরি হয়। কোনো কোনো জায়গায় চুঙ্গার ভেতরে বিন্নি চাল, দুধ, চিনি, নারিকেল ও চালের গুড়া দিয়ে পিঠা তৈরি করা হয়। পিঠা তৈরি হয়ে গেলে মোমবাতির মতো চুঙ্গা থেকে পিঠা আলাদা হয়ে যায়। চুঙ্গাপিঠা পোড়াতে আবার প্রচুর পরিমানে খড় দরকার পড়ে। আগের মত চাষাবাদ কমে যাওয়ায় খড়ও যেন অপ্রতুল।
তবে আশার কথা হল, জকিগঞ্জের কিছু ঐতিহ্যসচেতন মানুষ কষ্ট করেও এই মুখরোচক ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রচলন ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। গত মৌসুমে জকিগঞ্জ ডাক বাংলো প্রাঙ্গনে জকিগঞ্জ সদর ইউপি চেয়ারম্যান আফতাব আহমদ ও সমাজসেবী এমএজি বাবরের তত্বাবধানে ঘটা করে চুঙ্গাপেড়াার আয়োজন করা হয়। এ বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর একই স্থানে চুঙ্গাপুড়া উৎসব হবে বলে ইনকিলাবকে জানান এমএজি বাবর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন