জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসময়ে বন্য, দীর্ঘ খরা, ঝড়-টর্নেডো এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে প্রতি বছর কৃষিখাতে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বদলে গেছে দেশের আবহাওয়ার গতি প্রকৃতি। ঋতুচক্রের বৈশিষ্টও এখন আর স্বাভাবিক নয়। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই পরিবর্তিত আবহাওয়ায় অর্থাৎ চরম আবহাওয়ায় চাষাবাদ করে কৃষক অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর এতে দেশের ফসলের উৎপাদন অন্তত ১০ শতাংশ কম হচ্ছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি। যা ভয়ানক। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ যদি প্যারিস চুক্তি মেনে নিতে না পারে তাহলে আরো ৭ শতাংশ নিরাপত্তাহীনতা বাড়বে।
আবহাওয়া অধিদফতর এক পরিসংখ্যানে জানিয়েছে, গত ৪ বছরে মার্চ-এপ্রিলে দেশের তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রায় ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা অর্থাৎ মরুর তাপমাত্রা বিরাজ করছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বাংলাদেশে বেশি। যার বড় প্রভাব পড়ছে দেশের কৃষিখাতে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটের ‘কাউন্ট-ডাউন-২০২২’ -এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাপমাত্রা বাড়ায় বাংলাদেশে কৃষিখাতে ১৫ হাজার ৯৭০ মিলিয়ন ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। দেশে বছরে প্রায় দুই মাস খরা যাচ্ছে। -এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাহত হচ্ছে খাদ্য উৎপাদন। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গত কয়েক বছরে ধানের ফলনের সম্ভাবনা কমেছে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ।
বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডক্টর আইনুন নিশাত ইনকিলাবকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের নানা খাতে চিন্তায় ফেলেছে। বিশেষ করে কৃষিখাতে -এর বিরূপ প্রভাবে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গত ৪ বছরের তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিবছরই ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়ছে। চলতি এপ্রিলে তাপমাত্রা আরো বাড়তে পারে বলে আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। যদি তাই হয় তাহলে বোরো উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। তাই এ বিষয়ে আগাম সতর্কতা অবলম্বন করলে সম্ভাব্য ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হবে।
গত বোরো মৌসুমে অসময়ে টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে তৃতীয় দফা বন্যার কবলে পড়ে সিলেটসহ দেশের হাওরাঞ্চল। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। গত এপ্রিলে সিলেটের নিম্নাঞ্চলে অসময়ে বন্যা দেখা দেয়। তা ধীরে ধীরে হাওরাঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করে। এরপর মে মাসের মাঝামাঝিতে সিলেটসহ হাওরাঞ্চলে বন্যা ভয়াবহ রূপ লাভ করে। যা গত ১৮ বছরের মধ্যে ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা।
অন্যদিকে গত জুলাই মাসে এত কম বৃষ্টি হয়েছে যে তা রেকর্ডই করা যায়নি। একদিকে বৃষ্টি কম হচ্ছে, অন্যদিকে তাপমাত্রাও বেশি থাকছে। গত ১৪ জুলাই রাজশাহীর তাপমাত্রা উঠেছিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তিন বছরের মধ্যে গত আষাঢ় মাসে রাজশাহীতে তথা বরেন্দ্র অঞ্চলে সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে। খরায় জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। পানির অভাবে পিছিয়ে গেছে আমন রোপণ। পাট জাগ দিতে পারেনি কৃষক। কোথাও কোথাও খরায় পুড়ে গেছে খেতের পাটগাছ ও গ্রীষ্মকালীন ভুট্টাখেত। এ দাবদাহ চলেছে দেশের উত্তরাঞ্চলজুড়ে। ধানের জন্য বিখ্যাত দিনাজপুরেও -এর প্রভাব পড়েছে। এতে ধানের উৎপাদন স্বাভাবিকের চেয়ে ১৫ শতাংশ কম হয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে।
উত্তরাঞ্চলকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করে কাজ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা নিয়ে রাজশাহী অঞ্চল। বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও জয়পুরহাট জেলা নিয়ে বগুড়া অঞ্চল। রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলা নিয়ে রংপুর অঞ্চল এবং দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলা নিয়ে দিনাজপুর অঞ্চল। প্রতিটি অঞ্চলেই অনাবৃষ্টি ও অতিরিক্ত খরার কারণে কম-বেশি একই ধরনের প্রভাব পড়েছে এবং কমপক্ষে ১৫ শতাংশ উৎপাদন কম হয়েছে।
পরিবেশ অর্থনীতিবিদ ড. সৌরো দাশগুপ্ত বলেন, ১৯৮৬ থেকে ২০০৫ এই সময়ের তুলনায় ২০২১ সালে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অথচ ২০০০ সালে এই বৃদ্ধির হার ছিল শূন্য দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ফসলের উৎপাদন স্বাভাবিকের চেয়ে কমপক্ষে ১০ ভাগ কম হচ্ছে।
ল্যানসেটের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮৬ থেকে ২০০৫ বেজলাইনের তুলনায় ২০২১ সালে এসে দৈনিক ১২ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি মারাত্মক তাপমাত্রার শিকার হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে ২০১২ থেকে ২০২১ সালে গড়ে প্রায় দুই মাস খরা হয়েছে, যা ১৯৫১ থেকে ১৯৬০ সালে গড়ে ৯ দিনের চেয়ে কিছুটা বেশি। তাপজনিত মৃত্যুর বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ সাল থেকে ২০০৪ এবং ২০১৭ থেকে ২০২১ এ সময়ে বাংলাদেশে ৬৫ বছর বয়সিদের মধ্যে তাপজনিত মৃত্যুর হার বেড়েছে ১৪৮ শতাংশ। এছাড়া তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বাংলাদেশের কৃষি খাত ১৫ হাজার ৯৭০ মিলিয়ন সম্ভাব্য ঘণ্টা হারিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে। এছাড়া নির্মাণশিল্পে তিন হাজার ৩০০ মিলিয়ন সম্ভাব্য ঘণ্টা ও উৎপাদনে দুই হাজার ৪০০ মিলিয়ন সম্ভাব্য ঘণ্টা হারিয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন