কৃষক মোজ্জামেল হক পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি মুলা বিক্রি করে পেয়েছেন ৫ টাকা। মাত্র ১০০ গজ দূরে খুচরা বিক্রেতারা সেই মুলার দাম চাইছেন কমপক্ষে ৩০ টাকা। সেই সবজি ঢাকায় গিয়ে হয়ে যাচ্ছে ৬০ টাকা। বৃহস্পতিবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ঘেষা কুমিল্লার নিমসার হাটে গিয়ে এমনই চিত্র দেখা গেল। উপজেলার হাটবাজারগুলোতে ভরা মৌসুমে চড়া দামে সবজি বিক্রি হলেও কৃষকদের তেমন লাভ থাকছে না। মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। হাত ঘুরলেই বাড়ছে সবজির দাম। এতে ঠকছেন সাধারণ ক্রেতা ও কৃষকেরা।
মুলা বিক্রি করে লাভ হচ্ছে না দাবি করে ছায়কোট গ্রামের কৃষক তোফায়েল বলেন, খুচরা বাজারে মুলা কিনবার গেইলে ৩০-৩৫ টাকার নিচে পাওয়া যাছে না। এই মুলা আবার হামার ছাওয়ারা (ছেলেমেয়েরা) যারা ঢাকাত থাকে, তারা ৫৫-৬০ টাকা কেজি দরে কিনি খাছে। বাজারে ফসলের দাম ঠিকই আছে। হামরা বেচপার গেইলে খালি দাম নাই। এত লোকসান হইলে কৃষক বাঁচপে কেমন করি।
হাটে কথা হয় কাবিলা গ্রামের কৃষক জামাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি দুই মণ বেগুন নিয়ে এসেছিলেন। পাইকারের কাছে ১২০ টাকা মণ দরে ২৪০ টাকায় বিক্রি করেছেন। জামাল আক্ষেপ করে বলেন, পাইকার আর দোকানি ধান্দা করে কেমন করি কৃষকোক ঠকা যায়, দুইটা টাকা কম দেওয়া যায়। ওমরা এটা বোঝে না যে হামরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোইদে পুড়ি পানিত ভিজি ফসল ফলাই।
একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিকারপুর গ্রামের কৃষক আওলাদ মিয়া। তিনি বলেন, হামার খালি খাটাখাটিই সার। যা লাভ পাইকারের আর দোকানির। আমরা কেজি প্রতি ৩ টাকা আর তারা হামার মতোন মানুষের কাছে বেচছে ১৫-২০ টাকায়। অথচ তাঁর বেগুনই হাত বদলেই শহরে বিক্রি হয় ৮০ টাকা কেজি দরে। চোখের সামনোত এমনতো করি ঠকুছি। তা-ও কিছু কবার পাওছি না।
কুমিল্লার চান্দিনা, বুড়িচং এই দুই উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সবজির ফলন হয়। কৃষকরা বেগুন, কাঁকরোল, শসা, ঝিঙা, লাউ, পুঁইশাক, মরিচ, ডাঁটাশাক, পেঁপে ও কচুর লতি নিয়ে আসেন কুমিল্লার সবচেয়ে বড় বাজার নিমসার পাইকারি হাটে। সেখান থেকে প্রতিদিন অর্ধশত ট্রাক শাকসবজি নিয়ে রাজধানীসহ নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট এবং অন্যান্য জেলায় যায়। কৃষি কর্মকর্তারা জানান, ওই সব জেলার শাকসবজির চাহিদার প্রায় ৪০ ভাগই পূরণ করেন কুমিল্লার কৃষকরা।
সরেজমিনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে অবস্থিত নিমসার সবজির হাটে গিয়ে দেখা যায়, পাইকারি ক্রেতারা সবজি কিনে ঝুড়িতে সাজাচ্ছেন। ঝুড়ি বোঝাই সবজি তোলা হচ্ছে ট্রাক অথবা পিকআপ ভ্যানে। হাটের কৃষকরা জানান, বর্তমান বাজারে প্রতিমণ বেগুন এক হাজার ৪০০ টাকা, কাঁকরোল ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা, শসা ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, পুঁইশাক ৪০০ টাকা, মরিচ এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার টাকা, পেঁপে ৫০০ টাকা, ঝিঙা ৯০০ টাকা, জলপাই ৮০০ টাকা এবং লাউ প্রতি পিছ ৫০ থেকে ৫৫ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে। চান্দিনার শ্রীমন্তপুর গ্রামের সবজি চাষি শাহাজাহান মিয়া দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, দালালরা কম টাকা দিয়ে প্রায় জোর করেই সবজি নিয়ে যায়। তারা কমিশন নিয়ে পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দেয় সেই সবজি। চাষিদের কাছ থেকে মরিচ কিনে বাজারেই পাইকারি বিক্রি করেন রমজান মিয়া। তিনি জানান, কৃষকের কাছ থেকে ১১০ টাকা কেজিতে মরিচ কিনে তিনি পাইকারদের কাছে ১৮০ টাকায় বিক্রি করেন। কুমিল্লার নিমসার হাট থেকে সবজি সংগ্রহ করে কারওয়ান বাজারের সরবরাহ করেন আবিদ আলী। তিনি বলেন, আমরা হাট থেকে কিনে আড়তে প্রতিমণ শসা এক হাজার ২০০ টাকা, পুঁইশাক ৬০০ টাকা, পেঁপে ৮০০ টাকা, ঝিঙা এক হাজার ২০০ টাকায় সরবরাহ করি।
কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ সুপারভাইজার শাহাজাহান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, কৃষকরা ন্যায্য দাম না পেলেও ভোক্তারা বেশি দাম দিয়েই সবজি কিনছেন। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কার্যকর উদ্যোগ নিলে এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হবে। অথচ সবজি উৎপাদনে রীতিমতো বিপ্লব ঘটালেও এর দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করায় এই এলাকায় সবজির ফলন ভালো হচ্ছে। কিন্তু রাজধানী বা কুমিল্লা শহরে খুচরা বাজারে যে দামে সবজি বিক্রি হচ্ছে, এর তিন ভাগের এক ভাগ দামে পাইকারি বাজারে তা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন স্থানীয় চাষিরা।
কুমিল্লা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, এ জেলায় বিভিন্ন জাতের সবজি প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হয়ে থাকে। মৌসুমি সবজির আমদানি বাড়লে পাইকারি ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে দাম কমিয়ে দেন। ফলে কৃষকরা কম দামে সবজি বিক্রি করতে বাধ্য হন। এতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষক।
নিমসার সবজির পাইকারি হাটে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা দরে। বড় প্রতিটি লাউয়ের পাইকারি দাম ৫০ থেতে ৫৫ টাকা। অন্যদিকে শহরের খুচরা বাজারগুলোতে ১৯০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে কাঁচা মরিচ এবং ৮০ থেকে ৯০ টাকায় একেকটি লাউ বিক্রি হচ্ছে। সবজি চাষি কামরুল হোসেন জানান, তিনি এ বছর ২৪ শতক জমিতে লাউয়ের আবাদ করেছেন। প্রথম দিকে প্রতিটি লাউ বিক্রি করেছেন ৩০ থেকে ৪০ টাকা করে। এখন বিক্রি করছেন ৫০ থেকে ৫৫ টাকা দরে। এ দামে লাউ বিক্রি করে কোনো রকমে আবাদের খরচ উঠেছে বলে জানান তিনি। কালাকচুয়া গ্রামের সবজি চাষি সাইফুল দৈনিক ইনকিলাবকে ৫০ কেজি পটল নিয়ে হাটে এসেছেন। তিনি ৫২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন তা। তিনি বলেন, জমি তৈরি, সার-কীটনাশক ও শ্রমের দাম বাদ দিয়ে আর কিছু থাকে না। এ দামে সবজি বিক্রি করে আমাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। পূর্ব পুরুষরা চাষ করে আসছে, তাই চাষ করি। সৈয়দপুর গ্রামের মনির ১ মণ কাঁচা মরিচ নিয়ে এসেছেন হাটে। ১১০ টাকা কেজি দরে মরিচ বিক্রি করেছেন। তিনি বলেন, আড়তদার, ফড়িয়া ও ব্যাপারিরা এখানকার হাট নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরা যে দাম নির্ধারণ করে দেন, সেই দামেই আমাদের মাল বিক্রি করতে হয়। কৃষি উপকরণের দামের তুলনায় সবজির দাম খুবই কম। কাঁচা সবজি গাছে থাকলে নষ্ট হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে তা বিক্রি করতে হয়।
যাত্রাবাড়ি সবজি ব্যবসায়ী সেন্টু মিয়া দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, চাষির কাছ থেকে যে দামে সবজি কেনা হয়, তার উপর খাজনা, লেবার খরচ, আড়তদারি ও পরিবহন খরচ দিয়ে ঢাকায় মাল পৌঁছাতে সবজির মূল্য দ্বিগুণেরও বেশি পড়ে যায়। এখানে একটি লাউ ৩০ টাকায় কিনলে, ঢাকার বাজারে আবার আড়তদারি দিয়ে তা ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি না করলে লাভ হয় না। কাঁচামালে সব সময় ঘাটতি থাকে জানিয়ে আরেক ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম বলেন, আমরা যেসব সবজি দোকানে আনি, তা এক দিনে বিক্রি হয় না। প্রতিদিনই এসব সবজিতে ঘাটতি হয়। অনেক সময় পচে নষ্ট হয়ে যায়। তাই কেনা দামের থেকে দুই টাকা বাড়িয়ে বিক্রি না করলে লোকসান হয়। সবজির পাইকার ক্রেতা আবু সাদেক বলেন, সবজি দ্রুত পচনশীল। একই সঙ্গে পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে। পাইকারি বাজার থেকে সবজি নিয়ে আড়ৎ পর্যন্ত পৌছাতে আমাদের অনেক বেশি খরচ হচ্ছে। ফলে পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারের দামের ব্যাপক তারতম্য হচ্ছে।
তবে এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আসাদুজ্জামান বলেন, বাজারে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কাজ করা হচ্ছে। প্রতিদিন বিভিন্ন অঞ্চলে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বাজার তদারকি করছেন। সবজির বাজারেও বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে মূল্য ঠিক করা হবে।###
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন