পৌষ মাস। কৃষকের ধান কাটা শেষ হয়েছে। এ সময় মানুষ পিঠেপুলি খেয়ে থাকেন। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট এবং পণ্যমূল্য নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় মানুষ আর আগের মতো পৌষ পার্বণ করতে পারেন না। তারপরও মানুষ শীত মৌসুমে পিঠা-পায়েস তৈরি করে খায়। পিঠায় খেজুর গুড় বেশি ব্যবহৃত হওয়ায় এ সময় খেজুরের গুড়ের বিশেষ চাহিদা থাকে। খেজুরের রস থেকে তৈরি এ গুড়ের মূল ঠিকানা গ্রামাঞ্চল। যশোর, নাটোর, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, কুষ্টিয়াসহ কয়েকটি জেলায় খেজুর গুড় বেশি হয়ে থাকে। তবে সব জেলায় কমবেশি খেজুর গুড় তৈরি হয়। পৌষ মাসের দ্বিতীয় সাপ্তাহে গ্রামের হাটবাজারে খেজুরের গুড় যে দামে বিক্রি হচ্ছে, রাজধানী ঢাকার সুপারশপসহ বিভিন্ন বিপণিকেন্দ্রে তা হয়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ দামে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ি, নিউ মার্কেট, ফকিরাপুল মার্কেট, কাপ্তানবাজার, কারওয়ান বাজারসহ কয়েকটি বাজারের সুপারশপ ঘুরে দেখা গেছে খেজরের গুড় ২০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, নাটোর, বগুড়া, রংপুর, যশোরের স্থানীয় বাজারে গুড় বিক্রি হচ্ছে অনেক কম দামে। রাজশাহীর বানেশ্বর বাজারে খেজুরের গুড় বিক্রি হচ্ছ ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে। নাটোরের বিভিন্ন এলাকায় এই গুড় ১১০ থেকে ১২০ টাকা। রংপুরের বাজারে ১১০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা দরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা পর্যায়ে গ্রামের চাষিরা সরাসরি গাছ থেকে রস আহরণ করে গুড় বানিয়ে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। পাইকাররাও সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে গুড় কিনে নেন। এই গুড় তারা ঢাকার কারওয়ান বাজার, কাপ্তানবাজার, যাত্রাবাড়ি পাইকারি বাজার, মিরপুরের মাজার রোড, বাবুবাজারসহ বিভিন্ন আড়তে বিক্রি করেন। সেখান থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করেন। অর্থাৎ চাষি থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে তিনবার হাতবদল হয় খেজুরের গুড়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুড়ের দাম বেশি হওয়ায় এখন আর নির্ভেজাল গুড় পাওয়া যায় না। গুড়ের রঙ সাদা করতে আগেও তৈরির সময় চিনি মেশানো হতো। এখন দাম বেশি হওয়ায় চিনির মেশানো হয় বেশি। ফলে পিওর গুড় বাজার পাওয়া দুস্কর। ইনকিলাবের জেলা পর্যায়ের প্রতিনিধিরা জানান, ঘন কুয়াশা বেশি পড়ার সময় থেকে খেজুরের রস আহরণ বেড়ে গেছে। গাছিরা নিজেরাই এখন গুড় উৎপাদন করে থাকেন। আগে খেজুরের রস বিক্রি বেশি হলেও এখন গুড় বেশি তৈরি করা হয়। ব্যবসায়ীরা জানান, গ্রামে যে গুড় ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে পাইকারি বিক্রি হয়; সেই গুড় ঢাকায় ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ বাজারে কোনো খেজুরের পিওর গুড় পাওয়া যাবে না। পিওর গুড় খেতে চাইলে এক কেজি গুড় কিনতে হবে ৬০০ টাকার বেশি দরে। চিনি মেশানো গুড় ৩০০ থেকে ৩৯৯ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষ্যে এতো দাম দিয়ে খেজুরের গুড় দিয়ে পিঠপুলি খাওয়া সম্ভব নয়। তবে যারা খাচ্ছেন তারা দামে হ্যাটট্রিক করা ভেজাল গুড় দিয়েই পিঠে তৈরি করে খাচ্ছেন।
গতকাল শনির আখড়া বাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দোকানীরা একই গুড় স্তরে স্তরে সাজিয়ে রেখেছেন। দাম জিজ্ঞাস করতেই তারা বিভিন্ন ধরণের দাম জানাচ্ছেন। রহস্য জানতে চাইলে তারা জানান, খেজুরের পিওর গুড় পেতে চাইলে কেজিতে ৪০০ টাকা গুনতে হবে। তবে ভেজাল গুড়ের সেগুলোতে চিনির পরিমান কম দেয়া হয় সেগুলো পিওর গুড় হিসেবে বিক্রি হয়ে থাকে। এই পিওর গুড়েরর কেজি ৩০ থেকে ৩৫০ টাকা। তবে ২২০ টাকা থেকে ২৫০ টাকায় গুড় পাওয়া যায়। সেগুলোতে খেজুরের রসের ফ্লেবার থাকে। রাজধানীর ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর রোডের সুপারশপ মীনা বাজারে পাটালি খেজুর গুড় বিক্রি হচ্ছে ৩৯৯ টাকা কেজি। প্রতিষ্ঠানটি ‘নাটোর জেলা প্রান্তিক চাষি’ লোগো লাগানো গুড় বিক্রি করছে। ‘গাছির হাসি’ নামের অর্ধবৃত্তাকৃতির ৩৬০ গ্রাম গুড়ের দাম ১৪৩ টাকা ৬৪ পয়সা। এককেজির দাম ৩৯৯ টাকা। একই দামে মাটির পাত্রে ঝোলা গুড় বিক্রি করছে তারা। বেশি দামে গুড় বিক্রির বিষয়ে মীনা বাজারের একজন বিক্রিয়কর্মী বলেন, আমাদের গুড়ে কোনো ভেজাল নেই। তাই দাম বেশি। সুপারশপে গুড় কিনতে আসা সরকারি চাকরিজীবী রিয়াজুল ইসলাম বলেন, এক কেজি গুড়ের দাম ৪০০ টাকা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তারা বলছে অর্গানিক। তবে দাম কম হলে সুবিধা হতো। যাত্রবাড়ির একটি সুপারশপে মাদল শস্যভাণ্ডারে প্রিমিয়াম কোয়ালিটির খেজুর গুড় বিক্রি হচ্ছে ৩৯৪ গ্রাম ১৫৭ টাকা ২১ পয়সা। এক কেজি ৩৯৯ টাকা। সুপারশপ স্বপ্নতে বিক্রি করা হচ্ছে মেসার্স আর জেড এন্টারপ্রাইজের সরবরাহ করা ‘রাজশাহী খেজুরের ঝোলা গুড়’। এখানে ৯০০ গ্রামের দাম ২৮৫ টাকা। আরামবাগের একটি নাকমরা সুপারশপ প্রতি কেজি ২৫০ টাকা দরে বিক্রি করে। বর্তমানে ৩০ টাকা ছাড়ে বিক্রি করছে ২২০ টাকা কেজি। ‘চুয়াডাঙ্গার খেজুরের ঝোলা গুড়’ তারা বিক্রি করছে ৩২০ টাকা কেজি দরে। ‘নাটোরের খেজুর গুড়’ মোহাম্মদপুর রিং রোডের শস্য প্রবর্তনায়ও ৪০০ টাকা কেজি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে। কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের এক ব্যবসায়ী বলেন, মানভেদে পাটালি গুড় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। যে গুড়ের মান খুব ভালো নয়, ভেজাল মেশানো, সেগুলো ১৫০ টাকা কেজি। যেগুলো ভালো সেগুলোর দাম আরো বেশি। তবে ভালো মানের গুড় একসঙ্গে এক পাল্লা অর্থাৎ পাঁচ কেজি কিনলে দাম পড়বে ৭৫০ টাকা। মাটির পাতিলের খুচরা ঝোলা গুড় ১৭০ টাকা কেজি।
রাজশাহী, নাটোর রংপুর ও চুয়াডাঙ্গায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গুড়ের দাম নিয়ে খুশি নন চাষিরা। পাইকাররা তাঁদের কাছ থেকে গুড় কিনে নিয়ে কেজিপ্রতি প্রায় ১০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছেন। চাষিরা বলছেন, লাভ চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের পকেটে। যশোরে এক গ্রামের কৃষক জানান, জানান, গাছ কাটা রস সংগ্রহ থেকে গুড় তৈরি করা অনেক কষ্টের কাজ। নিজের ও লিজ নেওয়া কিছু গাছ মিলিয়ে মোট ২২০টি খেজুরগাছের রস থেকে তিনি গুড় তৈরি করছেন। একটি গাছ থেকে সপ্তাহে এক কেজি গুড় পাওয়া যায়। সেই গুড় তিনি বিক্রি করেন ১৮০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে। বাজারে ভালো মানের গুড় বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা কেজিতে। সেই গুড় রাজধানী ঢাকায় ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
নাটোরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খেজুর রসের তৈরি পাটালি গুড় মান ও স্থান ভেদে বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। পাটালি ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। ঝোলা গুড় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা এবং দানা গুড় ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। পাটালি গুড়ের জন্য প্রসিদ্ধ খাজুরা বাজারে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি।
জানতে চাইলে চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, এ জেলায় আড়াই লাখ খেজুরগাছ আছে। তা থেকে চলতি মৌসুমে আড়াই হাজার মেট্রিক টন গুড় উৎপাদন সম্ভব। রস সংগ্রহ থেকে গুড় উৎপাদন পর্যন্ত একটি খরচ আছে। দাম আরেকটু বাড়লে চাষিদের জন্য ভালো হতো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন