সারা দেশে জেঁকে বসছে শীত। কোথাও কোথাও চলছে মৃদু ও মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ। তবে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে শীতের প্রকোপ বেশি। প্রচÐ ঠান্ডায় কাঁপছে মানুষ। খড়কুটো জ্বালিয়ে ঠান্ডা থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে মানুষ। কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে অনেক এলাকা। উত্তরের হিমেল বাতাসে কাবু হয়ে পড়েছে উত্তরাঞ্চলের মানুষ। হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। ঘনকুয়াশার কারণে বঙ্গবন্ধু সেতুর উত্তরপ্রান্তে গতকাল দীর্ঘ ৮ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। শিশু ও বয়স্করা ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। চিকিৎসকরা জানান, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর-সর্দির রোগী বেশি হাসপাতালে আসছে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গতকাল পঞ্চগড়ে সকাল ৯টায় ৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল শাহ জানান, গত বছর ১২ ডিসেম্বর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ এর নিচে তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল। এ বছর বুধবার ৯ ডিগ্রিতে নেমেছে তাপমাত্রা। গত বছর এ সময়ে ৮-এর ঘরে তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল।
তাপমাত্রা কমার কারণে তীব্র শীত অনুভব হচ্ছে। গতক মঙ্গলবার বিকেলের পর থেকেই বইতে থাকে উত্তরের হিমেল হাওয়া। হাওয়ায় নেমে আসে শীত। মঙ্গলবার বেলা ১১টা পর্যন্ত জেলাজুড়ে কুয়াশা আর শিশির ঝরতে দেখা যায়। গ্রামে হাটবাজারগুলোতে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করতে দেখা গেছে।
কনকনে শীতের কারণে বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন শ্রেণির খেটে খাওয়া মানুষ। শীতের জন্য কাজে যেতে কষ্ট হচ্ছে অনেকের। তবে পেটের তাগিদে কাউকে নদীতে পাথর তুলতে, কাউকে চা-বাগানে আবার কাউকে দিনমজুরের কাজ করতে যেতে দেখা গেছে। চা-শ্রমিক আনোয়ার হোসেন, শাহজাহান ও জাহেরুল ইসলাম বলেন, সকালে প্রচÐ শীত অনুভ‚ত হচ্ছে। কনকনে শীতের কারছে চা বাগানে কাজ করতে গেলে চা পাতা বরফের মতো লাগে। বাগানের পাতা তুলতে গিয়ে হাত-পাতা অবশ হয়ে আসে। তারপরও কাজ করতে হচ্ছে।
অটোরিকশা চালক আব্দুল করিম বলেন, একদিকে তীব্র শীত, আরেক দিকে ঘনকুয়াশা। গাড়ি চালানো কষ্টকর হয়ে উঠেছে। যাত্রীও মিলছে না। আয় রোজগার কমে গেছে।
এদিকে দিন-রাতে তাপমাত্রা দুই রকম থাকায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত রোগ। জ্বর, সর্দি-কাঁশি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ ঠান্ডাজনিত রোগ নিয়ে হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হচ্ছেন রোগীরা। জেলা হাসপাতাল ও উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শত শত রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু। চিকিৎসকরা জানান, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে রোগীর চাপ বেড়েছে। এমনিতে শীত মৌসুমে আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় বাতাসে জীবাণুর পরিমাণ বেড়ে যায়। শীতজনিত রোগ হিসেবে সর্দি-কাঁশি, শ্বাসকষ্ট বেশি হয়ে থাকে। আর শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠরা শীতজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।
রংপুরের শীতার্ত মানুষরা বলছেন, কনকনে ঠান্ডায় তারা জবুথবু। বেলা বাড়লেও শীতের তীব্রতা কমছে না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের দেখা মিললেও নেই কোনো উত্তাপ। শীতের তীব্রতা বেড়ে থাকায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে খেটে খাওয়া মানুষ। শীত নিবারণের জন্য অনেকে খড়কুটায় আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। পৌষের দ্বিতীয় সাপ্তাহে গাইবান্ধায় সন্ধ্যা থেকে ঘনকুয়াশায় ঢেকে থাকছে চারপাশ। উত্তরের হিমেল হাওয়ায় মাঠে যেতে পারছেন না কৃষকরা। বয়স্ক ও শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে ঠান্ডার নানা রোগে। জেলার চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকার স্বল্প আয়ের মানুষ শীতবস্ত্রের অভাবে রোদ না ওঠা পর্যন্ত স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছে না।
রংপুর, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হিমালয়ের কাছাকাছি হওয়ায় জেলাগুলোতে শীতের তীব্রতা বেশি। দিনের বেশিরভাগ সময় কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে রাস্তাঘাট। দুুপুরে কুয়াশা কিছুটা কমলেও সন্ধ্যা নামতেই শীতের তীব্রতা বেড়ে যায়। প্রচÐ শীতে নিম্ন আয়ের মানুষজন শীতের দাপটে কাহিল হয়ে পড়েছে। শীত বস্ত্রের অভাবে অনেকেই কাজে যোগ দিতে পারছে না। আবার যারা কাজে যাচ্ছেন তাদের সন্ধ্যা নামতেই বাজারের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। তারা বলছেন, শীতের চোটে জীবন ধীরগতির হয়ে পড়েছে। নিলফামারী ও দিনাজপুরের কিছু এলাকায় বইছে মৃদ্যু শৈত্যপ্রবাহ। কুয়াশা কম থাকলেও হিমেল বাতাসের কারণে জনদুর্ভোগ বেড়েছে। দরিদ্র-অসহায় মানুষগুলো বিপাকে আছেন। কাজে যেতে পারছেন না দিনমজুররা।
রংপুরের দু’জন সাংবাদিক জানান, কনকনে ঠান্ডা বাতাসে রংপুরে শীত জেঁকে বসছে। দিনে খানিকটা সহনীয় থাকলেও সন্ধ্যার পর হিমেল বাতাসে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে রংপুর অঞ্চলের ছিন্নমূল মানুষদের। তীব্র শীতে নদ-নদী বেষ্টিত জেলা কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ চরমে। শীত বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছেন কৃষক ও দৈনিক খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। রংপুর শহরে শীতবস্ত্রের দোকানে বিক্রি বেড়েছে। বগুড়ায় শীত বাড়ার সাথে সাথে ফুটপাতগুলোতে শীতের কাপড় কিনতে মানুষের ভিড় বাড়ছে। জয়পুরহাটে ঘনকুয়াশার কারণে রোদের দেখা পেতে অনেক বেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের।
ইনকিলাবের প্রতিনিধিরা জানান, শীতের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বয়স্ক ও শিশুদের ওপর। এই দুই শ্রেণির মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে, শয্যার তুলনায় চারগুণ শিশু রোগী ভর্তি রয়েছে হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা বলছেন, শীত মৌসুম শুরুর পর থেকেই শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ বা অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন (এআরআই), গলাব্যথা থেকে শুরু করে ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া ইত্যাদি রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
এদিকে অতিরিক্ত ঘনকুয়াশা কারণে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে বেড়ে যায় ভোগান্তি। যার কারণে এ মহাসড়কে ধীরগতিতে চলাচল করে ছোট-বড় যানবাহন। ফলে যানজটেরও সৃষ্টি হয়। গতকাল বুধবার ভোর থেকে সকাল ৯টায় পর্যন্ত মহাসড়কের এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক দুই লেন থাকায় এই অংশের কোথাও কোথাও থেমে থেমে যানযটের সৃষ্টি হয়েছিল। এতে করে ঘনকুয়াশায় ভোগান্তি পড়েন যাত্রী ও চালকরা। দেখা যায়, ঘনকুয়াশার কারণে মহাসড়কের বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় থেমে থেমে যানযট ও ধীরগতি সৃষ্টি হয়। এছাড়াও ভোর থেকে বেলা ৯টা পর্যন্ত এ মহাসড়কে পণ্য ও মালবাহী পরিবহনের অতিরিক্ত চাপ থাকায় আরও যানবাহনের চাপ বেড়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু সেতু ট্রাফিক কন্ট্রোলরুম সূত্রে জানা যায়, বুধবার ভোর রাত থেকে অতিরিক্ত ঘনকুয়াশার কারণে দৃষ্টি সীমার ৪০ মিটার নিচে হওয়ায় বঙ্গবন্ধু সেতুতে মধ্যে রাত থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব ও সিরাজগঞ্জের সেতু পশ্চিম টোলপ্লাজায় ৭টি বুথের মধ্যে ৫টি বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কুয়াশা কিছুটা কমে আসায় সেতুতে ৭টি বুথ চালু করে দেয় সেতু কর্তৃপক্ষ। ফলে মহাসড়কে যানজট ধীরে ধীরে কমে যায়।
ঘনকুয়াশা কারণে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের বিকল্প এলেঙ্গা-ভ‚ঞাপুর-বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে ঢাকা ও উত্তরবঙ্গগামী পরিবহনগুলো চলাচল করে। এতে করে এ আঞ্চলিক মহাসড়কের পাথাইলকান্দি, সিরাজকান্দি, ন্যাংড়া বাজার, মাটিকাটা, গোবিন্দাসী স্কুলরোড ও ভ‚ঞাপুর বাসস্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে যানজট দেখা দেয়। ফলে স্থানীয়রা পরিবহন ও পথচারীরাও অনেকটা ভোগান্তিতে পড়ে। এলেঙ্গা হাইওয়ে থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জাহিদ হাসান জানান, ঘনকুয়াশার কারণে সেতুর কয়েকটি টোলবুথ বন্ধ থাকে। যার কারণে মহাসড়কের বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব এলাকায় যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। এতে করে বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের এলেঙ্গা পর্যন্ত কোথায় কোথাও যানজট দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সফিকুল ইসলাম জানান, ঘনকুয়াশার কারণে রাত থেকে সেতুর টোল বুথগুলোর ৫টি টোল বুথ বন্ধ রাখা হয়। এতে মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বেড়ে যায়। ফলে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত কোথাও কোথাও যানবাহন ধীরগতিতে চলাচল ও থেমে থেমে যানজটের সৃষ্টি হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন