শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

বছর শেষে কৃষিতে স্বস্তি

ফিরে দেখা বিশ্ব পর্যায়ে বাংলাদেশ ধান, পাট, কাঁঠাল, আম, পেয়ারা, আলু, সবজি ও মাছ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০১ এএম

বৈশিক মহামারি করোনাভাইরাস পরবর্তী পরিস্থিতি, আগাম বন্যা, খরা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিরূপ প্রভাবের মধ্যে বছরজুড়েই দেশের কৃষি খাত ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। বিশেষ করে আগাম বন্য, খরা এবং ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর সার-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি ও লোডশেডিংয়ের কারণে কৃষি খাত ছিল ব্যাপক ঝুঁকিতে। খাদ্য উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ছিল শঙ্কা। তবে সব শঙ্কা কাটিয়ে বছর শেষে আমন ধানের বাম্পার ফলনে হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখে। সেই সাথে বৈশ্বিক খাদ্য সঙ্কটের যে শঙ্কা তার প্রেক্ষাপটে দেশের খাদ্য সঙ্কটের আশঙ্কাও কেটে গেছে।
কৃষিবিদরা বলছেন, বিগত কয়েক বছরে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। জমি চাষ থেকে শুরু করে ধানের চারা রোপণ, ধান কাটা এবং মাড়াই সবই এখন যন্ত্রের সাহায়্যে হচ্ছে। নতুন নতুন যন্ত্রপাতির ব্যবহারে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ এবং উৎপাদন ব্যয়ও অনেক কমেছে। দেশে প্রতিবছর ফসলের জমি কমে যাচ্ছে। অপরদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। আর অধিক জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাচ্ছে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কম্বাইন হারভেস্টার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, পাওয়ার টিলারসহ মোট ৭৪ হাজার ৯৮০টি কৃষি যন্ত্রপাতি ডিএই’র মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। যান্ত্রিকীকরণ ত্বরান্বিত করতে গত দুই বছরেই বিতরণ করা হয়েছে ৩ হাজার ৮৬৫টি কৃষি যন্ত্র। ২০২০-২৫ বছরের মধ্যে মোট ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষি যন্ত্র বিতরণের জন্য একটি মেগা প্রকল্পও বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় মোট জমি কম হলেও সম্প্রতি কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব পর্যায়ে ধান, পাট, কাঁঠাল, আম, পেয়ারা, আলু, সবজি ও মাছ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে ৩য়, পাট উৎপাদনে ২য়, পাট রপ্তানিতে ১ম, সবজি উৎপাদনে ৩য়, আলু ও আম উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম এবং মোট ফল উৎপাদনে ২৮তম স্থান র্অজন করছে। কৃষিতে সাফল্য বিবেচনায় প্রধান প্রধান কয়েকটি ফসলের ২০০৯ সালের সঙ্গে তুলনায় ২০২০ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চালের উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩ শতাংশ, গমের ৪৫ শতাংশ, ভুট্টার ৭৭৫ শতাংশ, আলুতে ১০১ শতাংশ, ডালে ৩৭৫ শতাংশ, তেলবীজে ৮১ শতাংশ, সবজির ক্ষেত্রে ৫৭৮ শতাংশ যা বিশ্বে অভাবনীয়।
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সরকারও এ খাতের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে। করোনার অভিঘাত ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট সংকটময় পরিস্থিতিতে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাজেটে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ২৪ হাজার ২২০ কোটি টাকা। এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাস ও সারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে এ খাতে ভর্তুকি ব্যয় আরও ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
এ মৌসুমে বোরোর আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রায় ১৭০ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। সারাদেশের ২৭ লাখ কৃষক এ প্রণোদনার আওতায় বিনামূল্যে বীজ ও সার পাচ্ছেন। তিনটি ধাপে বা ক্যাটাগরিতে দেওয়া হচ্ছে এসব প্রণোদনা। হাইব্রিড ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রায় ৮২ কোটি টাকার প্রণোদনার আওতায় ১৫ লাখ কৃষকের প্রত্যেককে দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে ২ কেজি ধানবীজ। উচ্চফলনশীল জাতের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রায় ৭৩ কোটি টাকার প্রণোদনার আওতায় উপকারভোগী কৃষক ১২ লাখ। এতে একজন কৃষক এক বিঘা জমিতে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় ৫ কেজি বীজ, ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি এমওপি সার বিনামূল্যে পাচ্ছেন। এ ছাড়া কৃষি উপকরণ ও কৃষি ঋণ সহজে বিতরণের লক্ষে এরই মধ্যে ২ কোটি ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৯ কৃষকের মধ্যে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ করেছে এবং দেশের কৃষকদের মাঝে নতুন নতুন প্রযুক্তি সম্প্রসারণ ও আপতকালীন কৃষি সহায়তা প্রদানে নিয়মিত প্রণোদনা ও পুনর্বাসন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
কৃষি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বসতবাড়ির আঙিনাসহ পতিত জমিতে তৈরি করা হচ্ছে পারিবারিক পুষ্টি বাগান। যেখানে বাড়ির পাশে শাকসবজি ও ফুল ফল চাষ করে বারো মাসের পুষ্টির চাহিদা পূরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর মাঠ পর্যয়ের কর্মীদের মাধ্যমে কৃষকদের ফেলে রাখা বাড়ির আঙিনাসহ পতিত জমিতে পারিবারিক পুষ্টি বাগান তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করে আসছে। এর আওতায় গ্রামের মানুষ বসতবাড়ির আঙিনা, পুকুর ও খালের পাড়, বাড়ির আশপাশ, প্রতি ইঞ্চি অব্যবহৃত ও অনাবাদি জমিতে শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন করবেন। এতে মানুষের পুষ্টিহীনতা দূর হওয়ার পাশাপাশি খাদ্যনিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।
রফতানি বাজারে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে কৃষি পণ্যের মান বাড়াতে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। সেক্ষেত্রে উৎপাদন পর্যায় থেকে জাহাজীকরণ পর্যন্ত পণ্যের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিতে সক্ষমতা তৈরি করতে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সব পর্যায়েই। এরই মধ্যে আম উৎপাদন করে ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান বিভিন্ন চেইন মার্কেটে বিক্রি করে ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। পণ্য ও সেবার পরিধি বাড়াতে সরাসরি উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
কৃষিতে সরকারের বিশেষ নজর দেওয়ার পরও ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানোয় বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। এতে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে কৃষিবিদরা মনে করছেন। এর ছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সঙ্কটও কৃষি উৎপাদন ব্যহত করবে। এসব কারণে কৃষি খাতে উৎপাদনের খরচ অনেক বেড়েছে। এতে বেশি সমস্যায় আছেন বর্গাচাষিরা।
বছরের শুরুতেই আগাম বন্যার কবলে পড়ে সিলেটসহ হাওরাঞ্চলের বোরো ফসল। এপ্রিলে সিলেটে বন্যা দেখা দেয়। এর পর মে এবয় জুনে তৃতীয় দফায় বন্যার কবলে পড়ে গোটা হাওরাঞ্চল। গত ১৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় সিলেটে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির হয়। ৪ লাখ ১৬ হাজার ৮১৯টি পরিবারের ২১ লাখ ৮৭ হাজার ২৩২ জন সদস্য ক্ষতির মুখে পড়েছেন বন্যায়। ২৮ হাজার ৯৪৫ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়। বন্যায় সিলেটে প্রাণিসম্পদ খাতে ১১ কোটি ৮১ লাখ ৪৪ হাজার টাকার ক্ষতি হয়। গোটা হাওরাঞ্চলে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এরপর জুলাই-আগস্টে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলসহ বিভিন্ন অঞ্চল খরার কবলে পড়ে। এতে আমন রোপণ ব্যাহত হয়। তবে নভেম্বরের শুরুতে ঝড়-বৃষ্টি হওয়ায় আমনে বাম্পার ফলন হয়। এতে কৃষক স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।
তবে কৃষি খাতের সার্বিক উন্নয়নের জন্য দুর্বল কৃষি বিপণন ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোমূলক অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা, কৃষিতে বহুমুখীকরণের অভাব, কৃষি উপকরণের মান নিয়ন্ত্রণে দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, কৃষক ও উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের অপ্রতুলতা, মানসম্পন্ন কৃষি উপকরণ উৎপাদন ও সরবরাহের অপর্যাপ্ততা, কৃষিজাত পণ্যের সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণের অপর্যাপ্ততা ও কৃষিপণ্যের পরিবহন ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা এসবের উন্নয়ন জরুরি।
কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক গোলাম হাফিজ বলেন, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে হবে। জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন ফসলের জাত উদ্ভাবন করতে হবে। এ জন্য গবষেণায় গুরুত্ব দিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন