ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের পর্যটন খাত। এবার পর্যটন মৌসুম শুরুর পর থেকে পর্যটন স্পটগুলোতে ভ্রমণপিপাসুদের ভিড় বেড়েই চলেছে। পর্যটকদের এমন ভিড়ে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি ফুটেছে। বছর শেষে স্কুলের ছুটি, নতুন বর্ষবরণ, সাপ্তাহিক ছুটি সব মিলিয়ে চলতি সপ্তাহে দেশের পর্যটন এলাকায় লাখ লাখ ভ্রমণপিপাসু মানুষ ভিড় করবে। দেশের পর্যটন স্পটগুলোতে এখন বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে এখন লাখো পর্যটনের ভিড়। এ শিল্পকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারের অর্থনীতি এখন ব্যাপক চাঙা। চলতি ডিসেম্বর মাসেই পর্যটনকে ঘিরে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে বলে স্থায়ী ব্যবসায়ীরা জানান। এ ছাড়া বছর শেষে বান্দরবানের মেঘলা, নীলাচল, শৈলপ্রপাত, চিম্বুক, নীলগিরি, নাফাকুম, তমাতুঙ্গিসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলো এখন পর্যটকদের পদচারনায় মুখর।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারা দেশে ১১৯টি পর্যটন স্পট রয়েছে। এই খাতে প্রায় ৪০ লাখ লোক কাজ করে। বছরে প্রায় ২ কোটি লোক দেশের পর্যটন স্পটগুলোতে ভ্রমণ করে। বছরে আয় হয় ৩০০ কোটি টাকারও বেশি। ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরে দেশে আগত পর্যটকদের মাধ্যমে আয় হয়েছে ২,২৭৯ কোটি টাকার কিছু বেশি, যা ২০২০ সালে ছিল ১ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। এতে আয় বেড়েছে ৫৯ শতাংশ। ২০২১ সালের পর আন্তর্জাতিক পর্যটকদের তথ্য হালনাগাদ করেনি বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড। নিয়মিত পর্যটক আগমনের তথ্য হালনাগাদ করতে এখন নতুন সফটওয়্যার তৈরির কথা ভাবছে পর্যটন বোর্ড।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রতিবেশি দেশগুলোর মতো জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য হয়ে উঠতে পারেনি। দুর্বল পর্যটন ব্যবস্থাপনা, এয়ারপোর্ট অবকাঠামো, জটিল ভিসা নীতি, সামাজিক বাধা-নিষেধ ও আরামদায়ক পরিবহন ব্যবস্থার অভাব এর জন্য দায়ী।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আকবারুদ্দিন আহমদ বলেন, দেশের অবকাটামোগত অনেক উন্নয়ন হয়েছে। পদ্মা সেতু যোগাযোগে নতুন মাত্রা এনেছে। এজন্য ভারতীয় ও নেপালী পর্যটকরা আগ্রহী হবে। সরকার ধাপে ধাপে উন্নত সড়ক ও রেলপথের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে রাজধানীর সাথে সংযোগের কথাও ভাবছে। দেশে গত ১৫-২০ বছরে উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং কটেজ, হোটেল ও মোটেল নির্মাণের সাথে সাথে দেশের স্থানীয় পর্যটন খাতেরও বিকাশ হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড এখন আগামী ২৫ বছরের মধ্যে দেশের পর্যটন খাতের উন্নয়নে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অধীনে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করছে।
দেশের পর্যটন এলাকাগুলোর সার্বিক অবস্থা নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো রিপোর্ট নিম্নে তুলে ধরা হলো।
কক্সবাজার থেকে শামসুল হক শারেক জানান, বিশ্বের দীর্ঘ সমুদ্রসৈকতের শহর কক্সবাজার এখন দেশের পর্যটন রাজধানী পরিণত হচ্ছে। করোনা সঙ্কট কাটিয়ে পর্যটনে চাঙা এখন কক্সবাজারের অর্থনীতি। লাখো পর্যটকে এখন ভরপুর কক্সবাজার। শুধু ডিসেম্বরেই টার্নওভার হয়েছে হাজার কোটি টাকা। এতে উপকৃত হচ্ছে সরকার এবং খুশি কক্সবাজারের মানুষ ও পর্যটন ব্যবসায়ীরা।
কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পকে ঘিরে সরকার কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে উন্নীত করেছে। শত বছরের দাবি দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নতুন বছরেই উন্মুক্ত হচ্ছে। এছাড়াও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পুরনো আরাকান সড়কটি ৪ লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আরো আছে কক্সবাজার থেকে মিরসরাই পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্প। একইভাবে পর্যটক সেবায় সেন্টমার্টিন টেকনাফ সাগর পথে যুক্ত হয়েছে প্রায় একডজন আধুনিক জাহাজ। এসবই হচ্ছে কক্সবাজারের পর্যটনকে ঘিরে। এতে বাড়ছে দেশ-বিদেশি পর্যটক। আর এই খাতে টার্নওভার হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। বাড়ছে রাজস্ব আয়।
জানা গেছে, মধ্য ডিসেম্বর থেকে বিপুলসংখ্যক পর্যটকের আগমনে কক্সবাজারের সাড়ে ৪ শতাধিক হোটেল মোটেল ও রিসোর্ট এখন পর্যটকে ভরপুর। প্রতিদিন সৈকতে দেখা যায় লাখো পর্যটকের পদচারণা। ৩১ ডিসেম্বর থার্টি ফাস্ট নাইট উদযাপনে এখন কক্সবাজারে অবস্থান করছেন প্রায় ৫ লাখ পর্যটক। এতে কর্মব্যস্ত এখন সৈকত এলাকার ফটোগ্রাফার, জেডস্কি ও বিচ বাইক চালকসহ পর্যটক সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো। একই সঙ্গে জমজমাট বার্মিজ মার্কেটগুলো। পাশাপাশি পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে দীর্ঘ সৈকত, হিমছড়ি, ইনানী টেকনাফ, প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, মহেশখালী, কুতুবদিয়া ডুলাহাজারা সাফারী পার্ক ও রামুর পর্যটন স্পটগুলো।
দেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক সুন্দর এলাকায় দেশ-বিদেশি পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করছে। শুধু কক্সবাজারেই তিনটি পর্যটন পার্ক তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। পার্ক তিনটির কাজ সমাপ্তির পর প্রতিবছরে এতে বাড়তি ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি ৪০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা যায়, ২০০০ সাল থেকে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে বিপ্লব শুরু হয়েছে। গত ২২ বছরে কক্সবাজারে গড়ে উঠেছে ডজনখানেক পাঁচ তারাকা হোটেলসহ সাড়ে চার শতাধিক হোটেল মোটেল এবং গেস্টহাউস। পাশাপাশি গড়ে উঠেছে উন্নতমানের রেস্টুরেন্টসহ সৈকতে ছাতা-চেয়ার এবং পর্যটক সেবায় বিভিন্ন ধরণের সেবা প্রতিষ্ঠান। বেড়েছে আকাশ পথে এবং সড়ক পথে পর্যটক যাতায়াত। এমনকি সাগরপথেও ইউরোপীয় দেশ সমূহ থেকে পর্যটকরা এসেছেন কক্সবাজারে। গত ৫ বছরে প্রায় ২ কোটি পর্যটক কক্সবাজারে ভ্রমণ কেেরন। আর পর্যটন খাতে আয় হয়েছে বিশাল অঙ্কের টাকা।
২০২২ সালের শেষ সূর্যকে বিদায় জানাতে কক্সবাজারে পাঁচ লাখ পর্যটকের সমাগম হলেও প্রশাসনের কড়াকড়ি থাকায় থার্টিফাস্ট নাইট উদযাপনে কোন অনুষ্ঠান থাকছে না। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, সৈকতের উন্মুক্ত স্থানে থার্টিফাস্ট নাইট উপলক্ষে কনসার্ট, গান বাজনাসহ সব ধরনের আয়োজন বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে হোটেল কর্তৃপক্ষ চাইলে তাদের অতিথিদের জন্য নববর্ষ উদ্যাপনের আয়োজন করতে পারে।
বান্দরবান থেকে মো. সাদাত উল্লাহ জানান, বান্দরবানে বছরের শেষ ২ দিনের ছুটিতে পর্যটকে মুখরিত হয়ে উঠেছে। হোটেল-মোটেল আর বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে পযর্টকের উপচে পড়া ভিড়। এদিকে পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ সদস্যরা।
শীতের আমেজ আর সেই সঙ্গে ২০২২ সালের শেষ ছুটিতে জেলার মেঘলা, নীলাচল, শৈলপ্রপাত, চিম্বুক, নীলগিরি, নাফাকুম, তমাতুঙ্গিসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলো এখন পর্যটকদের পদচারনায় মুখরিত। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিটি স্পটেই ছুটছেন অসংখ্য পর্যটক। পাহাড়, নদী, ঝর্ণার অপরূপ রূপ দেখে বিমোহিত হচ্ছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা।
বান্দরবানের অন্যতম সুন্দর পর্যটনকেন্দ্র নীলাচলে ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা মো. জসিম ইনকিলাবকে জানান, বছরের শেষ ছুটিতে বান্দরবান বেড়াতে আসলাম। বান্দরবান খুবই সুন্দর ও প্রকৃতি প্রেমীদের ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত একটি জেলা।
এদিকে গত ১০ অক্টোবর থেকে বান্দরবান জেলার রুমা-রোয়াংছড়ি, থানচি এবং আলীকদম উপজেলার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকাগুলোতে যৌথবাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে। সেসঙ্গে পর্যটকদের নিরাপত্তা বিবেচনায় দেশ-বিদেশি সবার জন্য বান্দরবানের কয়েকটি উপজেলা ভ্রমণে গত ১৮ অক্টোবর থেকে কয়েক দফায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। ফলে এখনো বান্দরবানের রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় পর্যটকরা ভ্রমণ করতে পারছে না।
তবে দীর্ঘদিন পর বাকি ৫ উপজেলার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে বিপুল সংখ্যক পর্যটকের আগমনে জেলার হোটেল-মোটেলগুলো কানায় কানায় ভর্তি হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে পর্যটকবাহী গাড়িগুলোও ভাড়া হওয়ায় খুশি পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
বান্দরবান মাইক্রোবাস-জিপ-পিকআপ মালিক সমিতির সভাপতি মো. নাছিরুল আলম বলেন, দীর্ঘদিন পরে জেলায় বিপুল সংখ্যক পর্যটকের উপস্থিাতি আমাদের মনে শান্তি নিয়ে এসেছে। গতবছর করোনার কারণে আমরা অনেক ক্ষতির মধ্যে ছিলাম। আবার এবছর প্রশাসন থেকে বান্দরবানের কয়েকটি উপজেলায় কয়েক দফায় নিষেধাজ্ঞার কারণে আমদের ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হয়েছিল। তবে টানা বন্ধের কারণে বান্দরবানে এখন প্রচুর পর্যটক রয়েছে। তারা বান্দরবান বেড়াতে পেরে খুশি, আর আমরা তাদের গাড়িতে করে বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে ভ্রমণ করাতে পেরে আরও বেশি খুশি।
পটুয়াখালী থেকে মো: জাকির হোসেন জানান, পযর্টকদের ভিড়ে মুখরিত কুয়াকাটা সাগর সৈকত। ১৫ ডিসেম্বর থেকে পর্যায়ক্রমে ছুটি শুরু হয়ে পরবর্তীতে ২৩ ,২৪ ডিসেম্বরের সাপ্তাহিক ছুটির সাথে ২৫ ডিসেম্বরের বড় দিনের ছুটি যোগ হওয়ায় পর্যটকদের ব্যাপক আগমন ঘটে কুয়াকাটায়। এদিকে থার্টিফাস্ট ডিসেম্বর উদযাপন করতে ব্যাপক পর্যটক কুয়াকাটায় ইতোমধ্যে চলে আসায় কুয়াকাট উৎসবমুখর।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ চালু হওয়ায় ভ্রমন পিপাসু পর্যটকদের সংখ্যা কয়েকগুন বৃদ্দি পেয়েছে। কুয়াকাটা সাগর সৈকতে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে আর্ন্তজাতিক মানের কয়েকটি হোটেল মোটেল রিসোর্টসহ দেড় শতাধিক হোটেল-মোটেল-কটেজ। কুয়াকাটার প্রতিটি হোটেল-মোটেল গেস্টহাউসের রুম ইতোমধ্যে বুকিং হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন, কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এম এ মোতালেব শরীফ। তিনি বলেন কুয়াকাটায় দেড় শতাধিক হোটেল মোটেল রয়েছে, ইতোমধ্যে প্রথমশ্রেণির সকল হোটেল-মোটেলসহ গেস্ট হাউজগুলোর বুকিংসম্পন্ন হয়ে গেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন