শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বছরজুড়েই দুশ্চিন্তায় ব্যাংক খাত

ডলার-রিজার্ভ সঙ্কট ও এস আলম গ্রুপের ভুয়া ঋণ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২৩, ১১:৫২ পিএম

বৈশ্বিক মহামারি করোনা, জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে দিশেহারা মানুষ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব। সবমিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যার নেতিবাচক প্রভাব দেশের অর্থনীতিতেও। বিশেষ করে বছরজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে ছিল ব্যাংক খাত। ডলারের চরম সঙ্কট, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, রিজার্ভে টান পড়া নিয়ে বছরজুড়েই আলোচনা ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংক খাত নিয়ে নানা ধরনের গুজব ভেসে বেড়ায়। অনেকে এসব গুজবের ওপর ভর করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। কেউ কেউ ব্যাংক থেকে টাকাও তুলে নিচ্ছেন। এসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সব তথ্যই ভুয়া। কোনো তারল্য সঙ্কট নেই। ব্যাংকে থাকা গ্রাহকদের আমানত নিরাপদ রয়েছে। এছাড়া বছরের শেষ দিকে বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের অভিযোগ টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়। আর তাই নানা কারণে বেশ দুর্বল হয়ে পড়ছে দেশের ব্যাংক খাত। ইসলামী ব্যাংকসহ তিনটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ভুয়া ঠিকানা ও অস্তিত্ববিহীন কোম্পানির নামে কয়েক হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নেয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বেসরকারি সংস্থাটি মনে করে, এই পরিস্থিতি খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচারে জর্জরিত ব্যাংক খাতকে খাদের কিনারে ঠেলে দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সুশাসনের অভাব, বেপরোয়া দুর্নীতি, ব্যাংক পরিচালনায় রাজনৈতিক ও পরিচালকদের হস্তক্ষেপ এবং খেলাপি ঋণের মাত্রাতিরিক্ত ঊর্ধ্বগতির কারণেই মূলত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্র মতে, দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। যে কারণে কয়েকটি ব্যাংকে বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এর সঙ্গে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যাংকের পরিচালক ও শীর্ষ পর্যায়ের ব্যাংকাররা জড়িত। পাশাপাশি করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব ব্যাংকগুলোর দুর্বলতাকে আরও গভীরে নিয়ে গেছে। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় তা প্রকাশ্যে চলে আসে। এতে মানুষ নতুন করে সঞ্চয় করতে পারছে না। বরং আগের সঞ্চয় ভেঙে সংসারের ব্যয়নির্বাহ করছেন। ঋণ পরিশোধ কমে গেছে। বিশেষ ছাড়ে ঋণকে নিয়মিত রেখে কোনো সুদ আদায় না করেও কাগুজে মুনাফার মাধ্যমে আয় বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ ছাড়ের পরও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। খেলাপির মধ্যে আদায় অযোগ্য বা কুঋণের পরিমাণই হচ্ছে সোয়া ৮৮ শতাংশ। বড় জালিয়াতদের ঋণের বড় অংশই এখন কুঋণে পরিণত হয়েছে। এসব নিয়ে ব্যাংক খাত নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়েই চলেছে।

পাশাপাশি বছরব্যাপি ডলারের সঙ্কট ব্যাংক খাতকে আরও বেশি ভুগিয়েছে। রেমিট্যান্স, আমদানি-রফতানি বেশি থাকলে এসব খাত থেকে ব্যাংকের আয় বাড়ে। কিন্তু এসব খাতের পাশাপাশি ব্যবসা খাতে মন্দা চলছে। ফলে ব্যাংকের আয় কমেছে। ডলারের প্রবাহ কম থাকায় আমদানির এলসি খুলতে পারছে না। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে গিয়ে টাকা চলে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৭৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বাবদ প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। তারল্য কমার এটিও একটি কারণ।

এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংক খাত নিয়ে নানা ধরনের গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে। অনেকে এসব গুজবের ওপর ভর করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। কেউ কেউ ব্যাংক থেকে টাকাও তুলে নিচ্ছে। এসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সব তথ্যই ভুয়া। কোনো তারল্য সঙ্কট নেই। ব্যাংকে থাকা গ্রাহকদের আমানত নিরাপদ রয়েছে।

তবে গত জুলাইতে নতুন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেয়ার পর নানামুখী উদ্যোগে ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবার খেলাপি ঋণ আদায়ে তৎপর হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। নতুন বছরে খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকিং কমিশনকে পরামর্শও দিয়েছেন তারা। প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ কমাতে পারলেই আগামীতে ঘুরে দাঁড়াবে দেশের ব্যাংক খাত।

খেলাপি ঋণ বাড়ছেই
ব্যাংক খাতে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরের শেষে প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকায়। সেপ্টেম্বর মাস শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। খেলাপিতে পরিণত হয়েছে মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও বেড়েছে খেলাপি ঋণ
ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও (এনবিএফআইএস) ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের সেপ্টেম্বর শেষে এ খাতে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৩২৭ কোটি ১০ লাখ টাকা।

ডলারের বাজারে অস্থিতিশীলতা
দেশে মার্কিন ডলারের চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এই সঙ্কট ব্যাংক খাতকে আরও বেশি ভোগাচ্ছে। রেমিট্যান্স, আমদানি-রফতানি বেশি থাকলে এসব খাত থেকে ব্যাংকের আয় বাড়ে। কিন্তু এসব খাতের পাশাপাশি ব্যবসা খাতে মন্দা চলছে। ফলে ব্যাংকের আয় কমেছে। ডলারের প্রবাহ কম থাকায় আমদানির এলসি খুলতে পারছে না। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। সরকারের আমদানি দায় পরিশোধে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।
চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার বিক্রির পরিমাণ ৬০৫ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেখানে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কিনেছিল প্রায় ৭৯৩ কোটি ডলার।

এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স বাতিল
দেশের খোলাবাজারে মার্কিন ডলার নিয়ে কারসাজি করায় পাঁচটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম বিসমিল্লাহ মানি এক্সচেঞ্জ, অঙ্কন মানি এক্সচেঞ্জ ও ফয়েজ মানি এক্সচেঞ্জ। এছাড়া ৪২টি মানি এক্সচেঞ্জকে শোকজ করা হয়েছে। আরও ৯টি প্রতিষ্ঠান সিলগালা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ডলারকাণ্ডে ছয় এমডিকে শোকজ
মার্কিন ডলারের সঙ্কটকে পুঁজি করে অনৈতিক সুবিধা নেয় ১২ ব্যাংক। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার মজুত করে বড় অঙ্কের মুনাফা করে তারা। কোনো কোনো ব্যাংক ডলার বিক্রি করে ৭৭০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের কারণে ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক ও বিদেশি খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের এমডিদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও অধিক মুনাফাকারী অন্য ৬ ব্যাংককে শোকজ না করায় পরবর্তীতে বিষয়টির গুরুত্ব থাকেনি।

রিজার্ভে টান পড়া নিয়ে ‘শঙ্কা-সংশয়’
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এতে রিজার্ভের পরিমাণও দিন দিন কমছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৪০০ কোটি (৩৪ বিলিয়ন) ডলারের আশপাশে ওঠানামা করছে। এ থেকে রফতানি উন্নয়ন তহবিলসহ কয়েকটি তহবিলে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৮০০ কোটি (৮ বিলিয়ন) ডলার। এ বিনিয়োগ করা অর্থ বাদ দিলে রিজার্ভ থাকে ২৬০০ কোটি (২৬ বিলিয়ন) ডলার, যা দিয়ে বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত আমদানির মধ্যে সাড়ে চার মাসের ব্যয় মেটানো সম্ভব। অর্থাৎ খরচ করার মতো রিজার্ভ এখন ২৬ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভ কমার এ প্রক্রিয়াকে সরকার স্বাভাবিক বললেও এ নিয়ে নানান সমালোচনা শুরু হয়। সরকারবিরোধীরা রিজার্ভে টান পড়ায় বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হতে পারে বলেও বিভিন্ন সময় আশঙ্কা জানিয়ে আসছে।

রিজার্ভ সংস্কারে আইএমএফের প্রস্তাব
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আসলে কত, রিজার্ভ গেলো কোথায়? এসব প্রশ্ন তোলা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন মহল থেকে। এমন প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) বাংলাদেশের রিজার্ভ সংরক্ষণের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে রিজার্ভের হিসাব রাখাসহ বেশকিছু সংস্কারের পরামর্শ দেয় আইএমএফ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তাতে সায় দেয়। এর পরের দিনই অর্থমন্ত্রী জানান, আইএমএফ ও দেশীয় দুই হিসাবই থাকবে। এতে আইএমএফ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রাপ্তির পথও অনেকটা পরিষ্কার হয়।

সন্দেহজনক লেনদেন
দেশের আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে। সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) ও সন্দেহজনক কার্যক্রম (এসএআর) হয়েছে আট হাজার ৫৭১টি। বিএফআইইউর ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে। এরপরই তুমুল আলোচনায় আসে আর্থিক খাত। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন ছিল পাঁচ হাজার ২৮০টি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে -এর সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৭৫টি। অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংকে সন্দেহজনক লেনদেন দেড়গুণের বেশি বেড়েছে।

এলসিতে ২০০ শতাংশ ওভার ইনভয়েসিং
দেশে এলসির ক্ষেত্রে ২০ থেকে ২০০ শতাংশ ওভার ইনভয়েসিং করা হচ্ছে। গত বছর এবং চলতি বছরের এলসির তথ্য যাচাইয়ের সময় এ বিষয়টি ধরা পড়ে। ওভার ইনভয়েসিং করা ১০০ এলসি বন্ধ করা হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা চাইলে পরে তা সংশোধন করে প্রকৃত দরে আমদানি করতে পারবেন।

অস্থিরতার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নতুন গভর্নর
ডলার সঙ্কট, রিজার্ভ কমে যাওয়াসহ নানান সঙ্কটে ব্যাংক খাতে যখন অস্থিরতা, তখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নতুন গভর্নর নিয়োগ করে সরকার। নতুন গভর্নর হন আবদুর রউফ তালুকদার। তিনি দেশের ১২তম গভর্নর হিসেবে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান হিসেবে যোগ দেন।

ঋণ পরিশোধে ঢালাও ছাড়
করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের ঋণ পরিশোধে বেশ কয়েক দফা বিশেষ ছাড় দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এবার করোনার পাশাপাশি বন্যা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আবারও ছাড় দেওয়া হয়। নিয়মিত থাকা ঋণে এ বিশেষ সুবিধা মিলবে।

জুন, সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বরে প্রান্তিকে বড় ঋণের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ পরিশোধ করার কথা যথাক্রমে তার ৫০, ৬০ ও ৭৫ শতাংশ পরিশোধ করলে আর খেলাপি হবে না। কৃষি ও সিএমএসএমই ঋণে যে পরিমাণ পরিশোধ করার কথা তার ২৫, ৩০ ও ৪০ শতাংশ পরিশোধ করে খেলাপিমুক্ত থাকা যাবে। আর বন্যাকবলিত জেলায় কৃষিঋণ পরিশোধে -এর চেয়েও বেশি ছাড় দেয়া হয়েছে।

প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ ৮ ব্যাংক
ঋণ পরিশোধে ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ ছাড় দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। ছাড়ের মেয়াদ এখনো শেষ হয়নি। ফলে ঋণের কিস্তি পুরোপুরি পরিশোধ না করেও খেলাপি হওয়া থেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন গ্রাহকরা। তবুও কমছে না ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ। উল্টো আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৩ হাজার ৩৯৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। ফলে উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে ব্যাংক খাত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে আট ব্যাংক। এসব ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড, জনতা ব্যাংক লিমিটেড, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকার বেশি। এদিকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয়। সেখানে দেশে খেলাপির হার ৯ শতাংশের বেশি। একইসঙ্গে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ (প্রভিশন) বা শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে অর্থসংস্থানে ব্যর্থ সরকারি-বেসরকারি খাতের অন্তত আটটি ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১০ কর্মকর্তাকে শোকজ
সংবাদকর্মীদের সঙ্গে তথ্য শেয়ার করার অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চপদস্থ যুগ্ম-পরিচালক থেকে নির্বাহী পরিচালক পর্যন্ত ১০ কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়। কড়াকড়ি আরোপ করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশেও। এটা নিয়ে শুরু হয় সমালোচনা। পরে সাংবাদিকদের ওপর দেওয়া বিধিনিষেধ তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

বিলাসীপণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি
আমদানি ব্যয়ের চাপ কমাতে বিলাসীপণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক। মোটরকার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়। একইসঙ্গে অতি জরুরি পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে বলা হয়।

স্বর্ণ নিলামে বিক্রির উদ্যোগ
বিভিন্ন সময় জব্দ করা স্বর্ণ নিলামে বিক্রি করার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রাথমিকভাবে দুই হাজার ১৭০ ভরি সোনা (২৫ দশমিক ৩১ কেজি) বিক্রি করার কথা জানানো হয়। লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ীরা নিলামে অংশ নিয়ে এ স্বর্ণ কিনতে পারবেন বলেও জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক।

ইসলামী ব্যাংকগুলোয় ঋণ কেলেঙ্কারি
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে এস আলম গ্রুপের ১১টি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে চারটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩টি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। প্রভাবশালী চক্রের যোগসাজশে গায়েবি প্রতিষ্ঠানে তিন ইসলামী ব্যাংক বিপুল পরিমাণ এ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন ও ব্যাংকগুলোর নথিপত্র অনুযায়ী, অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা কৌশলে হাতিয়ে নেওয়া হয়।

তারল্য সঙ্কটে ইসলামী ব্যাংক
ঋণ জালিয়াতির কারণে তারল্য সঙ্কট দেখা দেয় ইসলামী ব্যাংকগুগলোতে। গ্রাহকরা আস্থা সঙ্কটের কারণে টাকা তুলে নিতে থাকেন। চলমান তারল্য সঙ্কট কাটাতে পাঁচটি ইসলামী (ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংককে তারল্য সহায়তা হিসেবে নগদ টাকা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের আমানত কমেছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা।

বাণিজ্য ঘাটতি
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১ হাজার ৯৩৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। বিপরীতে রফতানি হয়েছে ১ হাজার ১৮০ কোটি ডলারের পণ্য। এতে ৭৫৫ কোটি (৭ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন) ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে দেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি এক ডলার ১০৩ টাকা ৮৫ পয়সা ধরে) এর পরিমাণ ৭৮ হাজার ৩১০ কোটি টাকা।
রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমছেই
চলতি (২০২২-২০২৩) অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) টানা দুই বিলিয়ন ডলার করে রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। এর পরের মাস সেপ্টেম্বর থেকে টানা তিনমাস দেড় বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসে রেমিট্যান্স। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১০৭ টাকা হিসাবে) এ অর্থ ১৭ হাজর ৬৩ কোটি টাকার বেশি।

দুই ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক
ঋণ নিয়ে বিতর্কের কারণে ইসলামী ব্যাংক ও ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে গত ১২ ডিসেম্বর দু’জন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইসলামী ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়া আবুল কালাম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেন রিজার্ভ ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক। আর ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়া মোতাসিম বিল্লাহ পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের পরিচালক। পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এ দুই কর্মকর্তা ইসলামী ব্যাংক ও ফাস্ট
সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদের সবগুলো সভায় অংশ নেবেন। সূত্র মতে, ইসলামী ব্যাংক থেকে নভেম্বর মাসে নাবিল গ্রুপ ও মার্টস বিজনেস লাইন নামে দুইটি ভুয়া কোম্পানি খুলে দুই হাজার ৪৬০ কোটি টাকা ঋণ নেয়। এর মধ্যে স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক ও ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে দুই হাজার ৩২০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে তারা ঋণ নিয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক প্রতিবেদনে জানা যায়, এস আলম গ্রুপ একাই ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। তাদের ঋণ পাওয়ার সর্বোচ্চ সীমা হলো ২১৫ কোটি টাকা। নিয়ম না মেনে তাদের ঋণ দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে ব্যাংকটি এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বিতর্কিত এই শিল্প গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে দেশের মোট আটটি ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনার কারণে দুই বছর গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধে নানা সুবিধা পেয়েছিলেন। চলতি বছরও সুবিধা দেয়া হয়েছে। এতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ভাবনা ছিল ঋণ পরিশোধ না করলেও হয়তো চলবে। এ কারণে ব্যাংক খাতের মতো এ সেক্টরেও খেলাপি ঋণ দিন দিন বেড়েই চলছে। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলোয় সমস্যা অনেকদিনের। সুশাসনের বড় অভাব রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। বড় বড় জালিয়াতি হয়েছে সুশাসনের অভাবে। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হয়নি। এসব কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। খেলাপিদের ছাড় দিয়ে আরও উৎসাহিত করা হয়েছে।

এদিকে শুধু ব্যাংকই নয়; আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মূলধন থেকে আয় ছিল ইতিবাচক। এখন তা নেতিবাচক, ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। সম্পদ থেকে আয় ইতিবাচক থেকে নেতিবাচক হয়েছে। এক বছর আগে খেলাপি ঋণ ছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৩ শতাংশ। আগে ছিল ১৫ শতাংশ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (8)
Parvej Molla ১ জানুয়ারি, ২০২৩, ৮:৫৬ এএম says : 0
আমাদের দেশে নতুন নিয়মের সার্কাস চলছে, ব্যাংক থেকে নিজের টাকা তুলতে গেলে ২/৩ দিন আগে জানাতে হয় আরো কত নিয়মের মধ্যে আটকা পরা লাগে, এখানে দেখছি ভুয়া কোম্পানি ভুয়া কাগজ দিয়ে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তোলা যায়
Total Reply(0)
Omar Faruqe Khan ১ জানুয়ারি, ২০২৩, ৮:৫৫ এএম says : 0
যারা ব্যবস্থা নেওয়ার চেয়ারে বসে আছেন তারাই তো এই লুটপাটের সাথে জড়িত। সকল শ্রেণি পেশার প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তারা এক হয়ে দেশ ও দেশের অর্থনীতি কে রক্ষা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, তা না হলে চেয়ার থাকবে চেয়ারের মূল্য থাকবে না আপনাদের।
Total Reply(0)
Kazi Shahidul ১ জানুয়ারি, ২০২৩, ৮:৫৫ এএম says : 0
ইসলামী ব্যাংকের ঘটনা একটি সাজানো নাটক, সরকারের অধীনে থাকা লোকজন এবং তাদেরকে দ্বায়িত দেওয়া হয়েছে সবাই মিলেমিশে লুটপাট করেছে।
Total Reply(0)
Syed Ataher Uddin ১ জানুয়ারি, ২০২৩, ৮:৫৫ এএম says : 0
সমাজের সারা গায়ে জখম, কোথায় লাগাবেন মলম। ইসলাম তথা মানুষের ভরষা ইসলামি ব্যাংক আর তার এমন অবস্থা,দুঃখ রাখবোটা কোথায়।
Total Reply(0)
Faruq Molla ১ জানুয়ারি, ২০২৩, ৮:৫৫ এএম says : 0
সাধারণ আমজনতা এসব ক্ষেত্রে কোন কিছু করার ক্ষমতা রাখে না তাই তাঁরা শুধু খবর পড়ে।
Total Reply(0)
Alam Gir ১ জানুয়ারি, ২০২৩, ৮:৫৬ এএম says : 0
একজন কৃষক যখন পাঁচ হাজার টাকা লোনের জন্য ব্যাংক যায় তাকে কত কাগজ পত্র, জমির দলিল সহ আরো কতকিছু তন্ন তন্ন করে দেখার পর কয়েকদিন গুরা গুরির পরে পাঁচ হাজার টাকা লোন দেয়!আর এখানেনা ভুয়া কাগজ দিয়ে ত্রিশ হাজার কোটি টাকা লোন নিয়ে গেছে।দেশের জনগণ এত সহজে এটা মেনে নেবে ?
Total Reply(0)
Ringku Labib ১ জানুয়ারি, ২০২৩, ৮:৫৬ এএম says : 0
এদেশে কিছু কোম্পানি আছে ওরা সরকার কেও পাত্তা দেয়না। ওদের কিচ্ছুই হবেনা
Total Reply(0)
জাহান খুরশিদ ১ জানুয়ারি, ২০২৩, ৮:৫৭ এএম says : 0
সরকারের বিচার বিভাগের দেশের প্রতি ও আর্থিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেও সুয়োমোটো রুল জারি করে এধরনের প্রশান্ত মহাসাগর চুরি রুখতে হবে। এই টাকা দশের লাঠি চোরের বোঝায় পরিনত হবে। এদেরকে জাতীয় ব্যাঙ্ক চোর এর খেতাব দিতে হবে।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন