নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হচ্ছে আগামীকাল রোববার। একই দিনে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে পড়ানোর ধরন ও মূল্যায়নব্যবস্থা পাল্টে যাচ্ছে। একই সঙ্গে পাঠ্যবইও বদলে যাচ্ছে। আগামীকাল তিনটি শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। পরের বছর থেকে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শ্রেণিতে এই ব্যবস্থা চালু হবে। যদিও মাদরসা শিক্ষার পরিবর্তিত সিলেবাস নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও ইসলামপ্রিয় মানুষদের মধ্যে। তাদের অভিযোগ সরকার যখন মাদরাসা শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষার জন্য নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়ে আলেম-ওলামাদের প্রশংসা পাচ্ছেন তখনই একটি কুচক্রিমহল কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তকে ডারউইনের বিতর্কিত মতবাদ, হিন্দুত্ববাদ, রথযাত্রা, হাজার হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী, নগ্ন ও অশ্লিল ছবি যুক্ত করা এবং বাংলাদেশের কৃষ্টি-কালচার বিরোধী বিষয় অন্তর্ভূক্ত করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিপদগামী করার চেষ্টা করছে। মাদরাসা বা দ্বীনি শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞদের অন্ধকারে রেখে হঠাৎ করে মাদরাসার ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বিভিন্ন বইয়ে এসব অন্তর্ভূক্ত করে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন তারা। বিষয়টি নিয়ে বিগত কয়েকমাস মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ, স্মারকলিপি প্রদান করলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এসসিটিবি) কোন কর্ণপাত করেনি। বরং সেই বিতর্কিত সিলেবাসেই আজ থেকে মাদরাসাগুলোতে পাঠদান করতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এনসিটিবির সূত্রে জানা গেছে, আগামীকাল প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হবে। ২০২৪ সালে চালু হবে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। ২০২৫ সালে চালু হবে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে। উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে চালুর মধ্য দিয়ে পুরোপুরিভাবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আলেম-ওলামাদের অভিযোগ, শতকরা ৯১% মুসলমান যে দেশে বসবাস করে সে দেশে কুরআন-সুন্নাহ ও মুসলিম ঐতিহ্য, কৃষ্টি, দীর্ঘদিনের লালিত সংস্কৃতির সাথে সাথে বর্তমান চাহিদাকে সমন্বয় করে দেশবরেণ্য আলেম ওলমাদের অংশগ্রহণে একটি যুগোপযোগি শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক তৈরি হবে এটাই ছিল প্রত্যাশা। আলেম-ওলামাগণ বারবার একই দাবী- মুসলিম জনগোষ্ঠির ইমান-আকীদা, শিক্ষা-সংস্কৃতি সমুন্নত রেখে আধুনিক বিষয়সমূহ অন্তর্ভূক্তি ও মাদরাসা শিক্ষার বৈশিষ্ট উপযোগী পরিমার্জন সাপেক্ষে এবং সমন্বয়ের মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক উন্নয়ন ও সংস্কার করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০২২ সালের জন্য এনসিটিবি ৬২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৬ষ্ঠ শ্রেণির জন্য যে ৯টি বই (বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, গণিত, শিল্প সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, বিজ্ঞান) পাইলটিং/পরীক্ষামূলকভাবে পাঠদান করা হয় এবং ২০২৩ সাল থেকে ৬ষ্ঠ, ৭ম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ঐসমস্ত বই স্কুল ও মাদরাসায় বাধ্যতামূলকভাবে পড়াতে হবে বলে এনসিটিবি ঘোষণা দিয়েছে, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বর্ণিত পাঠ্যপুস্তক মাদরাসা শিক্ষার জাতীয় লক্ষ-উদ্দেশ্য (জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০ এ বর্ণিত) এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট উপেক্ষা করে রচিত হয়েছে।
তারা বলেন, এসব পাঠ্যপুস্তকে সন্নিবেশিত অধিকাংশ ছবি, চিত্র, শব্দ, বাক্য, তথ্য ও উপাত্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মর্মাহত এবং তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ শিক্ষা নিয়ে সঙ্কিত করে তুলবে। সেখানে ৬ষ্ঠ শ্রেণির ৯টি বইয়ের মধ্যে কুরআন, সুন্নাহ, সাহাবায়ে কেরাম, আহলে বাইত, মুসলিম মনীষী, বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিকদের বানী, উদ্ধৃতি, নীতি-নৈতিকতা সৃষ্টিকারী কোন বিষয় স্থান পায়নি। উপরন্ত আপত্তিজনক বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন : বিজ্ঞান বইয়ে ১১ জন উলঙ্গ নারী-পুরুষের ছবি দিয়ে তাদের লজ্জাস্থানের পরিচয় দেয়া হয়েছে এবং ছেলে-মেয়েদের বিভিন্ন অঙ্গের বর্ণনা দিয়ে ওষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ঈমান হারা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৯টি বইয়ে শতশত মেয়ের বেপর্দা ছবি ছাপানো হয়েছে। হিন্দু মহিলার শাঁখা পরা ছবি রয়েছে। ইংরেজি বইয়ে কুকুর ও নেকড়ে বাঘের ২৪টি ছবি ছাপানো হয়েছে যা ইউরোপীয় সংস্কৃতির অংশ বিশেষ।
ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ডারউইনের বিবর্তনবাদ (মানুষ সৃষ্টি হয়েছে বানর থেকে), দেব-দেবীর নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছবি এবং দেবতাদের পরিচয় দেয়া হয়েছে যা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রত্যাখ্যাত।
জীবন জীবিকা বইয়ে ইশপের গল্প, প্রনাম, গানশোনা, নাচ, বাঁশি, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের পাশ্চাত্য ও মূর্তিপূজার সংস্কৃতি চর্চার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও দূর্গাপুজা, গীতাঞ্জলী, কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। উপরন্ত বইগুলোতে যে সমস্ত মানুষের নাম ব্যবহৃত হয়েছে একটি মুসলিম দেশে সত্যিই আপত্তিকর। যেমন: আনিকা, লিটল, রাড, প্লাবন, রতন, দীপক, নন্দিনী, এন্তি, মিসেল, মনিকা চাকমা, ডেবিট, প্রিয়াঙ্কা, মন্দিরা ইত্যাদি। সামগ্রিক বিবেচনায় ৯২% মুসলমানের দেশে পাশ্চাত্য ও দেব-দেবীর বিশ্বাস ও তাদের আরাধনার শিক্ষা সংস্কৃতির আদলে তৈরি বইগুলো স্কুলের জন্যও উপযোগি নয়। মাদরাসায় এসকল বই পাঠ্যপুস্তক হিসেবে গ্রহণ ও ব্যবহারের প্রশ্নেই আসেনা।
মাদরাসার শিক্ষকরা বলেন, এই ধরণের পাঠ্যপুস্তক মাদরাসায় পাঠদানের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রেরিত এবং নির্দেশিত হলে, মাদরাসা শিক্ষাবান্ধব সরকারকে ইসলাম ও মুসলমানদের ঐতিহ্য বিরোধী হিসেবে দাঁড় করিয়ে ধর্ম ও মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর সকল অর্জনকে ম্লান করে দিবে, যা কোন অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায় না।
এদিকে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দিয়েই শুরু হচ্ছে নতুন এই শিক্ষাক্রম, তাই এর ফলাফল নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যেই শঙ্কা আছে। এনসিটিবির পরিকল্পনা ছিল, ডিসেম্বরের মধ্যে সব শিক্ষককে পাঁচ দিনের সশরীর প্রশিক্ষণ দিয়ে জানুয়ারিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা। কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) মাধ্যমিকের শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে বিষয়ভিত্তিক মাত্র এক ঘণ্টার অনলাইন প্রশিক্ষণ দিয়েছে। অবশ্য মাউশি বলছে, ৬ জানুয়ারি থেকে সব শিক্ষককে পাঁচ দিনব্যাপী সশরীর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন