বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

অসুন্দরের উৎকট প্রকাশ

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ৭ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

দেয়াল লিখন আইন লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতা
রাজধানীসহ দেশের কোথাও ‘অনাব্রæ’ কোনো দেয়াল নেই। লিখন, পোস্টার, ব্যানার এবং সাইনবোর্ডে ঢেকে দেয়া হয়েছে। অসুন্দরের উৎকট প্রকাশ ঘটাচ্ছে বিশেষত: গত দেড় দশকে। নাগরিক সৌন্দর্য ঢেকে দেয়ার এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই ‘নগর-পিতা’ স্বয়ং তাদের অনুসারী এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলরগণও। দীর্ঘদিন বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করছিলেন তারা। কিন্তু যেই না মেট্রোরেলের পিলারকে স্পর্শ করলÑ তখনই আলোচনায় আসে বিষয়টি। একটি রাজনৈতিক দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যকে সতর্ক করে চিঠি দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে নিজ খরচে পিলার থেকে পোস্টার অপসারণের। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে ঢাকা সিটি করপোরেশন স্বীকার করে নিয়েছে, রাজধানীর সৌন্দর্য বজায় রাখতে দেয়াল লিখন ও পোস্টার পরিষ্কার ও অপসারণে সংস্থাটির বাড়তি অর্থ ব্যয় হচ্ছে।
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, পোস্টার ও দেয়াল লিখন অপসারণে সিটি করপোরেশনের বাড়তি অর্থ ব্যয় কি শুধুই নির্দিষ্ট একটি দলের নেতার কারণেই হচ্ছে? ক্ষমতাসীন দল থেকে শুরু করে কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন পোস্টার, ব্যানার, তোরণ আর লিখনে নোংরা করছে না? রাজধানীতে যে দেয়ালেই চোখ আটকায় সেখানেই দেয়াল লিখন আর পোস্টার। সংবিধানের মতপ্রকাশে স্বাধীনতাকে উচ্চকিত রাখতেই হয়তো দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা দেয়াল লিখন, পোস্টারের বিষয়ে কেউ কিছু বলছেন না। কিন্তু নাগরিক অধিকার, স্বাচ্ছন্দ ও সৌন্দর্য নিশ্চিত করার আইনও যে রয়েছে সেটি অনেকেই হয়তো জানেন না।
‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন’টি প্রণীত হয়েছে ২০১২ সালে। গত ১৩ বছরে আইনটি অকার্যকর ও অনালোচিত আইনে পরিণত হয়েছে। বিশেষত: রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধিদের মাঝে আইনটি প্রতিপালনের চেয়ে লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতাই লক্ষনীয়। প্রতিযোগিতার মাত্রা এতটাই বেশি যে, লিখন আর পোস্টার নিয়ন্ত্রণে আইনের কোনো অস্তিত্ব রয়েছে বলেই অনেকে জানে না। আর আইন লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাই। এক দশকে আইনটির অহর্নিশ লঙ্ঘনের দায়ে শাস্তির ঘটনা নেই একটিও। যদিও আইনে শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে মোবাইল কোর্টকে।
মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় নিয়োজিত একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, কার ওপর আইন ফলাব? দেয়ালে সাঁটা পোস্টারে যাদের ছবি থাকে বাস্তবে তাদের ওপর কি আইন প্রয়োগ সম্ভব?
ঢাকার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনে দেখা যায়, দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকা ভবন, দেয়াল, স্থাপনা, ফ্লাইওভারের পিলার বহু রঙা পোস্টার, দেয়াল লিখন আর বাহারি ব্যানারে ছেয়ে গেছে। যেন পোস্টার দিয়েই নির্মাণ করা হয়েছে স্থাপনা। পোস্টারের জন্যই নির্মাণ করা হয়েছে দেয়াল। পোস্টার লাগানোর প্রতিযোগিতায় এক পোস্টারের ওপর সাঁটা হচ্ছে আরেক পোস্টার। রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের আধিপত্য বিস্তারের মহড়া লক্ষ্য করা যায় পোস্টারে। একেকটি পোস্টার যেন নগরীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার স্বাভাবিক দাবির প্রতি কঠিন কটাক্ষ।
নাগরিক সৌন্দর্য রক্ষায় ২০১২ সালে প্রণীত হয় ‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১২’। জনপ্রতিনিধিরা জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে আইনটি প্রণয়ন করলেও আইনটি লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত জনপ্রতিনিধিরাই। তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ প্রশ্নে অসহায় বোধ করেন ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
আইনজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক দল ও আইনপ্রণেতারা যখন আইন লঙ্ঘন করেন তখন সাধারণ মানুষের কাছে আইন দুর্বল হয়ে পড়ে। আর তখনই আইন প্রতিপালনের পরিবর্তে লঙ্ঘনের প্রবণতা বাড়ে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়াও আইনটি প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের মতো স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিটিই আইনটি বেশি লঙ্ঘন করছেন। নিজে লঙ্ঘন করে অন্যকে সেটি প্রতিপালনে বাধ্য করা যায় না। দেয়াল-ভবন-স্থাপনাকে পোস্টার-ব্যানার- লিখনমুক্ত রাখার দায়িত্ব যার ওপর তাকেই আইন লঙ্ঘন করতে দেখলে অন্যে তা প্রতিপালন করবে কেন?
‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ)আইন-২০১২’র ৪ ধারায় বলা হয়েছে, এই আদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানোর জন্য প্রশাসনিক আদেশ দ্বারা স্থান নির্ধারণ করিয়া দিতে পারিবে এবং উক্তরূপে নির্ধারিত স্থানে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে। তবে শর্ত থাকে যে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে উল্লেখিত নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোন স্থানে বিধি দ্বারা নির্ধারিত শর্ত ও পদ্ধতিতে এবং নির্দিষ্ট ফি প্রদান সাপেক্ষে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে।’
আইনের ‘৩’ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ধারা ৪ অনুযায়ী নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোন স্থানে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে না।’ আইনের ‘৬’ ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করিলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে। ২ উপধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগাইলে উক্ত অপরাধের জন্য উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্যূন ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ১০ (দশ) হাজার টাকা অর্থদÐ আরোপ করা যাইবে, অনাদায়ে অনধিক ১৫ (পনের) দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদÐ প্রদান করা যাইবে এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাহার নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট দেয়াল লিখন বা পোস্টার মুছিয়া ফেলিবার বা অপসারণের জন্য আদেশ প্রদান করা যাইবে।
৩ উপধারায় বলা হয়েছে, কোন সুবিধাভোগীর অনুক‚লে ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগাইলে উক্ত অপরাধের জন্য উক্ত সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে অন্যূন ১০ (দশ) হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদÐ আরোপ করা যাইবে, অনাদায়ে অনধিক ৩০ (ত্রিশ) দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদÐ প্রদান করা যাইবে এবং উক্ত সুবিধাভোগীকে তাহার নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট দেয়াল লিখন বা পোস্টার মুছিয়া ফেলিবার বা অপসারণের জন্য আদেশ প্রদান করা যাইবে।
আইনের ‘৭’ ধারায় বিচার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, ধারা ৬ এর উপধারা (২) এর অধীন সংঘটিত অপরাধ মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ (২০০৯ সনের ৫৯ নং আইন) এ উল্লেখিত মোবাইল কোর্ট কর্তৃক বিচার্য হইবে এবং ধারা ৬ এর উপধারা ৩-এর অধীন সংঘটিত অপরাধের বিচার কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮ এর চ্যাপ্টার ২৩ অনুসারে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে।’
আইনের ‘৮’ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো কোম্পানি কর্তৃক এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হইলে উক্ত অপরাধের সহিত সংশ্লিষ্টতা রহিয়াছে কোম্পানির এমন প্রত্যেক পরিচালক, ম্যানেজার, সচিব, অংশীদার, কর্মকর্তা ও কর্মচারী উক্ত অপরাধ সংঘটন করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে; যদি না তিনি প্রমাণ করিতে পারেন যে, উক্ত অপরাধ তাহার অজ্ঞাতসারে সংঘটিত হইয়াছে অথবা উক্ত অপরাধরোধ করিবার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছেন।’
আইনের একই ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোম্পানি বলিতে যে কোনো প্রতিষ্ঠান, অংশীদারী কারবার, সমিতি, সংঘ, সংগঠন ও সংস্থাও অন্তর্ভুক্ত হইবে এবং পরিচালক বলিতে অংশীদার বা পরিচালনা বোর্ডের সদস্যকেও বুঝাইবে।’
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত তোরণ, পোস্টার, ব্যানার আর দেয়াল লিখনে ছেয়ে গেছে। ২০১২ সালে ‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১২’ প্রণয়ন করে। অথচ আইনটি লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা এগিয়ে। অন্যান্য রাজনৈতিক দল যেমনÑ বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং ক্ষুদ্র দলগুলোর নেতাকর্মীরাও পোস্টার বিরোধী আইনের প্রতি ভ্রæক্ষেপহীন। দেয়াল লিখন বিরোধী আইন লঙ্ঘনে প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এক। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতা, দলীয় এমপি, মহানগর ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে ব্যানার-পোস্টারে দেয়াল ছেয়ে ফেলছে। জাতীয় এবং স্থানীয় অনেক সমিতি-সংগঠনও লাগাচ্ছেন পোস্টার। নির্বাচনকালে মৌসুমী পোস্টার ছাড়াই নানা ছুতোয় নেতাকর্মীরা পোস্টার লাগাচ্ছেন। দলের বিভিন্ন উপলক্ষ্য, নতুন কমিটি ঘোষণা, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, জন্মাবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী, বিজয় দিবস, ২৬ মার্চ, একুশে ফেব্রæয়ারি, ঈদ-উল আজহা, ঈদ-উল ফিতর, দুর্গাপুজা, জন্মাষ্টমী, বড়দিন উপলক্ষের যেন শেষ নেই। অমুকের সৌজন্যে তমুক। বাহারি পোস্টারে শুধু ছবি আর ছবি। অনেক সময় কোনো ধরনের বক্তব্য ছাড়াই পোস্টার ছাপানো হচ্ছে ছবি সম্বলিত। কেন, কি কারণে, কে পোস্টার সাঁটিয়েছেন সেটিও বোঝার জো নেই পোস্টার দেখে। আত্মপ্রচারনা, আধিপত্য বিস্তার, ক্ষমতা জাহির করার উদ্দেশ্যে দেয়ালে লাগানো হয় এসব পোস্টার।
‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ)আইন-২০১২’ অহরহ লঙ্ঘনের বিষয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)র প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মঞ্জিল মোরসেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, দেশে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি আইন রয়েছে। বহু আইন রয়েছে প্রয়োগ হয় না। আলঙ্করিক আইন। দেয়াল লিখন (নিয়ন্ত্রণ) আইন তেমনই একটি। তার মতে, আইন কার্যকরের বিষয়টি নির্ভর করতে প্রয়োগকারী সংস্থার সক্ষমতার ওপর। আইনের চোখে সবাই সমান বলা হলেও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আইনটি লঙ্ঘন করছেন বেশি। আইন প্রয়োগকারীরা তাদের শাস্তির আওতায় আনতে ভয় পাচ্ছে। আইন প্রণয়নের পর সেটি কার্যকর করে আন্তরিক না হলে এ ধরনের আইন নাগরিকের জন্য কোনো সুফলই বয়ে আনে না।
ঢাকা বারের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান মনে করেন, অনেক আইনই রয়েছেÑ যেগুলো রাজনৈতিক দল, তাদের নেতা ও আইনপ্রণেতাদের মাধ্যমে লঙ্ঘিত হচ্ছে। আইন অগ্রাহ্য করার দায়ে শাস্তি হওয়ার দৃষ্টান্ত না থাকায় আইনটি কার্যকরিতা হারিয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলো আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে সেই আইন অন্যদের প্রতিপালনে বাধ্য করা যায় না। দেয়াল লিখন আইন প্রয়োগের দৃষ্টান্ত তৈরি না হওয়ায় এ বিষয়ে অনেকে ওয়াকিবহালও নয়।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন