ব্রিটেনের রাজা চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়ানার ছোট ছেলে প্রিন্স হ্যারির আত্মজীবনী ‘স্পেয়ার’ এখনও মুক্তি পায়নি ব্রিটেনে। কিন্তু বৃহস্পতিবারই তা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে স্পেনে। সেই থেকে এই বই নিয়ে চর্চা চলছেই। এর আগে হ্যারিকে দাবি করতে দেখা গিয়েছিল কলার চেপে ধরে তাকে নাকি মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন উইলিয়াম। এবার সামনে এল তার বাবা কিং চার্লসের এক ‘বদ রসিকতা’। তিনি নাকি রাজকুমারকে ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘কে বলতে পারে আমি তোমার সত্যিকারের বাবা কিনা।’ কিন্তু কেন এমন উদ্ভট রসিকতা করেছিলেন চার্লস? হ্যারির দাবি, সেই সময় একটা গুঞ্জন ক্রমেই বাড়ছিল যে, তিনি নাকি লেডি ডায়না ও মেজর হিউইটের সন্তান! এমন গুজব রটছিল বলেই মেজাজ হারিয়েছিলেন চার্লস। রসিকতার সুরে বলেছিলেন, ‘কে জানে আমি আদৌ তোমার বাবা কিনা? প্রিয় পুত্র, হয়তো তোমার বাবা ব্রডমুকে রয়েছে।’ এমন রসিকতাকে ‘বদ রসিকতা’ বলেই ব্যক্ত করেছেন তিনি।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে কাজ করার সময় ২০১২-১৩ সালে কিছুদিনের জন্য আফগানিস্তানে ফরোয়ার্ড এয়ার কন্ট্রোলার এবং পরে হেলিকপ্টার পাইলট ছিলেন। তার সদ্য প্রকাশিত বই ‘স্পেয়ার’-এ তিনি বলেছেন, তিনি ৬টি মিশনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং তার প্রতিটিতেই শত্রæপক্ষে নিহতের ঘটনা ঘটেছিল, তবে তিনি একে যথাযথ বলেই মনে করেন। বইতে তিনি লিখেছেন - ‘এটা এমন কোন পরিসংখ্যান নয় যা আমার মনকে গর্বে ভরিয়ে দেয়, কিন্তু তা আমাকে লজ্জিতও করেনি।’ ‘যুদ্ধের উত্তাপ ও বিভ্রান্তির মধ্যে আমি ওই ২৫ জনকে মানুষ বলে মনে করিনি। তারা ছিল দাবার বোর্ড থেকে সরিয়ে দেয়া গুটির মতো, কিছু খারাপ লোককে সরিয়ে দেয়া - যাতে তারা ভালো লোকদের হত্যা করতে না পারে।’ তবে সাবেক ব্রিটিশ সেনা অফিসার রিচার্ড কেম্প বিবিসিকে বলেছেন, প্রিন্স হ্যারির মন্তব্য ‘সুবিবেচনা-প্রসূত নয়।’ কেম্প আরো বলেন এর ফলে প্রিন্স হ্যারির নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হতে পারে এবং কাউকে এর প্রতিশোধ নিতে প্ররোচিত করতে পারে। কর্নেল কেম্প ২০০৩ সালে আফগানিস্তানে ব্রিটিশ বাহিনীর কমাÐার ছিলেন। তিনি বলেন, প্রিন্স হ্যারি যে তার হাতে নিহত শত্রæসৈন্যের সংখ্যা বলেছেন এতে তিনি কোন সমস্যা দেখছেন না কিন্তু তিনি যেভাবে তালেবানদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে বর্ণনা করেছেন তাতে মনে হতে পারে যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ‘মানুষের চেয়ে অধম কিছু বলে’ মনে করে। তিনি বলেন, ‘ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এভাবে লোকজনকে প্রশিক্ষণ দেয় না।’
তবে অন্য একজন এমপি - কনসারভেটিভ পার্টির এ্যাডাম হলোওয়ে - যিনি একসময় ব্রিটিশ বাহিনীর হয়ে ইরাকে যুদ্ধ করেছেন - তিনি এক নিবন্ধে লিখেছেন, কোন সৈনিক কতজনকে হত্যা করেছে তা প্রকাশ করা যথাযথ কাজ নয়। বিবিসির সাথে সাক্ষাতকারে একজন কর্মরত সৈনিক বলেছেন, প্রিন্স হ্যারির মন্তব্য মোটেও ‘সৈনিকসুলভ নয়।’ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাককে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন মন্তব্য করেননি। প্রিন্স হ্যারি তার বইয়ে আরো কিছু তথ্য প্রকাশ করেছেন যা নিয়ে ব্রিটিশ মিডিয়ায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। বইটিতে প্রিন্স হ্যারি লিখেছেন কীভাবে তিনি প্রথম কৌমার্য হারিয়েছিলেন। তিনি লেখেন, তার বয়স যখন ১৭ তখন তার চেয়ে বয়সে বড় একজন নারীর সাথে প্রথম যৌন অভিজ্ঞতা হয় তার। ঘটনাটি ঘটেছিল একটি ‘পাব’ বা পানশালার পেছনে মাঠের মধ্যে। হ্যারি লেখেন, এটা ছিল একটা ‘অবমাননাকর’ অভিজ্ঞতা, এবং মহিলাটি তাকে একটি ‘তরুণ ঘোড়ার মত’ ব্যবহার করেছিলেন।
হ্যারি লিখেছেন তার বয়স যখন ১৭ তখন কোন একজনের বাড়িতে তাকে কোকেন সেবন করতে দেয়া হয়েছিল। তা ছাড়া এর পরেও আরো কয়েকবার তিনি কোকেন নিয়েছেন বলে স্বীকার করেন, তবে বলেন যে ‘অভিজ্ঞতাটা তার ভালো লাগেনি।’ তিনি আরো লেখেন যে ইটন কলেজের ছাত্র থাকার সময় তিনি বাথরুমে ঢুকে গাঁজা খেয়েছেন। সেসময় ওই ভবনের বাইরে তার দেহরক্ষী হিসেবে কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তারা টহল দিচ্ছিলেন।
হ্যারি লিখেছেন - তিনি এবং উইলিয়াম মিলে তাদের পিতা - বর্তমান রাজা চার্লসকে - অনুরোধ করেছিলেন যেন তিনি বর্তমান কুইন কনসর্ট কামিলাকে বিয়ে না করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তার ভয় ছিল যে কামিলা হয়তো তাদের দুষ্ট সৎমায় পরিণত হবেন। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য সান রিপোর্ট করেছে যে রাজপরিবারে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেবার আগে তারা দুই ভাই আলাদাভাবে কামিলার সাথে বৈঠক করেছিলেন। হ্যারি আরো লিখেছেন, কামিলা যদি রাজা চার্লসকে সুখী করতে পারেন তাহলে তারা তাকে ক্ষমা করতে ইচ্ছুক ছিলেন।
গার্ডিয়ান সূত্রে আরও বেশ কিছু বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে। জানা গিয়েছে, একটি ফ্যান্সি ড্রেস অনুষ্ঠানে হ্যারিকে নাজিদের পোশাক পরতে বলেছিলেন উইলিয়াম ও কেট। এবার সামনে এল চার্লসের প্রসঙ্গও। বই প্রকাশের আগেই এত তথ্য কী করে ফাঁস হয়ে গেল, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। প্রকাশক সংস্থা পেঙ্গুইনের বিরুদ্ধে তদন্তও শুরু হবে। ইতোমধ্যে ব্রিটেনের বেসরকারি টিভি চ্যানেল আইটিভিকে দেয়া প্রিন্স হ্যারির একটি সাক্ষাৎকার প্রচারের আগে তার আগাম একটি ক্লিপে তাকে বলতে শোনা গেছে, মে মাসে রাজা চার্লসের অভিষেকে তিনি যোগ দেবেন কিনা সে বিষয়ে তিনি এখনই কথা দিতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘এখন এবং মে মাসের মধ্যে অনেক কিছুই ঘটতে পারে এবং বিষয়টা রাজ পরিবারের ওপর নির্ভর করছে’।
ডিউক অফ সাসেক্স প্রিন্স হ্যারির আত্মকথা প্রকাশিত হবে আগামী মঙ্গলবার। কিন্তু গার্ডিয়ান বলছে, তাদের ভাষায় ‘বই প্রকাশের আগে কঠোর নিরাপত্তার’ মধ্যেই তারা বইটির একটি আগাম কপি সংগ্রহ করেছে। তবে বিবিসি নিউজ এখনও ‘স্পেয়ার’-এর কপি হাত পায়নি।
গার্ডিয়ান বলছে, বইটিতে বলা হয়েছে ২০১৯ সালে প্রিন্স উইলিয়াম তার বাসায় প্রিন্স হ্যারির কাছে একটি মন্তব্য করলে এই বিতÐার সূত্রপাত হয়। পত্রিকা লিখছে, বইয়ে প্রিন্স হ্যারি লিখেছেন যে তার ভাই মেগান মার্কেলের সঙ্গে তার বিয়ের সমালোচনা করেন এবং প্রিন্স হ্যারি মেগান মার্কেলকে ‘জটিল’, ‘অভদ্র’ এবং ‘রুক্ষ’ বলে বর্ণনা করেন। বলা হচ্ছে, ডিউক অফ সাসেক্স লিখেছেন, দুভাইয়ের মধ্যে দ্ব›দ্ব বাড়লে তার বড় ভাই প্রাসাদের ‘প্রচার বিভাগের কথাগুলোই তোতা পাখির বুলির মত আওড়ান’। প্রিন্স হ্যারিকে উদ্ধৃত করে পত্রিকা জানাচ্ছে ওই দিনের ঘটনায় এরপর যা যা ঘটেছিল, যার মধ্যে ছিল শারীরিকভাবে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা। ‘ও পানির গøাসটা রাখল, তারপর আমাকে আরেকটা গালি দিল, তারপর আমার দিকে এগিয়ে এল। সবকিছু খুব দ্রæত ঘটে গেল, অতি দ্রæত। ও আমার জামার কলার চেপে ধরল, আমার গলার হারটা ছিঁড়ে ফেলল, তারপর আমাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল’।
‘কুকুরের খাবারের জন্য মেঝেতে যে বাটি রাখা ছিল, আমি তার ওপর পড়ে গেলাম। বাটিটা আমার শরীরের নিচে ভেঙে গেল। ভাঙা টুকরোগুলো আমার শরীরে ফুটছিল। এক মুহ‚র্তের জন্য আমি সেখানে পড়ে রইলাম। আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর আমি উঠে দাঁড়ালাম। ওকে বললাম দূর হও’। এ ঘটনা পরিবারের মধ্যে কলহের একটা নিরানন্দ চিত্র তুলে ধরেছে। যে কলহ ব্রিটিশ রাজ পরিবারের একেবারে কেন্দ্রে এবং যেখানে আপোষের কোন ইঙ্গিত নেই।
পত্রিকায় এ কাহিনিটি লিখেছেন আমেরিকায় গার্ডিয়ান পত্রিকার ওয়েবসাইটের সাংবাদিক মার্টিন পেনগিলি। তিনি বলছেন, তিনি প্রিন্স উইলিয়ামের যোগাযোগ দফতরের সাথে এ নিয়ে কথা বলেননি। সংবাদদাতা বলেছেন তার নিবন্ধটি ‘হ্যারির বই নিয়ে প্রতিবেদন, যে বইটি হ্যারি লিখেছেন- যে বইয়ের বক্তব্য হ্যারির দেয়া ঘটনার বিবরণ’। পেনগিলি বিবিসির রেডিও ফাইভ লাইভ অনুষ্ঠানে বলেন: ‘এ ঘটনার খবর রিপোর্ট করতে গিয়ে আমরা খুবই সাবধানতার সাথে এটাকে লড়াই বলিনি, কারণে হ্যারি বলেছেন, তিনি শারীরিকভাবে কোনো সঙ্ঘাতে যাননি’। প্রিন্স হ্যারি তার বইয়ে লিখেছেন, তার ভাই তাকে বলেছিলেন, তুমিও আমাকে পাল্টা আঘাত করো, কিন্তু তিনি তা করতে অস্বীকার করেন - লিখেছে গার্ডিয়ান পত্রিকা এবং হ্যারিকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, প্রিন্স উইলিয়ামকে পরে ‘অনুতপ্ত দেখায় এবং তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন’।
বিভিন্ন ছবিতে দেখা গেছে, প্রিন্স হ্যারি সবসময় গাঢ় রং-এর একটি মালা গলায় পরতেন, যা দেখা গেছে ইনভিক্টাস গেমসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় এবং এমনকি ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে তিনি যখন মেগানকে নিয়ে বিদেশ সফর করেন তখনও তার গলায় এ হার ছিল।
প্রিন্স হ্যারির বইয়ের প্রকাশক পেঙ্গুইন র্যানডম হাউস এখনও নিশ্চিত করেনি যে ফাঁস হওয়া এ বিবরণ হ্যারির আত্মকথা ‘স্পেয়ারের’ প্রকৃত অংশবিশেষ কিনা। তবে প্রিন্স হ্যারি তার ভাইয়ের সাথে তার কঠিন সম্পর্ক নিয়ে স¤প্রতি কথাবার্তা বলেছেন। ‘বাবা ও ভাইকে ফিরে পেতে চাই’ : হ্যারি এবং মেগান দম্পতিকে নিয়ে নেটফ্লিক্সের তথ্যচিত্রে প্রিন্স হ্যারি তার ভাই এবং তার বাবা, বর্তমান রাজার সাথে তার সাক্ষাতের বর্ণনাও দিয়েছেন। তাদের মধ্যে ওই বৈঠক হয়েছিল ২০২০-এর গোড়ায়, যে বৈঠকে ছিলেন প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথও। প্রিন্স হ্যারি সেটাকে ‘বুক দুরদুর করা’ বৈঠক বলে বর্ণনা করেন।
‘আমার ভাই আমার ওপর প্রচÐ চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল এবং বাবা এমন সব কথা বলছিলেন যেগুলো আদৌ সত্যি নয় আর আমার দাদী সেখানে চুপ করে বসেছিলেন এবং মনে হচ্ছিল তিনি সব গলধঃকরণ করছেন’ তিনি বলেন। গার্ডিয়ান বলছে, এপ্রিল ২০২০-এ দাদা প্রিন্স ফিলিপের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পর সেসময় প্রিন্স অফ ওয়েলস, তার পিতা চার্লস ও ভাই প্রিন্স উইলিয়ামের সাথে বৈঠকের বিস্তারিত জানান প্রিন্স হ্যারি। প্রিন্স হ্যারির আত্মকথা ‘স্পেয়ার’ প্রকাশের আগে আইটিভি টিভি চ্যানেলে দেয়া প্রিন্স হ্যারির একটি পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার প্রচারিত হবে আগামীকাল। এ সাক্ষাৎকারে প্রিন্স হ্যারি বলেছেন, ‘আমি আমার বাবাকে আগের মতো ফিরে পেতে চাই, আমি আমার ভাইকেও ফিরে পেতে চাই’। কিন্তু আইটিভির সাংবাদিক টম ব্রেডিকে প্রিন্স হ্যারি বলেন, ‘কিন্তু আপোষের কোনোরকম লক্ষণই তারা দেখাচ্ছেন না’। তবে এ প্রসঙ্গে কার কথা হ্যারি বলেছেন তা স্পষ্ট নয়। বাকিংহাম প্রাসাদ এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেনি। সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি নিউজ, ডেইলি মেইল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন