হাড়কাঁপানো শীতে উত্তরাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। গতকাল সকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয় চুয়াডাঙ্গায়। এদিকে শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় পঞ্চগড়, রাজশাহী, যশোর, শেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মৌলভীবাজার, ফরিদপুরসহ উত্তরের জেলাগুলোর জনজীবন অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষেরা।
রাজশাহী ব্যুরো জানান, রাজশাহীতে মৃদ্যু শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে তাপমাত্রা আরও কমেছে। গতকাল ভোরে মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত কয়েকদিনের তুলনায় এদিন বেড়েছে শীতের তীব্রতা। বেশ কিছুদিন থেকে উত্তরের এ জেলায় শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তবে এই শৈত্যপ্রবাহ আরও কয়েকদিন থাকবে বলে জানিয়ে আবহাওয়া অফিস। রাজশাহী আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যাওয়ায় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। গত ১৬ ডিসেম্বর রাজশাহীতে ৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর এখানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ৩১ ডিসেম্বর রেকর্ড করা হয় ১১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমন শীতে বেকায়দায় পড়েছেন ছিন্নমূল মানুষ। কাজের সন্ধানে সকাল সকাল ঘর থেকে বের হওয়া মানুষগুলোও ভোগান্তিতে পড়েছেন। সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক লতিফা হেলেন বলেন, আপাতত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি মাসে তিনটি শৈত্যপ্রবাহ রয়েছে।
পঞ্চগড় জেলা সংবাদদাতা জানান, পঞ্চগড়ে হিমালয়ের হিম বাতাস, উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বয়ে আসায় ঠান্ডায় কাঁপছে মানুষসহ পশু-পাখি। গত তিনদিন ধরে চলছে মৃদু শৈত প্রবাহ। হিমেল হাওয়া আর কুয়াশায় জনজীবনে নেমে এসেছে স্থবিরতা। আবহাওয়া অফিস বলছে, আরো কয়েকদিন অপরিবর্তিত থাকতে পারে। তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যেবক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রাসেল শাহ্ জানান, টানা তিনদিন ধরে জেলায় মৃদু শৈত্য প্রবাহ চলছে। গত শনিবার সকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঠান্ডার প্রকোপ আরো কয়েক দিন থাকতে পারে জানান এই কর্মকর্তা। জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শৈত্যপ্রবাহ, হিম বাতাস আর তীব্র শীতে অতি প্রয়োজন ছাড়া সকালে ঘর থেকে খুব কম সংখ্যক মানুষ বের হয়। রাতভর টুপটাপ শব্দে বৃষ্টির মতো ঝরেছে কুয়াশা। অনেকে খড়খুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারনের চেষ্টা করছে। পুরান গরম কাপড়ের দোকানে ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। শীত উপেক্ষা করে কাজে বেড়িয়েছেন শ্রমজীবী মানুষেরা। শীতে শিশু ও বৃদ্ধ রোগীর চাপ বাড়ছে হাসপাতাল গুলোতে। যদিও শীতে ঘর থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। আয় কমেছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের।
চুয়াডাঙ্গা জেলা সংবাদদাতা জানান, প্রচন্ড শীতে গোটা চুয়াডাঙ্গা জেলা এলোমেলো হয়ে পড়েছে। শীত ও কুয়াশাচ্ছন্ন জেলার মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। বেলা বাড়লেও সূর্যের দেখা মিলছেনা। স্বাভাবিক কর্মজীবন হয়ে পড়েছে দুর্বিষহ। নিউমোনিয়ায় শিশু ও বৃদ্ধসহ ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রকিবুল হাসান জানান, এ জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড থাকায় প্রচন্ড শীত অনুভূত হচ্ছে। জেলা ব্যাপী শৈত্য প্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল সকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। বাতাসের আর্দ্রতা ছিলো ৯৫ শতাংশ। দৃষ্টি সীমা ৫০০ মিটার। এর আগে গত শুক্রবার সকাল ৬টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিলো। ওই সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিলো ৯৭ শতাংশ। গত ২০ দিন থেকে এ জেলায় ক্রমাগত তাপমাত্রা কমছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া থাকায় সূর্যের দেখা মিলছেনা। দিনে শীত কম হলেও রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা কমে হাঁড় কাঁপানো শীত অনূভূত হচ্ছে। এর ফলে জনজীবনে দূর্ভোগ বাড়ছে। এ আবহাওয়া আরো কয়েক দিন অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।
ফরিদপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, ফরিদপুরের ওপর দিয়ে হঠাৎ মৃদু শৈত্য প্রবাহ বইতে শুরু করেছে। গতকাল শনিবার ভোর থেকে এ মৃদু শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে বলে জানায় ফরিদপুর আবহাওয়া অফিস জানান। ফরিদপুরে মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রী দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। শীতে কাঁপছে বৃহত্তর ফরিদপুরের ৫ জেলায়। বেশ কয়েকদিন ধরে বয়ে যাওয়া ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ফরিদপুরের জনজীবন। কনকনে শীত ঠান্ডা আর কুয়াশার দাপটে বিপাকে পড়েছেন এ জেলার ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র মানুষ সহ হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী। দুপুর পর্যন্ত কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকছে পথ-ঘাট। এতে করে কাহিল হয়ে পড়েছে খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষজন। তারা খড়কুঁটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। একই সাথে হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় সকালে রাস্তাঘাট থাকছে তূলনামূলক ফাঁকা। প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না মানুষ। পর্যাপ্ত গরম কাপড়ের অভাবে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন এ জেলার হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষ। ফরিদপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান গণমাধ্যম কে বলেন, শনিবার সকালে ফরিদপুরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
মৌলভীবাজার জেলা সংবাদদাতা জানান, তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল (সদর) হাসপাতালে দেখা দিয়েছে ঠাণ্ডাজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব এবং এর মধ্যে বেশিরভাগই আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ শীতজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। গত কয়েকদিনের শীতের তীব্রতায় নাজেহাল মানুষ। হাসপাতালের আন্তঃ ও বহির্বিভাগে ঠাণ্ডার প্রকোপে বিভিন্ন বয়সী রোগীর চাপ বেড়েছে। ঘন কুয়াশা আর কনকনে ঠাণ্ডার প্রকোপে শিশুরা ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টসহ শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে আসছেন জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে। তবে নির্দিষ্ট পরিমাণে বেডের বিপরীতে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকেই। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন রোগীর স্বজনরা। তাদের অভিযোগ, বিনামূল্য ওষুধ দেওয়ার কথা থাকলেও হাসপাতালের বাহির থেকেই কিনতে হচ্ছে বেশিরভাগ ওষুধ। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিক চিকিৎসাসহ প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ ডায়রিয়া ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত শিশু ভর্তি হচ্ছে। প্রতিদিনই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। শীত মৌসুম শুরুর পর থেকেই হাসপাতালে বাড়তে শুরু করে রোগীদের চাপ।
বেলকুচি (সিরাজগঞ্জ) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে কনকনে ঠান্ডা দিনভর ঘন কুয়াশায় সূর্যের দেখা মিলছে না বেশিরভাগ জায়গায়। তীব্র শৈত্যপ্রবাহে ভোগান্তিতে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ ফুটপাতের দোকানই তাদের ভরসা। কনকনে শীত থেকে বাঁচতে ফুটপাতের দোকানগুলোতে ভিড় জমাচ্ছেন তারা। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বেলকুচি মুকুন্দগাতী বাজার এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, শীতের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুটপাতের পুরনো কাপড়ের দোকানগুলোতে গরম পোশাক বিক্রির হিড়িক পড়ে গেছে। মাথার টুপি, পায়ের মোজা, হাতমোজা, মাফলার, সোয়েটার, জাম্পার, ফুলহাতা গেঞ্জি, ক্রেতাদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। পণ্য ভেদে এগুলোর দাম ১০০ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত হাঁকা হচ্ছে।
ঝিনাইগাতী (শেরপুর) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, সীমান্তবর্তী জেলা শেরপুরের ৫ উপজেলায় পৌষের শেষ ভাগে শীত জেঁকে বসায় জীবনযাত্রা জবুথবু হয়ে পড়েছে। হিমেল হাওয়ায় শীতের তীব্রতা বাড়ছে। ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ছে চারপাশ। কোনো কোনো দিন প্রায় সারাদিনই সূর্যের দেখা মিলছে না। বিশেষ করে চরাঞ্চল ও গারো পাহাড়ে শীতের তীব্রতা আরো বেশি। রাতে এবং ভোরে বৃষ্টির মতো ঝরছে শিশির। কুয়াশায় দৃশ্যমানতায় সড়ক ও মহাসড়কে যানবাহন চলছে ধীরগতিতে। জেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ি এলাকা ও চরাঞ্চলের মানুষ শীতে সীমাহীন কষ্ট পাচ্ছেন। কনকনে হিমেল হাওয়ায় শীতে নিম্নআয়ের খেটে খাওয়া ছিন্নমূল মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। অনেকে শীত উপেক্ষা করে কাজের সন্ধানে বের হলেও কাজ পাচ্ছেন না। গরিব, অসহায়, ছিন্নমূল শ্রমজীবী মানুষ খড়কুটো ও আবর্জনায় আগুনে শীত নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। শীতের কারণে ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগ-বালাই বেড়ে গেছে। বেড়েছে পুরনো গরম কাপড়ের কদর। আর তাই রাস্তার পাশের ফুটপাতের গরম কাপড়ের দোকানগুলোতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ভিড় বেড়েছে। ঝিনাইগাতী উপজেলা ইউএনও মো. ফারুক আল মাসুদ বলেন, সরকারি বরাদ্দকৃত কম্বল চেয়ারম্যানদের বন্টন করে দেয়ার পরও আমি রাতে ঘুরে ঘুরে অতিদরিদ্র শীতার্থ মানুষদের বাড়ি বাড়ি কম্বল বিতরণ করে আসছি। আমরা উপজেলা প্রশাসন সব সময়ই শীতার্থদের পাশে ছিলাম-আছি-থাকবো ইনশাআল্লাহ।
কেশবপুর (যশোর) উপেজেলা সংবাদদাতা জানান, শীতার্তদের মাঝে গভীর রাতে কম্বল বিতরণ করেছেন কেশবপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম আরাফাত হোসেন। উষ্ণতার ছোঁয়া পেল অসহায় হতদরিদ্ররা।
গত শুক্রবার রাতে উপজেলার মনোহরনগর, বাগডাঙ্গা, মাদারডাঙ্গা, ঈমাননগর, রাজনগর বাঁকাবর্শী, বেলকাটি ও নেপাকাটি গ্রামের ২০০ জন হতদরিদ্র বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, নারী, পুরুষ ও শিশুদের মধ্যে তিনি ২ শত কম্বল বিতরণ করেন। কম্বল পেয়ে হাসি ফুটে ওঠে হতদরিদ্র নারী-পুরুষের চোখে-মুখে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সজীব সাহা, উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের ইনস্ট্রাক্টর রবিউল ইসলাম, সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আনিসুর রহমান ও সাহিদুল ইসলাম, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিস সহায়ক ফারুকুজ্জামান প্রমূখ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন