দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর দিয়ে বইছে শৈত্যপ্রবাহ। ঢাকায় শৈত্যপ্রবাহ না থাকলেও দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে যাওয়ায় শীতের তীব্রতা বেশি অনুভূত হচ্ছে। রাজধানীতে জেঁকে বসেছে শীত। দু’দিনের ব্যবধানে রাজধানীতে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ফারাক নেমেছে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকাতেও তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। হাড় কাঁপানো শীতে কষ্ট হচ্ছে ভাসমান নাগরিকদের। শীতবস্ত্র না থাকায় বিকল্প উপায়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন তারা। কর্মজীবী মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়ে গেছেন। আবহাওয়া অফিস বলছে, কুয়াশা কমলেও দেশজুড়ে শীতের তীব্রতা থাকবে মাসজুড়ে। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী গত দুই দিনের তুলনায় গতকাল শনিবার অনেক কমে গেছে তাপমাত্রা। গতকাল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৮ দশমিক ৪। একই সঙ্গে ঢাকায় মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমে এসেছিল ১১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে গত বৃহস্পতিবার ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে আগামী আরো বেশ কয়েক দিন শীতের এই তীব্রতা থাকার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
সরকারি ছুটির দিন গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর আকাশে ছিল না সূর্য। অতঃপর বেলায় সূর্য ওঠায় কিছুটা তাপমাত্রা বাড়লেও দুপুরের পর আলো কমে আসায় তাপমাত্রা কমতে শুরু করে। এরপর রাতের তাপমাত্রা কমার পাশাপাশি কনকনে বাতাসে কাঁপন ধরে যায়। এই অবস্থায় সূর্য দেখা না যাওয়ায় আজকের তাপমাত্রা আরো কমে গেছে। এতে সকাল থেকেই শীতের তীব্রতা যেমন বেশি, তেমনি কনকনে বাতাস যেন গায়ে হুল ফোটায়। গতকাল ছিল সরকারি ছুটির দিন। তবে ঘণকুয়াশার মধ্যে সকালে অফিসে এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তথা কর্মজীবী মানুষ যারা বের হয়েছেন তাদের সকলকে গরম কাপড় পড়ে বের হতে হয়েছে। কাউকে কাউকে দেখা গেছে পা থেকে মাথা গরম কাপড়ে মুড়িয়ে বের হয়েছেন। বেশির ভাগ রিকশা যাত্রীদের দেখা যায় মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত শীতের কাপড়ে মুড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়েছেন।
শীতে বেশি কষ্টে পড়েছেন বৃদ্ধরা। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত পরিবারের বৃদ্ধ ও শিশুদের এই শীতে রোগ দেখা দিয়েছে। যাদের এ্যাজমা আছে, কোল্ড এলার্জি আছে, তাদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেড়ে গেছে। এদিকে শীতজনিত রোগের কারণে হাসপাতালেও রোগী বাড়ছে। বিশেষ করে ডায়রিয়াজনিত অসুস্থতার কথা বেশি বলে জানা গেছে।
মধ্যবয়সি নারী ইয়াসমিন আক্তার। ঘর নেই, শীতের রাতে বিছানা পেতেছেন ফুটপাতে। গত ৭ বছর ধরে রাজধানীর খামারবাড়ি সড়কের ফুটপাতেই তার বসবাস। সঙ্গে একমাত্র ছেলে আরিফ। ভাসমান জীবনযাপনে অনেক সময় না খেয়েই রাত পার করতে হয় তাকে। কনকনে ঠান্ডা অসহায় এই নারীর কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে। তীব্র শীত থেকে বাঁচতে শরীরে গামছা পেচিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে জবুথবু অবস্থাায় রাত্রিযাপন করছেন সড়কে পাশে। মাঝে মাঝে হিমেল ঠান্ডা হাওয়া তাদের শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়।
রাতে কমলাপুর ফুটপাতে কাটানো আবদুর রহিম মিয়ার গল্পও একই রকম। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ঢাকার ফুটপাতে তার বসবাস। তীব্র শীত বাড়তি কষ্ট বয়ে এনেছে তার।
ইয়াসমিন-আবদুর রহিমদের মতো এমন হাজারো ভাসমান মানুষ শীতের রাত পার করছেন নিদারুণ কষ্টে। ফুটপাতই তাদের সংসার, ঘরবাড়ি। এই দুর্ভোগের খবরও রাখে না কেউ।
কমলাপুর স্টেশনে দেখা গেল ঘনকুয়াশার মধ্যেই ফুটপাতে লাইন ধরে ঘুমিয়ে রয়েছেন কয়েকজন আদম সন্তান। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারোই শীতের কাপড় নেই। দুই-তিন বছর আগে শীতের কাপড় পেলেও এবার পাননি। কেউ খোঁজও নেয়নি। গরমে কোনো রকম জীবন কাটলেও খোলা আকাশের নিচে থাকা এসব ছিন্নমূল মানুষের কাছে শীতে মহাকষ্টে পড়ে গেছেন। ভাসমান এসব মানুষের জন্য সবার একটাই চাওয়া রাষ্ট্র ও বিত্তশালীরা এগিয়ে আসুক সহায়তা নিয়ে।
জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন, আগামী বেশ কয়েক দিন এই তাপমাত্রা অব্যাহত থাকতে পারে। যদি সূর্যের তাপ পাওয়া না যায়, তাহলে শৈত্যপ্রবাহের এলাকাও বিস্তার লাভ করতে পারে।
শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজধানীতে ঠান্ডাজনিত রোগ বেড়ে গেছে। শিশুরা নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর, সর্দিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল, মিডফোর্ড হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, মাতুয়াইল মা ও শিশু হাসপাতালসহ রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। প্রতিদিন শত শত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় শীতজনিত রোগীর সংখ্যা এখন তিন থেকে চার গুন বেশি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনটি ভবনে রোগীর ধারণক্ষমতা ২৬শ। অথচ বর্তমানে চার হাজারের মতো রোগী ভর্তি হয়েছে। রোগীকে শয্যা দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ঢামেকের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায় কোথাও শয্যা খালি নেই। নিরুপায় হয়ে রোগীরা প্রচণ্ড শীতেও মেঝেতে থাকছেন। একই দৃশ্য দেখা গেছে শিশু হাসপাতালেও।
জানতে চাইলে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, তীব্র শীতের সময় শিশু ও বৃদ্ধের জন্য বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে। এ সময় শ্বাসতন্ত্রীয় রোগগুলো বেড়ে যায়। নিউমোনিয়ার মতো প্রাণঘাতী অসুখ হওয়ার শঙ্কা দেখা যায়। ফলে এই বয়সিদের ঠান্ডা থেকে দূরে রাখা জরুরি। গরম জামাকাপড়ের পাশাপাশি গোসলের সময় গরম পানি ব্যবহার ও শিশুরা যাতে আবার বাড়তি কাপড়ে ঘেমে না যায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বাইরে যাওয়ার সময় কান-মাথা ঢেকে রাখতে হবে।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য : দেশের নওগাঁ, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলগুলোর ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৮ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ছাড়া ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেছে দেশের সব অঞ্চলের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এদিকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও কমেছে অনেক। সবচেয়ে কম সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল কুমিল্লায় ১৬ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অফিস জানায়, ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে আছে ১৫ অঞ্চলের তাপমাত্রা। এর মধ্যে তেঁতুলিয়ায় ৯ দশমিক ৬, বদলগাছিতে ৯ দশমিক ৮, যশোর ও দিনাজপুরে ১০, সাতক্ষীরায় ১০ দশমিক ২, ঈশ্বরদীতে ১০ দশমিক ৪, সৈয়দপুরে ১০ দশমিক ৫, রাজশাহী, কুমারখালী ও ডিমলায় ১০ দশমিক ৬, বরিশাল ও বগুড়ায় ১০ দশমিক ৭, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরে ১০ দশমিক ৮, নিকলিতে ১০ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১৭ আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদফতর থেকে কুয়াশার বিষয়ে বলা হয়, মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারা দেশে মাঝারি থেকে ঘনকুয়াশা পড়তে পারে এবং এটি দেশের কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
তাপমাত্রার বিষয়ে বলা হয়, সারা দেশে রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে। দিন ও রাতের তাপমাত্রা পার্থক্য কমে যাওয়ার কারণে দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং মধ্যাঞ্চলে মাঝারি থেকে তীব্র শীতের অনুভূতি থাকতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন