ডলার সঙ্কটে এলসি (ঋণপত্র) খোলার হার কমেছে। তাতে কমে গেছে ভোগ্যপণ্যের আমদানি। এর ফলে আসন্ন পবিত্র মাহে রমজানে অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি এবং সেই সাথে মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, খেজুর গুঁড়ো দুধসহ ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখতে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব পণ্যের আমদানিতে ব্যাংকগুলোকে ঋণপত্র খোলা সহজতর করার নির্দেশনা দিয়েছে। রমজান মাসে ভোগ্যপণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিতকল্পে আমদানি এলসি স্থাপনের ক্ষেত্রে (এলসি মার্জিন) ছাড়ের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
তবে এ নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে অভিযোগ আমদানিকারকদের। তারা বলছেন, কিছু বড় আমদানিকারক ওই সুবিধা পাচ্ছেন। বাকিদের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ডলার সঙ্কটের অজুহাতে এলসি খুলতে গড়িমসি করেই চলেছে। এর ফলে ভোগ্যপণ্যের আমদানি, সরবরাহ ও বাজার নিয়ন্ত্রণ একটি গোষ্ঠীর হাতে পুঞ্জিভূত হতে চলেছে। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সব আমদানিকারক সমান সুযোগ না পেলে আগামী রমজানে ভোগ্যপণ্যের সঙ্কটের পাশাপাশি সিন্ডিকেটের কারসাজিতে মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা বেড়েই চলেছে। কোভিড মহামারি পরবর্তী বৈশি^ক পুনরুদ্ধার কর্মসূচি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। তাতে দেশে ডলার সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার কম প্রয়োজনীয় এবং বিলাসী পণ্যের আমদানির লাগাম টেনে ধরে। মূলত সেই থেকে আমদানি নিম্নমুখী হতে শুরু করে। গত অক্টোবর থেকে ধারাবাহিকভাবে এলসি খোলার হার কমতে থাকে। অক্টোবরে ৪৭৪ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়। নভেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ৪০২ কোটি ডলারে। অক্টোবরে এলসি খোলার হার কমে আসার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ডিসেম্বরে।
ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি হয়েছে ৭১ লাখ টন। আগের বছরের একই মাসে আমদানির পরিমাণ ছিল ৮৬ লাখ টন। সেই হিসেবে আগের বছরের তুলনায় ডিসেম্বরে আমদানি কমে গেছে ১৭ শতাংশ। জানুয়ারি মাসে আমদানি আরও কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আমদানি কমে যাওয়ায় দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের আনাগোনা এবং সেইসাথে কর্মব্যস্ততাও কমে এসেছে। ক্রমাগতভাবে এলসি কমে যাওয়ার ফলে আমদানিও কমছে। এ অবস্থায় আগামী রমজান মাসে ভোগ্যপণ্যের ঘাটতির আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠছে।
দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও পাইকারি বাজার চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও আছদগঞ্জে ঘুরে দেখা গেছে, আগের মত সেখানে তেমন ব্যস্ততা নেই। আমদানিকারক, পাইকারি বিক্রেতা ও আড়তদাররা বলছেন, অন্য সময় রমজানের প্রায় তিন মাস আগ থেকে এসব পাইকারি বাজারে বেচাকেনা জমে উঠতে শুরু করে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাক, পিকআপ ও বড় নৌকা নিয়ে ব্যবসায়ীরা ভোগ্যপণ্য কিনতে আসেন। আমদানি কম থাকায় এবার কেনাবেচা এখনো জমে উঠেনি। ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ কম হওয়ায় দামও এখন বেশ চড়া। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া ভোগ্যপণ্যের বিরাট অংশ এসব পাইকারি বাজারের মাধ্যমে সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। দেশের মোট ভোগ্যপণ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ সরবরাহ হয় চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও আছদগঞ্জ থেকে। বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে আসা পেঁয়াজ, মরিচ, মসলাও সরবরাহ হয় এখান থেকে। রমজান আসলেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেচাকেনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
আমদানিকারকেরা বলছেন, ব্যাংকগুলো ডলার সঙ্কটের কথা বলে এলসি খুলতে গড়িমসি করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে রমজানে অতি প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যসহ ১৭ ধরনের অত্যাবশ্যকীয় পণ্যসামগ্রী আমদানিতে এলসি মার্জিন ছাড় দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু এ নির্দেশনা বেশিরভাগ ব্যাংক মানছে না। বিশেষ করে ছোট আমদানিকারকদের এলসি খোলার ক্ষেত্রে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। তবে বড় আমদানিকারকেরা এলসি খুলতে পারছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পর মূলত ডিসেম্বরের শেষদিকে এসে এলসির হার বাড়তে থাকে। সাধারণত এলসি খোলার পর এক থেকে দুই মাসের মধ্যে পণ্য আমদানি শুরু হয়। এ অবস্থায় রোজার আগে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেসার্স আল-মদিনার সত্বাধিকারী ও চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ স্টকিষ্ট ট্রেড এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ জাহেদী ইনকিলাবকে বলেন, ডলার সঙ্কটের কারণে ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার হার কমে গেছে। এর ফলে আমদানিও কম হয়েছে। এ কারণে আগামী রমজানে পণ্যের সঙ্কট হতে পারে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে এখন এলসি খোলার হার কিছুটা বাড়ছে। এর ফলে দ্রুত আমদানি হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে। আর তা না হলে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে, এতে পবিত্র রমজানে দুর্ভোগ বাড়বে। ডলারের দাম কমে যাওয়ায় বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল হয়ে আছে বলে জানান তিনি।
মেসার্স হক ট্রেডিংয়ের মালিক মো. আজিজুল হক বলেন, বাজারে পণ্যের সরবরাহ ধীরে ধীরে বাড়ছে। ছোলা, খেজুর, ডালসহ রোজায় নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের জোগান স্বাভাবিক হয়ে আসছে। কারণ গত বছর রোজার আগে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি হয়। রমজানের এখনো প্রায় তিন মাস বাকি উল্লেখ করে তিনি বলেন, মূলত রোজার এক মাস আগেই বাজার জমজমাট হয়। খুচরা বিক্রেতারা পণ্য কিনে নেন। সে হিসেবে এখনো প্রায় দুই মাস সময় রয়েছে। এর মধ্যে আমদানি স্বাভাবিক হয়ে আসলে রোজায় সঙ্কট থাকবে না বলে জানান তিনি।
আগামী ২৩ মার্চ থেকে শুরু হতে পারে পবিত্র মাহে রমজান। রোজায় চাহিদা বাড়ে এমন পণ্যের সরবরাহ এবং দাম স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চলছে সরকারি তরফে। বিশেষ করে চিনি, ভোজ্যতেল, ছোলা, পেঁয়াজ, ডাল, খেজুর, মসলা ও গুঁড়ো দুধের বাজার যাতে স্বাভাবিক থাকে সে ব্যাপারে বাজার তদারকি শুরু হচ্ছে। গত ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক রমজানে ভোগ্যপণ্য আমদানির এলসি মার্জিন ছাড় দেয়ার নির্দেশনা জারি করে। এ সংক্রান্ত সার্কুলারে বলা হয়, আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি এবং খেজুরের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখাসহ পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিতকল্পে উক্ত পণ্যসমূহের আমদানি ঋণপত্র স্থাপনের ক্ষেত্রে সংরক্ষিতব্য নগদ মার্জিনের হার ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হলো। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও এ নিয়ে দফায় দফায় ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের সাথে বৈঠক করেছে।
ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্যমতে, সারাদেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২১ লাখ টন। যার ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। তবে রোজার মাসে ভোজ্যতেলের চাহিদা চার লাখ টনের মত। আমদানিকারকেরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে থাকে। তার প্রভাব এখনো অব্যাহত আছে। একই অবস্থায় চিনির ক্ষেত্রেও। সারা বছরের জন্য ১৮ লাখ টন চিনির প্রয়োজন। এর মধ্যে তিন লাখ টনের চাহিদা থাকে কেবল রোজার মাসে। চিনির আমদানি ক্রমাগত কমছে। অক্টোবর মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে এক লাখ ৬৪ হাজার টন। আর ডিসেম্বর মাসে আমদানি হয়েছে মাত্র ৬৯ হাজার টন। সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারে চিনির দাম এখনো ঊর্ধ্বমুখী। সারাদেশে মসুর ডালের চাহিদা বছরে পাঁচ লাখ টন। আর রমজান মাসে এ চাহিদা থাকে ৮০ হাজার টনের মত। ডালের চাহিদা মেটাতে ৫০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। দেশে বছরে ছোলার চাহিদা ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টন। যার ৮০ শতাংশই ব্যবহার হয় রমজান মাসে। দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ টন। আর পাঁচ লাখ টন ব্যবহার হয় রমজানে।
এদিকে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমদানিতে এলসি খোলার ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও ডলার সঙ্কটের অজুহাতে এলসি খোলা যাচ্ছে না বলে ব্যবসায়ীরা যা বলছে তা অজুহাত। এ অজুহাতে তারা আসন্ন রমজানে কারসাজির মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধির চক্রান্ত করছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। সরকার বলছে ডলারের সঙ্কট নেই, এলসি খোলা যাচ্ছে। অথচ কিছু আমদানিকারক এলসি খোলা যাচ্ছে না বলে প্রচার করছে। এলসি খোলার ক্ষেত্রে সব আমদানিকারকদের সমান সুযোগ দেয়া বলে মনে করেন তিনি। রমজানে ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে এখন থেকেই কার্যকর বাজার মনিটরিং শুরু করার পরামর্শ দেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন