অনলাইনে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে ‘জিএইচ গ্রুপের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিষয়ে পৃথক অনুসন্ধান ও তদন্ত করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গতকাল মঙ্গলবার এ তথ্য জানিয়েছে সংস্থা দু’টির নির্ভরযোগ্য দুই সূত্র।
দুদকের একটি সূত্র জানায়, ইতোমধ্যেই সংস্থার অ্যানফোর্সমেন্ট টিম মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেছে। দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনের আলোকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রতারিত ও নিঃস্ব হওয়া ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলছে।
দুদক অ্যানফোর্সমেন্ট টিমের একজন সদস্য জানান, অ্যাপস ভিত্তিক প্রতারণা প্রতিষ্ঠান ‘জিএইচ গ্রুপের প্রতারণা শুধু পুরান ঢাকায়ই সীমাবদ্ধ নয়। গেন্ডারিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে প্রতারণার জাল বিস্তার করেছে রাজধানীর সদরঘাট, ইসলামপুর, চকবাজার, নয়াবাজার, মিরপুর, সাভার, গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জ এলাকায়। ঠিকানা ও অফিসবিহীন পরিবারভিত্তিক প্রতারণা প্রতিষ্ঠানটির গোপন কার্যক্রমের বিস্তারে সহায়তা করছেন আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীরই দুর্নীতিগ্রস্ত কতিপয় কর্মকর্তা। কথিত গ্রুপ অব কোম্পানি জিএইচ গ্রুপ যখনই কোনো বিপদে পড়ে তখনই ‘শেল্টার’ দেন এই কর্মকর্তারা। বিনিময়ে তারা নিচ্ছেন প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্নজনের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া অর্থের ভাগ। অভিন্ন অভিযোগ করেছেন প্রতারণার শিকার একাধিক ভুক্তভোগী। জিএইচ গ্রুপের মাস্তানবাহিনী, পুলিশী নির্যাতন, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির শিকার হওয়ার ভয়ে অধিকাংশ ভুক্তভোগীর মুখ বন্ধ। এর মধ্যেও গত ২ জানুয়ারি দৈনিক ইনকিলাবে ‘জিএইচ গ্রুপ হাতিয়েছে শত শত কোটি টাকা, মা-ছেলের এমএলএম প্রতারণায় নিঃস্ব ১৮০০ চাকরি প্রার্থী র্শীষ প্রতিবেদন প্রকাশের পর অনেক ভুক্তভোগী যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা ব্যক্ত করেন ভুইফোঁড় এ কোম্পানি দ্বারা প্রতারিত হওয়ার অভিজ্ঞতা।
প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরা জানান, অ্যাপসের মাধ্যমে প্রতারণার কাজে নিয়োজিত সাদী পরিবারের প্রতিটি সদস্য। তারা অত্যন্ত নিপূণ কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নেন। ‘জিএইচ গ্রুপ’ পরিচালনায় পরিবারের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে দায়-দায়িত্ব।
এর মধ্যে কথিত ‘জিএইচ গ্রুপের’ নিত্য-নতুন অ্যাপস তৈরির দায়িত্ব পালন করেন আইটি এক্সপার্ট মঞ্জুরুল হাসান সাদী। বাচনভঙ্গি ভালো হওয়ায় ‘ফোকাল পার্সন’ হিসেবে চাকরিপ্রার্থীদের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে জড়ো করে মোটিভেশনাল স্পিচও প্রদান করেন সাদী। তার মা নাহিদ আফসার ওরফে লাইজু বেগম অর্থ হাতিয়ে নেন তার পর্যায়ের নারী-পুরুষের কাছ থেকে। তার টার্গেট স্বল্পশিক্ষিত মধ্যবয়সি নারী, গৃহবধূ, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, স্কুলের গার্ডিয়ান, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দোকানি, হকার এমনকি হিজড়া সম্প্রদায়। ন্যূনতম সম্পর্কের সূত্র ধরেই তিনি প্রস্তাব দেন চাকরি দেয়ার। কথার জালে আটকে অনেকে লাইজু বেগমকে আস্থায় নেন সরলমতি নারীরা। ঘরে বসে দৈনিক আড়াই শ’ টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা রোজগারের চাকরির ফাঁদে ফেলে পরে তাদের কাছ থেকে চাকরির জামানত বাবদ হাতিয়ে নেন ৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। অভিযোগের বিষয়ে জানতে গতকাল সন্ধ্যায় লাইজু বেগমের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি সাড়া দেননি। নম্বরে সাদীর ছোট ভাই কামরুল হাসান ফারহাবি ব্যস্ত থাকেন টাকার হিসেবে বুঝে নেয়া, টাকা নিরাপদ জায়গায় সরানো, সংরক্ষণ তথা ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে। ফারহাবি পরিচিত ‘সেকেন্ড মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে।
প্রশাসন ম্যানেজ করা, স্থানীয় মাস্তানদের পক্ষে রাখা, প্রতারনার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া টাকা বিভিন্ন খাতে লগ্নি করেন ফারহাবি। স্বনামে-বেনামে করছেন বিপুল অবৈধ অর্থ সম্পদ। বসুন্ধরা সিটিতে একটি ‘বায়িং হাউজের সাইনবোর্ড লাগিয়ে নিজেকে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী বলেও পরিচয় দেন ফারহাবি। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মূলত তিনি বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, মঞ্জুরুল হাসান সাদীর আপন মামার একজন শ্যালক ও তার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব রয়েছে পুলিশের উচ্চপদে এবং পুলিশের অধীন একটি গোয়েন্দা শাখায়। কোনো ঝামেলায় পড়লে এই মামাগণ প্রতারক সাদী পরিবারের সদস্যদের শেল্টার দেন। বিনিময়ে তাদেরকেও দেয়া হয় প্রতারণার মাধ্যমে লব্ধ অর্থের ভাগ। পুরনো ঢাকার চকবাজার, বেগমবাজার, ইসলামপুরের অনেক ব্ল্যাক মার্কেটের কাপড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ফারহাবি লাখ লাখ টাকা নিয়েছেন। ইনকিলাব প্রতিবেদনের পর ইসলামপুরের দুই ব্যবসায়ীকে ফারহাবি ১৪ লাখ টাকা ফেরতও দেন। তারা আরো টাকা পাবেন বলে দাবি করেন। পাওনাদাররা টাকার জন্য চাপ দিলে কিছু টাকা ফেরত দিয়ে মুখ আপাতত বন্ধ করে রাখার কৌশল তার। মঞ্জুরুল হাসান সাদী তার স্ত্রী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজনের হেফাজতে জমা রাখেন নগদ কোটি কোটি টাকা। বাস্তব ব্যবস্থায় অনেক ক্ষেত্রে তিনি অন্তত ৮০ কোটি টাকা বেনামে বিনিয়োগও করেছেন। তবে সাদীর শ্বশুর বাড়ির সম্পর্কীয় কোনো আত্মীয়ের কাছ থেকে টাকা নেন না। হাত ঢোকান নি মাতুলালয়ের আত্মীয়দের পকেটেও। কারণ, বিপদে-আপদে তারাই এগিয়ে আসেন আগে। ঢাল হয়ে তারা সুরক্ষা দেন সাদী পরিবারকে। তবে পৈত্রিক সম্পর্কের কোনো আত্মীয়-স্বজনকে তিনি ছাড়েন নি। অনলাইনে চাকরি দেয়ার নাম করে প্রায় সবার কাছ থেকেই হাতিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। স্থানীয় পুলিশ বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করে। জানা গেছে, নিয়মিত বখড়া পান গেন্ডারিয়া থানা পুলিশের কয়েক সদস্য। ৪৫/১, কে. বি. রোডস্থ আফসারউদ্দিনের পুত্র মঞ্জুরুল হাসান সাদীর কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিষয়ে জানতে গেন্ডারিয়া থানার ওসি মাহবুবুর রহমানের অফিসিয়াল নম্বরে ফোন দিয়ে পাওয়া যায়নি। তবে থানার ইন্সপেক্টর (অপারেশন) প্রেম রায় বলেন, আমি নতুন এসেছি। তাছাড়া আমি ট্রেনিংয়ে ছিলাম। যোগদানের পর থেকেই ভিআইপি প্রটোকল নিয়ে ব্যস্ত। বিষয়টি আমার জানা নেই।
৩ সপ্তাহ চাকরির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে গেন্ডারিয়ার ভুক্তভোগী এক নারী বলেন, আমার কাছ থেকে ৭৫ হাজার টাকা চাকরির জামানত নিয়েছে জিএইচ গ্রুপ। অনলাইনে চাকরি বলতে তেমন কিছুই না। আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে জিএইচ গ্রুপের বিভিন্ন পোস্টে লাইক-কমেন্ট করতাম। প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন পোস্ট করতাম। ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপে জিএইচ গ্রুপের প্রমোশনাল ভিডিও ক্লিপ, বিজ্ঞাপন ফরোয়ার্ড করেছি। বিপরীতে প্রথম দিন আমাকে ‘পয়েন্ট’ ধরে ৭শ’ টাকা বেতন দেয়া হয়। পরদিন ৯ শ’, তার পরদিন ১১শ’ টাকা করে দেয়া হয়। পরে আমাকে আরো চাকরিপ্রার্থীকে জিএইচ গ্রুপের অনলাইন চাকরির সঙ্গে যুক্ত করতে উদ্বুদ্ধ করেন। আমি আরো ৬ জনকে নিয়ে আসি। তাদের কারও কাছ থেকে ৪০ হাজার, ৬২ হাজার, দেড় লাখ এবং এক লাখ টাকা করে চাকরির জামানত নেয়া হয়। আমাকে বলা হয়, নুতন যারা চাকরিতে যুক্ত হয়েছেন তারা যে বেতন পাবেন সেখান থেকে আমার অ্যাকাউন্টে ১০ পার্সেন্ট করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পয়েন্ট যুক্ত হচ্ছে। আমি কমিশন পাবো। তাদেরকেও আরো চাকরি প্রার্থী জোগাড় করতে বলেন সাদী। এভাবে আমার চ্যানেলেই অন্তত ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। আমি এখন বিপদে। যারা আমার পরিচয়ে এখানে জামানত রেখেছে তারা সাদী, তার ভাই কিংবা তার মাকে খুঁজে পায় না। ধরছে আমাকে। আমার নিজের টাকাই পাইনি। ওদের টাকা কিভাবে শোধ করি ? সাদী পরিবারের প্রতিটি সদস্য প্রতারক। মানুষের কাছ থেকে এভাবে তারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। যাতে আর কেউ ওদের খপ্পরে না পড়ে।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাফিজুর রহমান জানান, ‘জিএইচ গ্রুপ’ নামে কোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো লাইসেন্স দেয়া হয়নি। ফেসবুক, অনলাইন বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্যবসা করতে হলে সরকারি সনদ বা ডিবিআইডি থাকা বাধ্যতামূলক। ‘ডিজিটাল বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন’ (ডিবিআইডি)। এটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইস্যু করে। নীতিমালা চালুর পর থেকে এ যাবৎ ৪৫৭টি প্রতিষ্ঠানকে ডিবিআইডি দেয়া হয়েছে। আরো ৭৭টি আবেদন বিবেচনাধীন রয়েছে। এর মধ্যে এই নামের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রতারণা রোধের লক্ষ্যেই ডিবিআইডি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আর্থিক লেনদেনের আগে সতর্কতাস্বরূপ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে ভেরিফাই করে নিলে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
অ্যাপস খুলে চাকরি দেয়ার নাম করে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিষয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ‘ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম’ অনুবিভাগের প্রধান স্পেশাল সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ (এসপি) হুমায়ুন কবির গতকাল মঙ্গলবার এ প্রতিবেদককে বলেন, বেসরকারি পর্যায়ের প্রতারণা, অর্থপাচারের অধিকাংশ তদন্তই আমরা করছি। জিএইচ গ্রুপের বিষয়েও কার্যক্রম শুরু হয়েছে। একদিন সময় নিয়ে আসুন। বিস্তারিত আলাপ করবো।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, অভিযোগে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্থপাচারের মতো উপাদান রয়েছে। এটি দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ। আইনত এসব অপরাধীর সংশ্লিষ্টদের ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন