ইনকিলাব ডেস্ক : বার্লিনে লরি চালিয়ে হামলায় ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন ব্যক্তি আনিস আমরিকে ইটালির পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। শুক্রবার ভোর রাতে পুলিশ তাকে মিলান শহরে হত্যা করে। বলা হচ্ছে, নিয়মিত টহলের সময় একটি রেল স্টেশনের বাইরে থামায়। তারপর তাকে পরিচয়পত্র দেখাতে বলা হলে সে গুলি চালাতে শুরু করে। এ সময় সে ‘আল্লাহু আকবর’ বলেও চিৎকার করছিল বলে দাবি করা হচ্ছে। এতে একজন পুলিশ অফিসার আহত হয়েছেন। তখন পুলিশ পাল্টা গুলি ছুড়লে ওই ব্যক্তি নিহত হয়।
ইটালির সংবাদ মাধ্যমে বলা হচ্ছে, নিহত এই ব্যক্তির আঙুলের ছাপের সাথে সন্দেহভাজন হামলাকারী তিউনিসিয়ান আনিস আমরির আঙুলের ছাপ মিলে গেছে। জার্মান পুলিশ নিশ্চিত করেছে, লরির ভেতর থেকে আনিস আমরির আঙুলের চাপ সংগ্রহ করা হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় বার্লিনে চালানো ওই হামলায় ১২ জন নিহত হয়। আহত হয় আরো ৪৯ জন।
অন্য দিকে, আরো একটি বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনার সন্দেহে জার্মান পুলিশ ওবেরহাউজেন থেকে আরো দু’জনকে আটক করেছে।
প্রথমে পাকিস্তানি : এই হামলা চালানোর সন্দেহে জার্মান পুলিশ প্রথমে একজন পাকিস্তানি আশ্রয়প্রার্থীকে ঘটনাস্থলের কাছের একটি পার্ক থেকে আটক করেছিল। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ তার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে না পারায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে তদন্তকারী জার্মান কর্মকর্তারা তিউনিসিয়ান নাগরিক আনিস আমরির নাম ঘোষণা করেন সন্দেহভাজন প্রধান হামলাকারী হিসেবে।
বার্লিন ‘হামলাকারী’ আনিস আমরির কাহিনী ; লরির ভেতরে একটি সিটের নিচে পাওয়া একটি পরিচয়পত্র থেকে প্রথমে তার নাম জানা যায়। তারা আরো জানায়, সেখান থেকে তার আঙুলের ছাপও সংগ্রহ করা হয়েছে। চব্বিশ বছর বয়সী এই আনিস আমরির নাম আগে থেকেই ছিল জার্মান পুলিশের খাতায়। গত মার্চ মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সে বার্লিনে পুলিশের নজরদারিতেই ছিল। কিন্তু তার অপরাধের ব্যাপারে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ না থাকায় সেই নজরদারি উঠিয়ে নেয়া হয়।
ছয়টি নাম ছিল তার : পুলিশ জানায়, এর আগে আনিস আমরি অন্য নামও ব্যবহার করেছে। পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, আনিস আমির ইটালি থেকে জার্মানি এসেছে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে এবং ইটালিতে সে চার বছর জেলও খেটেছে। নর্থ-রাইন ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাল্ফ ইয়াগের জানিয়েছেন, হামলার পরিকল্পনা করার সন্দেহে সে ছিল পুলিশের তদন্তের অধীনে। তিনি জানান, পুলিশের সন্ত্রাসবিরোধী বিভাগের কর্মকর্তারা গত নভেম্বর মাসেও তার ব্যাপারে তথ্য বিনিময় করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সে বড় ধরনের সহিংসতার পরিকল্পনা করছে’।
তিউনিসিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই আনিস আমরির ব্যাপারে বিবিসিকে কিছু তথ্য দিয়েছেন। তবে বলেছেন, জার্মানির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তাদের কাছে কিছু জানতে চাওয়া হয়নি। তিউনিসিয়ায় নিরাপত্তা সূত্রগুলো বলছে, তার জন্ম তাতাউন শহরে। তারপর সে কাইরওয়ান শহরে চলে যায়।
পরিবারের বক্তব্য : তার এক ভাই ওয়ালিদ আমরি জানিয়েছেন, ছোটবেলায় আনিস একটি ফার্মে কাজ করত। ‘সে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যেতো, তারপর ঘুরে বেড়াত। সে নামাজ পড়ত না। তার কৈশোরকাল এখানেই কেটেছে। জার্মানির হামলার ঘটনায় তার জড়িত থাকার কথা শুনে আমরা হতভম্ব,’ বলেন তার ভাই। ওয়ালিদ আমরি জানান, তার ভাই যখন ইউরোপে ছিল, তখন তাদের মধ্যে ফোনে এবং সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে কথা হতো।
ওয়ালিদ আমরি বলেন, ‘আমি সবসময় জানতে চেয়েছি, সে কেমন আছে। সে বলতো ভালো আছে। তারপর সে সবার কথা জানতে চাইতো। বলতো সে ফিরে আসতে চায়। বলতো, ফিরে এসে একটি গাড়ি কিনে ব্যবসা শুরুর করার জন্যে সে নাকি পয়সা জমাচ্ছে’।
‘সেটাই ছিল তার স্বপ্ন। আমাদের ধারণা ছিল ও জানুয়ারি মাসে ফিরে আসবে। হামলার ১০ দিন আগেও আমি তার সাথে কথা বলেছি। আমি জানতে চেয়েছি, আনিস, তাহলে তুমি ফিরে আসছ? ও বলেছে, ইনশা আল্লাহ। সে তখন হাসছিল। আমার তো খারাপ কিছু মনে হয়নি’।
ইটালির জেলে : ইটালির কর্মকর্তারা বলছেন, আনিস আমরি ইটালিতে গিয়ে পৌঁছেছে ২০১১ সালে। আরব স্প্রিং আন্দোলনের সময় হাজার হাজার তরুণের সাথে সেও তিউনিসিয়া থেকে ইটালিতে পালিয়ে যায়। ওই বছরেই অক্টোবর মাসে একটি স্কুলে এবং শরণার্থী শিবিরের ভবনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ভাঙচুর এবং চুরি করার অপরাধে তার সাজাও হয়েছে। সে ছিল সিসিলির একটি কারাগারে। কারাগারের কাগজপত্রেও দেখা যায়, জেলের ভেতরেও তার আচরণ ভালো ছিল না। অন্য বন্দীদের সাথে সে খারাপ ব্যবহার করতো।
ইটালির কর্মকর্তারা জানান, ২০১৫ সালে সাজা খাটার পর আনিস আমরিকে তিউনিসিয়াতে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে সে যে তিউনিসিয়ার নাগরিক এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হতে পারায় তাকে আর ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। পরে তাকে জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং তাকে বলা হয় ইটালি ছেড়ে চলে যেতে। তার আরেক ভাই সংবাদ মাধ্যমকে জানান, জেল খাটার পর তার ভাই নাকি অনেক বদলে গেছে।
‘এক ধরনের মন-মানসিকতা নিয়ে সে জেলে গিয়েছিল। কিন্তু যখন সে বেরিয়ে আসে তখন সে একেবারে ভিন্ন মানসিকতার,’ বলেন তার আরেক ভাই আবদুল কাদের। তিনি বলেন, ‘সে আমাদের পরিবারের কেউ না’।
ইটালি থেকে জার্মানি : তারপর আমরি জার্মানি চয়ে যায় এবং সে এপ্রিল মাসে সেখানে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করে। তখন তাকে অস্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেয় জার্মান কর্তৃপক্ষ। তার নাম নিবন্ধন করা হয় নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়ায় এমারিশের একটি আশ্রয় শিবিরে। এটি নেদারল্যান্ডস সীমান্তের কাছে এবং কোলন শহর থেকে ৮৭ মাইল দূরে। এই রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মি. ইয়াগের জানান, আশ্রয় চেয়ে করা আমরির আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। কিন্তু তাকে দেশ থেকে বের করে দেয়া সম্ভব হয়নি, কারণ তার কাছে বৈধ কোনো কাগজপত্র ছিল না। জার্মান কর্মকর্তারা জানান, মি. আমরির কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছেÑ সে ছ’টি ভিন্ন ভিন্ন নাম ব্যবহার করেছে। সেখানে ছটি ভিন্ন জাতীয়তার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। কখনো সে নিজেকে একজন মিসরীয়, আবার কখনো সে তাকে লেবাননের নাগরিক বলে উল্লেখ করেছে। জার্মানিতে সে নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়া এবং বার্লিন এই দুটো জায়গাতেই থাকতো বলে বলা হচ্ছে।
একটি জার্মান সংবাদপত্রে বলা হয়েছে, ভুয়া ইটালিয়ান কাগজপত্র রাখার দায়ে আমরিকে আগস্ট মাসে ফ্রিডরিশহাফেন শহর থেকে আটক করা হয়েছিল এবং তার পরপরই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। জুডডয়েচে সাইটুং নামের ওই পত্রিকাটি বলছে, তারপর সে একজন ইসলাম ধর্ম প্রচারক আহমেদ আবদুল আজিজ যিনি আবু ওয়ালা নামে পরিচিত তার সংস্পর্শে চলে যায়। ওই ধর্ম প্রচারককে নভেম্বর মাসে আটক করা হয়েছিল।
বলা হচ্ছে, আনিস আমরি তখন এমন একজনের সাথে ছিল যাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আটক ওই ব্যক্তির সাথে ইসলামিক স্টেটের যোগাযোগ এবং ওই ব্যক্তি জার্মানি থেকে আই এসের জন্যে জিহাদি সংগ্রহ করছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
পত্রিকাটিকে তদন্তকারী একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এতো কিছুর পরও সে কিভাবে পুলিশের নজরের বাইরে চলে গেল, সে বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই।
তিউনিসিয়ার তথ্য : তিউনিসিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তার পুরো নাম আনিস বেন-মুস্তাফা বেন ওসমান আমরি। তার বাড়ি তিউনিসিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় কাইরুয়ান শহর থেকে ৫০ মাইল দূরে। নৌকায় করে ২০১১ সালে সে ইটালিতে চলে যায়। কিন্তু তার আগে তার পরিচিতি ছিল মোটামুটি একজন রক্ষণশীল ব্যক্তি হিসেবে। জানা গেছে, তিউনিসিয়াতেও তার অনুপস্থিতিতে তার পাঁচ বছরের কারাদ- হয়েছিল। সূত্র : বিবিসি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন