চেরুম্যান পেরুমল হল দক্ষিণ ভারতের চেরা রাজবংশের শাসকদের রাজ-উপাধী। চেরুম্যান পেরুমল পাক-ভারত উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী ব্যক্তিও নির্ভরযোগ্য সূত্রে তিনি একজন সাহাবী ছিলেন। যিনি ভারত থেকে গিয়ে হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর কাছে ১৭ দিন অবস্থান করেন।
চেরুম্যান পেরুমলের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া নিয়ে অনেক উপকথা প্রচলিত আছে। তবে অধিকাংশেরই নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র নেই। এর মধ্যে যে সকল উপকথাগুলো অধিক নির্ভরযোগ্য তার মধ্যে অন্যতম একটি হল চেরুম্যান পেরুমলের মক্কায় গিয়ে নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর কাছে মুসলমান হওয়ার ঘটনা। এ সম্পর্কে সাহাবী হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে প্রাপ্ত একটি হাদীসও রয়েছে। চেরুম্যান পেরুমল এক পুর্ণিমা রাতে চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হতে দেখেন।
কিছুক্ষণ পর পূণরায় একত্রে মিলিত হতে দেখেন। এমন হওয়ার কারণ ও রহস্য জানার জন্য তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। পরে কেরালায় আগত আরব বনিকদের থেকে নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তার চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করার মুজিযার কথা জানতে পারেন। তারা মক্কার কাফির ও মুশরিকদের একদল নেতার কথা বলে- একবার কাফির ও মুশরিকদের একদল নেতা হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর কাছে আসে। তাদের মধ্যে আবু জেহেল, ওয়ালিদ বিন মুগিরাহ, আস ইবনে ওয়ায়েল, আস ইবনে হিশাম, আসওয়াদ ইবনে আবদে ইয়াগুস, আসওয়াদ ইবনে মুত্তালিব, যাম‘আহ ইবনুল আসওয়াদ, নযর ইবনে হারেস সহ অনেকই ছিল।
ওই রাতে আকাশে পূর্ণ চাঁদ দেখা যাচ্ছিল। তারা বলে, ‘আপনার নবুওতের দাবী যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে এই চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করে দেখান’। হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বললেন, ‘এ কাজ করলে কি তোমরা ঈমান আনবে?’ তারা বললো, ‘হ্যা।” ফলে হজরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। আল্লাহ প্রার্থনা কবুল করেন। এরপর চাঁদ স্পষ্টভাবে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। চাঁদের দুই খণ্ডের মাঝখানে হেরা পর্বত দৃশ্যমান হলো। দুই খণ্ডের এক খণ্ড আবী কুবাইস পাহাড় বরাবর, অপরটি কাইকা’আন বরাবর দৃশ্যমান হলো।
এ সময় হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলছিলেন, ‘সাক্ষী থাক ও দেখ’। কাফির ও মুশরিকরা এই অসাধারণ দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। কিন্তু তারা ঈমান না এনে বলে, ‘মনে হয়, আপনি আমাদেরকে যাদু করেছেন’। এ ঘটনাকে বলা হয় ‘শাক্কুল ক্বামার। যার পরিপ্রেক্ষিতে সূরা কামার (চন্দ্র) অবতীর্ণ হয়। যাতে উল্লেখ আছে- ‘কেয়ামত সমাসন্ন, চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। তারা যদি কোনো নিদর্শন দেখে তবে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে এটা তো চিরাচরিত জাদু’।
জানা যায়, চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনাটি হিজরতের ৫ বছর আগের ঘটনা।
এরপরপরই তিনি হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে দেখতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। নিজ রাজ্য ভাগ করে দিয়ে তিনি মক্কায় চলে যান। হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনায়, তিনি নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত আদার আচার উপহার দেন। ভারতীয় এক বাদশাহ কর্তৃক তৈরি সেই আচার সংক্রান্ত একটি হাদীসও রয়েছে, যা প্রখ্যাত সাহাবী আবু খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত এবং হাদীসটি হাকিম (রা.) তার ‘মুস্তাদরাক’ নামক কিতাবে সংকলন করেছেন।
চেরুম্যান পেরুমল হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) এবং আরও অনেক প্রখ্যাত সাহাবার উপস্থিতিতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নিকট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। নবীজী তার নাম রাখেন তাজউদ্দিন। ১৭ দিন তিনি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর সাথে থাকেন। ইসলাম সম্পর্কে জানেন। তিনি সাহাবী মালিক বিন দীনার-এর বোন রাজিয়াকে বিবাহ করেন। এরপর মালিক বিন দীনারকে সাথে নিয়ে মাতৃভূমি কেরালায় ফেরার পথে ওমানে মৃত্যুবরণ করেন। সেখানেই সমাহিত হন।
চেরুম্যান পেরুমলের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সাহাবী মালিক বিন দীনার ভারতে এসে কেরালা রাজ্যের ত্রিসুর অঞ্চলের কুদুঙ্গালুর তালুক শহরের মিথিলা নামক গ্রামে ৬২৯ সালে ভারতের প্রথম জামে মসজিদ নির্মাণ করেন। নাম রাখা হয় চেরুম্যান জুম্মা মসজিদ। এটা প্রথম সংস্কার করা হয় আনুমানিক ১২০০ সালে। পরে বিভিন্ন সময় সংস্কারের মাধ্যমে পরিবর্ধন করা হয়। সর্বশেষ সংস্কার করা হয় ১৫৬৮ সালে। বর্তমানে এর দৈর্ঘ্য ৬১ মিটার এবং প্রস্থ ২৪ মিটার। মসজিদটি ভারতের প্রাচীনতম মসজিদ এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন