বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

আখিরাতের দাঁড়িপাল্লাকে ভারী করুন

জাফর আহমাদ | প্রকাশের সময় : ১৪ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

‘কিয়ামাতের দিন আমি যথাযথ ওজন করার দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করবো। ফলে কোন ব্যক্তির প্রতি সামান্যতম জুলুম করা হবে না। যার তিল পরিমাণও কোন কর্ম থাকবে তাও আমি সামনে আনবো এবং হিসেব করার জন্য আমি যতেষ্ট।; (সুরা আম্বিয়া : ৪৭)। ‘আর ওজন হবে সেদিন যথার্থ সত্য। যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই হবে সফলকাম এবং যাদের পাল্লা হালকা হবে তারা নিজেরাই হবে নিজেদের ক্ষতি সাধনকারী। কারণ তারা আমার আয়াতের সাথে জালেম সূলভ আচরণ চালিয়ে গিয়েছিল।’ (সুরা আরাফ : ৮-৯)। ‘তারপর যার পাল্লা ভারী হবে সে মনের মতো সুখী জীবন লাভ করবে। আর যার পাল্লা হালকা হবে তার আবাস হবে গভীর খাদ। আর তুমি জানো সেটি কি? সেটি জলন্ত আগুন।’ (সুরা কারিয়া : ৬-১১)।
মানুষের জীবনের সমগ্র কার্যাবলী দুটি অংশে বিভক্ত হবে। একটি ইতবাচক বা সৎ কাজ এবং অন্যটি নেতিবাচক বা অসৎকাজ। ইতিবাচক অংশের অন্তর্ভুক্ত হবে সত্যকে জানা ও মেনে নেয়া এবং সত্যের অনুসরণ করে সত্যের খাতিরে কাজ করা। আখেরাতে একমাত্র এটিই হবে ওজনদার, ভারী ও মূল্যবান। অন্যদিকে সত্য থেকে গাফেল হয়ে অথবা সত্য থেকে বিচ্যুত হয়ে মানুষ নিজের নফস-প্রবৃত্তি বা অন্য মানুষের ও শয়তানের অনুসরণ করে অসত্য অংশটি কেবল যে মূল্যহীন হবে তাই নয় বরং এটাই মানুষের ইতিবাচক অংশের মর্যাদাও কমিয়ে দিবে।
কাজেই মানুষের জীবনের সমুদয় কার্যাবলীর অংশ যদি তার মন্দ অংশের ওপর বিজয় লাভ করে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অনেক কিছু দেবার পরও তার হিসেবে কিছু না কিছু অবশিষ্ট থাকে, তবেই আখিরাতে তার সাফল্য লাভ করা সম্ভব। আর যে ব্যক্তির জীবনের মন্দ কাজ সমস্ত ভাল কাজকে মূলহীন করে দেবে তার অবস্থা হবে সেই দেউলিয়া ব্যবসায়ীর মতো যার সমুদয় পুঁিজ ক্ষতিপূরণ ও দাবী পূরণ করতে করতেই শেষ হয়ে যায় এবং এরপরও কিছু কিছু দাবী তার জিম্মায় অনাদায়ী থেকে যায়।
আল্লাহর ওজন হবে ন্যায় তুলাদণ্ডে সেদিন ওজর ও সত্য হবে পরস্পরের সামর্থক। সত্য বা হক ছাড়া কোন জিনিসের সেখানে কোন ওজন থাকবে না। আর ওজন ছাড়াও কোন জিনিসের সত্য সাব্যস্ত হবে না। যার সাথে যতটুকু সত্য থাকবে সে হবে ততটুকু ওজরদার ও ভারী। ওজনের পরিপ্রেক্ষিতে সব কিছু ফায়সালা হবে। অন্য কোন জিনিসের বিন্দুমাত্রও মর্যাদা ও মূল্য দেয় হবে না। মিথ্যা ও বাতিলের স্থিতিকাল দুনিয়ায় যতই দীর্ঘ ও বিস্তৃত থাকুক না কেন এবং আপাতদৃষ্টিতে তার পেছনে যতই জাঁকজমক, শান-শওকত ও আড়ম্বর শোভা পাক না কেন, এ তুলাদণ্ডে তা একেবারেই ওজনহীন প্রমাণিত হবে। বাতিলপন্থীদেরকে যখন এ তুলাদণ্ডে ওজন করা হবে, তারা নিজেদের চোখেই দেখে নেবে দুনিয়ায় দীর্ঘকাল ধরে তারা যা কিছু করেছিল তার ওজন একটি মাছির ডানার সমানও নয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন : হে মুহাম্মদ! এদেরকে বলো, আমি কি তোমাদের বলবো নিজেদের কর্মের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত কার? তারাই, যাদের দুনিয়ার জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম সবসময় সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত থাকতো এবং যারা মনে করতো যে, তারা সবকিছু সঠিক করে যাচ্ছে। এরা এমন সব লোক যারা নিজেদের রবের নির্দেশনাবলী মেনে নিতে অস্বীকার করেছে এবং তাঁর সামনে হাযির হবার ব্যাপারটি বিশ্বাস করেনি। তাই তাদের সমস্ত কর্ম নষ্ট হয়ে গেছে, কিয়ামতের দিন তাদেরকে কোন গুরুত্ব দেবা না। (সুরা কাহাফ : ১০৩-১০৫)।
যারা দুনিয়ার জীবনে সবকিছু দুনিয়ারই জন্যে করে গেছে এবং আল্লাহর আয়াত অস্বীকার করে এ ভেবে কাজ করেছে যে, পরকাল বলে কিছুই নেই, কাজেই কারোর কাছে কাজের হিসাব দিতে হবে না, তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা ও সাধনা দুনিয়ার জীবনের মধ্যে হারিয়ে যাবে। অর্থাৎ তারা কিছু করেছে আল্লাহর প্রতি সম্পর্কহীন হয়ে ও আখিরাতের চিন্তা না করেই শুধুমাত্র দুনিয়ার জন্যই করেছে। দুনিয়ার জীবনকেই তারা আসল জীবন মনে করেছ। দুনিয়ার সাফল্য ও সচ্ছলতাকেই নিজেদের উদ্দেশ্যে পরিণত করেছে। কিসে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাঁর সামনে হিসাব দিতে হবে এ কথা কখনো চিন্তা করেরি। তারা নিজেদেরকে শুধুমাত্র স্বেচ্ছাচারী ও দায়িত্বহীন বুদ্ধিমান জীব মনে করতো, যার কাজে দুনিয়ার এ চারণ ক্ষেত্র থেকে কিছু লাভ হাতিয়ে নেয়া ছাড়া আর কিছু নয়।
এ ধরনের লোকেরা দুনিয়ায় যতই বড় বড় কৃতিত্ব দেখাক না কেন, দুনিয়া শেষ হবার সাথে সাথে সেগুলোও শেষ হয়ে যাবে। নিজেদের সুরম্য অট্রালিকা ও প্রাসাদ, নিজেদের বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ও সুবিশাল লাইব্রেরী, নিজেদের সুবিস্তৃত রাজপথ ও রেলগাড়ী, নিজেদের আবিস্কার ও উদ্ভাবনসমূহ নিজেদেও শিল্প ও কলকারখানা নিজেদের জ্ঞান বিজ্ঞান ও আট গ্যালারী এবং আরো অন্যান্য যেসব জিনিস নিয়ে তারা গর্ব করে তার মধ্য থেকে কোন জিনিসও তারা আল্লাহর তুলাদণ্ডে ওজন করার জন্য নিজেদের সাথে নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাযির হতে পারবে না। সেখানে থাকবে শুধুমাত্র কর্মের উদ্দেশ্য এবং তার তার ফলাফল। যদি কারো সমস্ত কাজের উদ্দেশ্য দুনিয়ার জীবন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থেকে তাকে, ফলাফলও সে দুনিয়াতে চেয়ে থাকে এবং দুনিয়ায় নিজের কাজের ফল দেখেও থাকে, তাহলে তার সমস্ত কার্যকলাপ এ ধ্বংসশীল দুনিয়ার সাথে ধ্বংস হয়ে গেছে। আখিরাতে যা পেশ করে সে কিছু ওজন পেতে পারে তা অবশ্যি এমন কোন কর্মকাণ্ড হতে হবে যা সে আল্লাহকে সন্তুুষ্ট করার জন্য করেছে, তাঁর হুকুম মোতাবেক করেছে এবং যেসব ফলাফল আখিরাতে প্রকাশিত হয় সেগুলোকে উদ্দেশ্য হিসাবে গ্রহণ করে করেছে। এ ধরণের কোন কাজ যদি তার হিসাবের খাতায় না থাকে তাহলে দুনিয়ায় সে যা করেছিল সবই নিসন্দেহে বৃথা যাবে।
কিয়ামতে দাঁড়িপাল্লা মানুষের নৈতিক গুণাবলী, কর্মকাণ্ড, ও তার পাপ-পূন্য ওজন করবে এবং যথাযথ ওজন করার পর নৈতিক দিক দিয়ে কোন ব্যক্তি কোন ধরনের মর্যাদার অধিকারী তা জানিয়ে দেবে। পূণ্যবান হলে কি পরিমাণ পূণ্যবান এবং পাপী হলে কি পরিমাণ পাপী। মহান আল্লাহর এর জন্য আমাদের ভাষার অন্যান্য শব্দ বাদ দিয়ে ‘দাঁড়িপাল্লা’ শব্দ এ জন্য নির্বাচিত করেছেন যে, একটি দাঁড়িপাল্লার পাল্লা যেমন দু’টি জিনিসের ওজনের পার্থক্য সঠিকভাবে জানিয়ে দেয়, ঠিক তেমনি আমার ন্যায় বিচারের দাঁড়িপাল্লাও পত্যেক ব্যক্তির জীবনের কাজকর্ম যাচাই করে কোন প্রকার কমবেশী না করে তার মধ্যে পূণ্যের না পাপের কোন দিকটি প্রবল তা একদম হুবহু বলে দেয়।
আল্লাহর দৃষ্টিতে কেবলমাত্র সৎকাজই ভারী ও মূল্যবান। সুরা কারিয়ায় মাওয়াযিন মানে এমন ধরনের কর্মকাণ্ড, আল্লাহর দৃষ্টিতে যা কোন ওজন আছে এবং তাঁর কাছে তোন ধরণের মর্যাদালাভের যোগ্যতা রাখে। মাওয়াযিন ভারী বা হালকা হবার মানে হচ্ছে অসৎকর্মের মোকাবেলায় সৎকর্মের ভারী বা হালকা হওয়া। আরবী ভাষায় মিযান শব্দ ওজর অর্থেও ব্যবহৃত হয়। আর এই অর্থের দৃষ্টিতে ওজনের ভারী ও হালকা হবার মানে হয় নেকীর ওজন ভারী বা হালকা হওয়া। মিযান যে কোন অর্থেই ব্যবহৃত হোক না কেন সব অবস্থায় প্রতিপাদ্য একই থাকে এবং সেটি হচ্ছে, মানুষ আমলের যে পূঁজি নিয়ে আল্লাহর আদালদে আসবে তা ভারী না হালকা, অথবা মানুসের নেকী তার পাপের চেয়ে ওজনে বেশী না কম এরি ভিত্তিতে সেখানে ফায়সালা অনুষ্ঠিত হবে।
যাদের নেকীর পাল্লা ভারী হবে, তারা চীরসুখের জান্নাত লাভ করবে, যা তাদেও মন মতো হবে। আর যাদের নেকীর পাল্লা হালকা হবে তাদের ঠিকানা হবে হাবিয়া। হাবিয়া অর্থ হচ্ছে উঁচু জায়গা থেকে নীচুতে পড়ে যাওয়া। আর যে গভীর গর্তে কোন জিনিস পড়ে যায় তাকে হাবিয়া বলে। জাহান্নামকে হাবিয়া বলার কারণ হচ্ছে এই যে, জাহান্নাম হবে অত্যন্ত গভীর এবং জাহান্নামবাসীদেরকে তার মধ্যে ওপর থেকে নিক্ষেপ করা হবে। বাংলা অনুবাদ হচ্ছে,‘তার মা হবে হাবিয়া’। এ কথা বরার অর্থ হচ্ছে এই যে, মায়ের কোল যেমন শিশুর অবস্থান হয় তেমনি জাহান্নামবাসীদেও জন্য জাহান্নাম ছাড়া আর কোন অবস্থান হবে না। সেটি একটি জলন্ত আগুন।
সুতরাং মিযানের পাল্লাকে ভারী করার জন্য আল্লাহর নির্দেশিত ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রদর্শিত পথে নিজেদরকে পরিচালিত করুন। আল্লাহ দেয়া আল কুরআন নিজে পড়ুন, সেই অনুযায়ী নিজের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন গড়ে তুলুন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন