বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো ইবাদতের শামিল

জুমার খুৎবাহ-পূর্ব বয়ান

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

আল্লাহর নির্দেশনা ও রাসূল (সা.) এর সুন্নাহ মোতাবেক নিজ নিজ অঙ্গন থেকে অসহায় সুবিধাবঞ্চিত শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রত্যেক মুসলামনের দায়িত্ব, যা ইবাদতের শামিল। দুস্থ, গরিব, দুর্যোগ কবলিত মানুষের সেবায় আরবের যুবকদের নিয়ে রাসূল (সা.) গঠন করেছিলেন হিলফুল ফুযুুল। যার মাধ্যমে তিনি ইসলামে মানবসেবার গুরুত্ব ও তাৎপর্য স্পষ্ট করেছিলেন। গতকাল মহাখালীস্থ মসজিদ গাউছুল আজমে জুম্মার খুৎবাহ-পূর্ব বয়ানে খতিব প্রিন্সিপাল মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ এসব কথা বলেন।

খতিব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আল্লাহপাক ইরশাদ করেন আপনি জানেন, সে ঘাঁটি কী? তা হচ্ছে দাসমুক্ত করা কিংবা দুর্যোগ ও সঙ্কটের দিনে এতিম আত্মীয়-স্বজন ও ধুলো-ধূসরিত মিসকীনদের অন্নদান করা’। (সূরা বালাদ, আয়াত : ১০-১৬), আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, পূর্ব ও পশ্চিমে মুখ ফেরানোতে কোনো পুণ্য নেই; পুণ্য আছে আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, সমস্ত কিতাব ও নবীদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলে এবং আল্লাহ তা’য়ালাকে ভালোবেসে আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন, অভাবগ্রস্ত, মুসাফির, সাহায্য প্রার্থীদের ও দাসমুক্তির জন্য অর্থ দান করলে, নামাজ কায়েম করলে, জাকাত প্রদান করলে, প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রক্ষা করলে, অর্থসঙ্কটে, দুঃখ-কষ্ট ও যুদ্ধসঙ্কটে ধৈর্য ধারণ করলে। (মূলত) এরাই হল সত্যপরায়ণ (এবং) এরাই হল আল্লাহভীরু। (সূরা : বাকারা, আয়াত : ১৭৭)। খতিব বলেন, বর্তমানে দেশব্যাপী তীব্র শীতের প্রভাবে অসংখ্য-অগণিত মানুষ মানবেতর দিনাতিপাত করছে। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষের জীবন বিপন্নের দ্বাড়প্রান্তে। এমন সময় যেভাবে পারি সহযোগিতার মাধ্যমে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। প্রতিবছরই এই সময়টিতে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, এনজিও তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। রাসূল (সা.) বলেছেন, মানুষের কল্যাণ সংশ্লিষ্ট যত কাজ আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম হচ্ছে দরিদ্র ও ক্ষুধার্তকে খাবার দান করা। (বুখারি, হাদিস : ১২)

খতিব বলেন, রাসূল (সা.) আরো বলেছেন, ‘কোনো বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যরত থাকে, আল্লাহ তা’য়ালাও ততক্ষণ তাকে সাহায্য করতে থাকেন’। (তিরমিজি) রাসূল (সা.) আরো বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন, যে তার বান্দাদের প্রতি দয়া করে। ( বুখারি)। ইসলাম দুঃস্থ মানবতার সেবায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে জোর নির্দেশনা দেয়। শুধু তাই নয়, ধনী ব্যক্তির জন্য গরিব-অসহায় দুঃস্থ ব্যক্তিদের সহযোগিতা করা কিংবা জাকাত দেয়াকে আবশ্যক করে দিয়েছে ইসলাম।

খতিব প্রিন্সিপাল খালিদ সাইফুল্লাহ বলেন, সৎ সঙ্গে সর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ প্রবাদটি কে-না জানে। কথাটি কোরআন হাদীস সম্মত। কিন্তু বর্তমান সময়ে কোরআন ও সহীহ হাদীস মানার নামে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক (সূরা তাওবা ৯:১১৯)। আর নামাজ কায়েম কর, জাকাত দান কর এবং নামাজে অবনত হও তাদের সাথে, যারা অবনত হয় (সূরা বাকারা ২:৪৩)। অতএব আপনি পালনকর্তার সৌন্দর্য স্মরণ করুন এবং সেজদাকারীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যান (সূরা হিজর ১৫:৯৮)।

বর্তমান সময়ে এক শ্রেণির পীর-মুরিদের বিরোধীতা করতে গিয়ে মানুষ এ ভুলগুলো করছে। আসলে একজন মুসলমানের কোরআন-হাদীস বুঝতে নির্দিষ্ট বয়স হতে হয়, দ্বীনি বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে হয়। ছোট থেকে এ সময় সে কীভাবে দ্বীন মানবে? উত্তর হচ্ছে তার পিতা-মাতা, ওস্তাদ-বুজর্গদের সোহবাত থেকে। অধ্যয়নকালেও কিন্তু শিক্ষকদের সোহবাতে থাকতে হয়। কোরআন, হাদীস, ফিকহ এর কিতাব পড়েই দ্বীন মানা যায় না। সান্নিধ্য বা সোহবাত নিতেই হবে। হযরত মুসা (আ.) হযরত খিযর (আ.) এর সোহবাত নিতে আল্লাহ নিজে নির্দেশ করেছেন। সূরা কাহাফের ষাট থেকে আশি, অনেকগুলো আয়াতে যা বর্ণিত আছে। বিশ^নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সোহবাত সাহাবাগণ নিয়েছেন। জীবন তাঁর সান্নিধ্যে কোরবানি করেছেন। যা নেয়ার জন্য আল্লাহ তা’য়ালা নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূল (সা.)-এর সোহবাত নেয়া সাহাবাগণ তাঁদের নিজ জীবন থেকেও বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। মূলত তাঁর সোহবাতে এসেই সাহাবীগণ নবীদের পরে শ্রেষ্ঠ মানুষ হতে পেরেছিলেন। অতঃপর তাবেয়ী, তাবেতাবেয়ী, আওলিয়া, পীর-মাশায়েখের সোহবাতের মাধ্যমেই হক্কানী রব্বানী হয়েছেন। পরিপূর্ণ মুমিন হয়েছেন।

বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব মুফতি মো. রুহুল আমিন জুমার বয়ানে বলেন, বান্দার দোষ গোপন রাখার নির্দেশনা রয়েছে। একে অপরের সমালোচনা করা যাবে না। মানুষের প্রতি কু-ধারণা করা আল্লাহ পছন্দ করেন না। মানুষের প্রতি কু-ধারণা করা এখন মারাত্মক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। অন্যের প্রতি খারাপ ধারণা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। খতিব বলেন, আল্লাহর কাছে সম্মানের মানদণ্ড একটিই তাকওয়াভিত্তিক জীবন। যার ভেতরে ঈমানের গুণাগুণ বেশি থাকবে তাকেই সম্মান দিতে হবে। খতিব বলেন, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দেয়া যাবে না। মানুষের প্রত্যেকটা কথা রেকড হচ্ছে। যদি জবানকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়া যাবে। কোনো বৈঠকে মানুষের দোষ চর্চা শুনলে ওই বৈঠক ত্যাগ করতে হবে। খতিব বলেন, আল্লাহ আমাদেরকে পরীক্ষার জন্য দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। আল্লাহ কিসে খুশি হন কিসে নাখোশ হন তা জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করতে হবে।

মিরপুরের বাইতুল আমান কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মুফতি আবদুল্লাহ ফিরোজী জুমার খুৎবা-পূর্ব বয়ানে বলেন, আদর্শ সমাজ ও জাতি গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা। যে জাতির শিক্ষাব্যবস্থা যত উন্নত ও নৈতিক হবে, সে জাতি ততই সমৃদ্ধি এবং মর্যাদার আসন লাভ করবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষানীতি ইসলামী ভাবধারা ও মুসলিম জনগোষ্ঠির ধর্মীয় চিন্তা ও আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া উচিত। দুঃখজনক হলেও সত্য, চলমান জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষাকে শুধুই সঙ্কোচন করা হয়নি, বরং ইসলাম ধর্ম বিষয়ক এবং মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গল্প-রচনা ও কবিতা বাদ দিয়ে তদস্থলে নাস্তিক্যবাদ ও হিন্দুত্ববাদের প্রতি উদ্দীপনামূলক বিভিন্ন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জাতিসত্ত্বার বিরুদ্ধে এটা ভয়াবহ ষড়যন্ত্র। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকলে কোটি কোটি মুসলমানের সন্তান ইসলামী আদর্শ থেকে দূরে সরে নাস্তিক্যবাদী মানসিকতা নিয়ে গড়ে ওঠবে এবং ঈমানহারা হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে। অথচ আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর যেমনভাবে তাঁকে ভয় করা উচিত এবং তোমরা মুসলিম না হয়ে কখনও মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা আলে ইমরান-১০২)।

খতিব আরো বলেন, বহু অভিভাবক ধর্মের চেয়েও সন্তানের ক্যারিয়ারকে বেশি গুরুত্ব দেন। আপনাদের মনে রাখা উচিত, আল্লাহ তা’য়ালা সন্তান দিয়েছেন আমানতস্বরূপ। তাদের সুস্থ-সঠিক প্রতিপালন আপনার দায়িত্ব। আপনার সন্তানকে যদি অন্ধের মতো পার্থিব ক্যারিয়ারের পেছনে ছেড়ে দিয়ে তার দ্বীনকে নষ্টের পথে ঠেলে দেন, অবশ্যই আপনাকে আল্লাহর দরবারে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রতিটি শিশুই আল্লাহর ফিতরাহ তথা ইসলামের ওপর জন্ম গ্রহণ করে থাকে। পরবর্তীতে পিতা-মাতা তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান, অগ্নিপূজক কিংবা হিন্দু হিসেবে গড়ে তুলে। (বুখারি ও মুসলিম)। এই হাদীস দ্বারা সুস্পষ্ট বুঝা যায়, সন্তানের বিপথগামীতার দায়বদ্ধতা অভিভাবকদের ওপর বর্তায়। সন্তানের ফিতরাত ও ইসলামকে রক্ষা এবং এর ওপর প্রতিপালন করা তার জন্য যথাসম্ভব ইসলামী শিক্ষা ও পরিবেশের ব্যবস্থা করাও পিতা-মাতার ওপর আবশ্যিক দায়িত্ব। আপনার সন্তানকে কারা পড়াচ্ছে, কি পড়াচ্ছে এসব খোঁজ নেয়াও আপনার দায়িত্ব। আপনার সন্তান নতুন বছরে নতুন ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়েছে। নতুন পাঠ্যপুস্তকের ঘ্রাণে আপনার সন্তান মুগ্ধ ও আনন্দিত। কিন্তু আপনি হয়ত জানেনই না, আপনার সন্তানের হাতে বইয়ের নামে বিষাক্ত উপাদান তুলে দেয়া হয়েছে। যেই উপাদানের পয়জন আপনার সন্তানের মুসলিম পরিচয়কে নির্মূল করতে থাকবে, আপনার সন্তানের মনে তার জেন্ডার আইডেন্টি নিয়ে সংশয়ের বীজ বপন করবে, আপনার সন্তানকে বিকৃত যৌনাচারের দিকে ধাবিত করবে, পৌত্তলিকতার প্রতি আপনার সন্তানকে মোহগ্রস্ত করে তুলবে। একজন সচেতন নাগরিক ও অভিভাবক হিসেবে আপনার সন্তানের ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিতের দায়িত্ব আপনার। এই দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রের কাছে ইসলামবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের জোর দাবি তুলছি। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে আমল করার তৌফিক দান করেন, আমীন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন