মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

সড়ক দুর্ঘটনা রোধ : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

| প্রকাশের সময় : ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

॥ এক ॥
যানবাহন আধুনিক সভ্যতার একটি অপরিহার্য অংশ। এর অবিচ্ছেদ্য অংশ যানবাহন পরিচালনা। ড্রাইভার বা চালক এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তাই যানবাহন চালকদের নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠেছে স্বতন্ত্র বিভাগ ও নিজস্ব ট্রাফিক আইন, যাকে আমরা ট্রাফিক আইন হিসেবে জানি। বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেমের ট্রাফিক আইনে যানবাহন চালক বা ড্রাইভারের যোগ্যতা, দক্ষতা, পেশাদারিত্ব ও তার কর্তব্য বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। কেননা বিষয়টি সরাসরি মানুষের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। ইসলামী শরীয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ‘হিফযুন নাফস’ বা জীবন সংরক্ষণ। এ কারণে ইসলাম জীবন সংরক্ষণ ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় বিধিবিধান প্রণয়ন করেছে। সড়ক, নৌ ও আকাশ পথে চালিত বিভিন্ন যানবাহন এবং অন্যান্য যান্ত্রিক পরিবহন পরিচালনার ক্ষেত্রেও ইসলাম প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও বিধান নির্ধারণ করেছে। ইসলাম প্রদত্ত এসব বিধানের আলোকে সমসাময়িক ড্রাইভিং সংক্রান্ত বিধিবিধান নিরূপণ করা সময়ের অনিবার্য দাবি। এ প্রেক্ষাপটে সামনে রেখে বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে ইসলামী শরীয়ার আলোকে যানবাহন ড্রাইভিং ড্রাইভার বা যান চালকের যোগ্যতা দায়িত্ব-কর্তব্য, নিরাপদ সড়ক, ট্রাফিক আইন, যানবাহন তথা গাড়ির বৈশিষ্ট্য এবং দুর্ঘটনার দায় ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রবন্ধটি রচনার ক্ষেত্রে বর্ণনামূলক (উবংপৎরঢ়ঃরাব গবঃযড়ফ) ও অবরোহ পদ্ধতি (উবফঁপঃরাব গবঃযড়ফ) অনুসরণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শরয়ী বিধান আলোচনার ক্ষেত্রে বর্ণনামূলক পদ্ধতি এবং শরীয়াহ নির্ধারিত বিধানের বাস্তব অনুশীলনের পদ্ধতি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অবরোহ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রবন্ধটির মাধ্যমে যানবাহন চালনা সংক্রান্ত শরয়ী বিধান অবগত হওয়ার পাশাপাশি দুর্ঘটনা এড়ানো জন্য করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা পাওয়া যাবে।
জীবনের সকল ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তনকে সামনের রেখে এবং যোগাযোগ ও চলাচলের ক্ষেত্রে পুরনো অনেক পন্থা অচল হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে ইসলামী ফিকহের দৃষ্টিকোণ থেকে ড্রাইভিংয়ের মতো আধুনিক বিষয়ের আলোচনা এবং এর সাথে সামঞ্জ্যসপূর্ণ বিধিবিধান নিরূপণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন কারণে ড্রাইভিং বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। বর্তমানে যন্ত্রচালিত বাহন মানুষের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। এর জনপ্রিয়তা ও সহজলভ্যতার কারণে যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যম এখন অচল হতে বসেছে। বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ফলে প্রতিনিয়তই এক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটছে। তবে প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও সম্প্রসারণের সাথে সাথে এর ঝুঁঁকিও বৃদ্ধি পাচ্ছে সমান গতিতে। প্রতিদিনই বিভিন্ন দুর্ঘটনা ও ড্রাইভিং সংক্রান্ত নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট সকল মহল। যার শরয়ী বিধান উদ্ভাবিত হওয়া প্রয়োজন। ইসলামে মানবতার কল্যাণ ও জীবনঘনিষ্ঠ সব বিষয়ে বিধিবিধান রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় মানুষের চলাচল ও জনপথ সংশ্লিষ্ট সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের বিধানেরই ক্ষেত্রে ও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এগুলো সম্পর্কে সরাসরি কুরআন সুন্নাহ নির্দেশনা এসেছে এবং ইসলামী ফিকহের গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা বিধৃত হয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের বর্ণনাময় তাদের চলাচলের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেন।
“রহমানের বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে বিনম্রভাবে চলাচল করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা বলে সালাম”। “আল-কুরআন, ২৫:৬৩।” লুকমান (আ.) তাঁর পুত্রকে দেয়া উপদেশের মধ্যে চলাচলের পদ্ধতি ও শিক্ষা দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ উক্ত উপদেশ উল্লেখ করেছেন : “পৃথিবীতে ঔদ্ধত্যসহকারে বিচরণ করো না; নিশ্চয় আল্লাহ কোনো উদ্ধৃত অহংকারীকে পছন্দ করেন না। চলাচলে সংযত হও এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করো, নিশ্চয়ই গাধার আওয়াজই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর আওয়াজ”। “আল-কুরআন, ৩১ : ১৮-১৯।”
এ ব্যাপারে আল্লাহর সরাসরি নির্দেশ : “ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে বিচরণ করো না, তুমি তো কখনই ভূপৃষ্ঠ বিদীর্ণ করতে পারবে না বরং উচ্চতায় কখনই পর্বত সমান হতে পারবে না; এগুলোর মধ্যে যেগুলো মন্দ সেগুলো তোমার প্রতিপালকের নিকট ঘৃণ্য।” “আল-কুরআন, ১৭:৩৭-৩৮।”
মহানবী (সা.) রাস্তার হক ও চলাচলের শিষ্টাচার বর্ণনায় বলেছেন : “তোমরা রাস্তায় বসা থেকে বিরত থাক। তাঁরা (সাহাবা কিরাম) বললেন হে আল্লাহর রাসূল! এছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই। কেননা এটাই আমাদের বসার জায়গা, যেখানে আমরা কথাবার্তা বলে থাকি। তখন রাসূলূল্লাহ (সা.) বলেন, বসা ছাড়া তোমাদের যেহেতু গত্যন্তরে নেই সেহেতু তোমরা রাস্তার হক আদায় কর। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন রাস্তার হক কী? তিনি বললেন দৃষ্টি অবনত রাখা কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ, সালামের প্রতিউত্তর, সৎকর্মের আদেশ ও অসৎকর্মের নিষেধাজ্ঞা প্রদান। “আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ বিন ইসমাইল আল বুখারী, আল জামি আসসাহীহ (দামিশক : দুরু ইবন কাছীর, ৪র্থ প্রকাশ, ১৪১০ হি.), কিতাবুল মাজালিম ওয়াল গাসব, বাবু আফনিয়্যাতুদ দুরি ওয়াজ জুলুস ফীহা, হাদিস নং ২২৯৭ : মুসলিম বিন আল-হাজ্জাজ, আসসাহীহ (বৈরুত : দারুল মা‘রিফ, ৩য় প্রকাশ ১৪১৭ হি.), কিতাবুল লিবাস ওয়ায যিনাহ, বাবুন নাহী আনিজ জুলুস ফীত তারিকাত, হাদিস নং ২১২১।” এই সামগ্রিক নির্দেশনার ভিত্তিতে ইসলামী আইনে ড্রাইভিং সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং ফকীহগণ তাদের গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে সেগুলো আলোচনা করেছেন। ড্রাইভিংয়ের প্রয়োজনীয়তা উপাদান : ড্রাইভিংয়ের কয়েকটি প্রয়োজনীয় উপাদান রয়েছে। বিশেষজ্ঞগণের দৃষ্টিতে এগুলোর সমন্বিত রূপই ড্রাইভিং। নিম্নে ড্রাইভিংয়ের প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহ শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হলো :
নিরাপদ সড়ক : নিরাপদ সড়ক ছাড়া ড্রাইভিং অত্যন্ত ঝুঁঁকিপূর্ণ। এর অভাবে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পায়। ইসলামের দৃষ্টিতে, রাস্তা সকল মানুষের সম্মিলিত ভোগের বস্তু। সুতরাং প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে রাস্তায় চলাচল করা এবং দাঁড়ানোর। প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে রাস্তা সংশ্লিষ্ট সকল উপকার গ্রহণ করার, তা নিজ জন্তু বা গাড়ির মাধ্যমে হোক। তবে শর্ত হল যে ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব সে ক্ষতি এড়িয়ে যাওয়া এবং সে ক্ষতি সংঘটনের আশঙ্কামুক্ত রাখা। এ ব্যাপারে মূলনীতি হলো : “ক্ষতিসমূহ থেকে যথাসম্ভব নিরাপদে বেঁচে থাকার শর্তে রাস্তায় চলাচল করা বৈধ।”
একাধিক ফকীহ এ শব্দে কায়িদাটি উল্লেখ করেছেন। আর কোন কোন ফকীহ এর মর্মার্থ উল্লেখ করেছেন। “মুহাম্মদ আমীন ইবনু আবিদীন, রাদ্দুল মুহতাব আলাদ দুররিল মুখতার (কায়রো : মাকতাবাতু মুস্তাফা আল-বাবী আল হালবী, ২য় প্রকাশ, ১৩৮৬হি.), খ.৬,পৃ.৬০২; মুহাম্মদ বিন আহমদ আর-রমালী, নিহায়াতুল মুহতাজ (কায়রো : মাকতাবাতু মুস্তাফা আল বাবী আল হলবী ১৩৮৬ হি.), খ.৫,পৃ.৩৪২; ইবনু কুদামা, আল মুগনী (কায়রো : দারুল হিজরাহ, ২য় প্রকাশ ১৪১০ হি.), খ.৮.পৃ.১৬১; আলী হায়দার, দুরারুল হুক্কাম শরহু মাজাল্লাতুল আহকাম (বৈরুত; দারুল জাইল, ১৪১১ হি.), খ.১.পৃ.৬৩৯, (ধারা৯৩২)।” সুতরাং বিষয়ের বিচারে সকল ফকীহ এ কায়িদার ব্যাপারে একমত। পূর্বেই রাস্তা হক সংক্রান্ত হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে। যা থেকে রাস্তার নিরাপত্তার অপরিহার্য ফুটে ওঠে।
নিরাপদ সড়কের ব্যাপারে মহানবী (সা.)-এর নিম্নোক্ত বাণী উল্লেখযোগ্য : “মুসলমানদের কোন পথে বা কোন বাজারে যদি কেউ কোন জন্তু দাঁড় করিয়ে রাখে এরপর জন্তুটি যদি সামনের বা পেছনের পা দিয়ে কোন কিছু মাড়ায় তাহলে মালিক ক্ষতিপূরণ দেবে” “আলী বিন উমর আদদারাকুতনী, সুনান আদদারাকুতনী (কায়রো : দুরুল মাহাসিন, ১৩৮৬ হি.) খ.৩.পৃ.১৭৯। এ হাদিসের বর্ণনাকারীদের একজন হল সারিযু বিন ইসমাঈল আল হামদানী। তার বর্ণনা পরিত্যাগযোগ্য। (ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব, খ,৩.পৃ.৪৫৯) তবে শরয়ী নীতিমালা বিষয়টিকে সমর্থন করে। সামনে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।” এ বিষয়টি মাজাল্লাতুল আহকামিল আদলিয়্যার ধারা ৯৩২ এ স্পষ্টভাবে আলোচিত হয়েছে।
“সর্বসাধারণের চলাচলের পথে প্রত্যেকের নিজ জন্তুসহ চলাফেরার অধিকার রয়েছে। এ কারণে চলাচলকারী ব্যক্তি নিজ বাহনে আরোহী অবস্থায় সে ক্ষতি ও দুর্ঘটনার দায়ভার নেবে না যে ক্ষতি ও দুর্ঘটনা থেকে তার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না। “হায়দার, দুরারুল হুক্কাম, খ.২.পৃ. ৬৩৯; ইবন আবিদীন, রদ্দুল মুহতার, খ.৬.পৃ.৬০৪; ড. ফাওযী ফয়যুল্লাহ, নাযারিয়্যাতুয যামান ফীল ফিকহিল ইসলামী(কুয়েতে : দারুত তুরাছ, ২য় প্রকাশ, ১৪০৬ হি.)।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন