শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টিতে সফল

ওয়েবিনারে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ আলোচনা ৪ বছরে ১১০৯টি মামলা অভিযুক্ত ২৮৮৯ জন। সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে; জনগণ ও সাংবাদিকদের উপর আইনের অপব্যবহার হলেও পুলিশ, আইনশৃংখলা রক্ষা

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৬ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দেশের গণমাধ্যম এবং সমাজে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে ভয়ের আবহ প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রতি মাসে সরকারি লোকজন গড়ে চারটি করে মামলা করছেন এই আইনে। গত চার বছরের পরিসংখ্যান বলছে দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগই বেশি হয়েছে।

গতকাল শনিবার ‘কী ঘটছে: বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর ব্যবহারপ্রবণতা ও নিদর্শন’ শীর্ষক ওয়েবিনারের আলোচকেরা এসব মত তুলে ধরেন। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এই ওয়েবিনারের আয়োজন করে। ওয়েবিনারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা, অভিযুক্ত, আটক, আটক ব্যক্তিদের পরিচয় ও মামলাকারীদের পরিচয়সংক্রান্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক ও সিজিএসের উপদেষ্টা প্রফেসর আলী রীয়াজ।

তিনি বলেন, ভীতির পরিবেশ তৈরি করাই ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উদ্দেশ্য।
এর মাধ্যমে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেন সবাই সার্বক্ষণিক আতঙ্কে থাকেন, প্রতিবাদ না করেন। ওয়েবিনারে আলোচকেরা বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই আইনে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। প্রয়োজনে ১৫ দিন সময় বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ৭৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ে না। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বিচারের আগেই দীর্ঘদিন আটক থাকেন। গত ৪ বছরে ১৮ বছরের কম বয়সী অন্তত ২৬ কিশোর এই আইনে অভিযুক্ত হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীন ৪ বছরে ১ হাজার ১০৯টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে বলে ওয়েবিনারে জানানো হয়। এসব মামলায় অভিযুক্ত ২ হাজার ৮৮৯ জন। এর মধ্যে আটক হয়েছেন ১ হাজার ১১৯ জন, অর্থাৎ মোট অভিযুক্ত মানুষের ৩৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ আটক হয়েছে। তবে এই তথ্য মামলার পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মামলার তথ্য প্রকাশ করতে চায় না।

ওয়েবিনারে জানানো হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হওয়া মামলায় ১ হাজার ২৯ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিচয় জানা গেছে। এর মধ্যে ৩০১ জন রাজনীতিবিদ। সাংবাদিক রয়েছেন ২৮০ জন। শিক্ষার্থী ১০৬ জন এবং শিক্ষক আছেন ৫১ জন। তবে অভিযুক্ত অন্যদের চেয়ে শিক্ষার্থীদের আটকের হার বেশি। মোট অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর মধ্যে ৭১ শতাংশই আটক হয়েছে।

ওয়েবিনারে আরো জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে ১৪০টি। এসব মামলায় অভিযুক্ত ২১০ জন, এর মধ্যে আটক হয়েছেন ১১৫ জন। রাজনীতিবিদদের মানহানির অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হওয়া মামলার অধিকাংশ বাদী তাঁদের সমর্থকেরা।

আলোচকেরা বলেন, ফেসবুকে জনগণের কণ্ঠস্বর ঠেকিয়ে দেয়ার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হয়েছে। মাসে গড়ে ৯টি মামলা হয়েছে ফেসবুকে মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে। মোট ৬৯৮টি মামলা হয়েছে ফেসবুককেন্দ্রিক। এর মধ্যে হয়রানির মামলা ৭৬টি, আর্থিক প্রতারণা ৪৪টি এবং ধর্মীয় অবমাননার ১১৫টি মামলা। বাকি ৪৬৩টি রাজনৈতিক মামলা বলেই প্রতীয়মান হয়।

আলোচকেরা বলেন, সাংবাদিকদের জন্য খড়্গ হয়ে এসেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। ২০২০ সালে এই আইনের অধীন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে। প্রতি মাসে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের লোকজন গড়ে চারটি করে মামলা করেছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এই আইনের ২৫, ২৯, ৩১ ও ৩৫ ধারায় মামলা বেশি হয়েছে। ২৫ ও ৩১ ধারা দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে আদালতও প্রশ্ন তুলেছিলেন।

সিজিএসের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ভয় সৃষ্টিতে সফল হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। রাজনৈতিকভাবে যাঁরা শক্তিশালী, তাঁদের বিরুদ্ধে এই আইনের প্রয়োগ দেখা যায় না।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এলিনা খান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক—সবাই ঝুঁকিতে আছেন। সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, পরিসংখ্যান বলছে গত চার বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগের চেয়ে অপপ্রয়োগ হয়েছে বেশি। জামিন-অযোগ্য ধারার নিবর্তনমূলক ব্যবহার বেশি হয়েছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ল’র সিনিয়র প্রভাষক সাইমুম তালুকদার বলেন, জনগণের অধিকার রক্ষায়, নাকি দমন-পীড়নের জন্য এই আইন হয়েছে, সে প্রশ্ন উঠবেই। বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, রাষ্ট্রের নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে নতুন করে আইন করতে হবে। এই আইনে প্রয়োজনীয় অনেক সংজ্ঞাই নেই। সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, সর্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল এই আইনের উদ্দেশ্য। পুলিশ, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও মন্ত্রীদের মতো সমাজের একটি বিশেষ গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এই আইনের প্রয়োগ দেখা যায় না। ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন