বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য খাদ্য সঙ্কট মোকাবিলায় সরকার যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করছে তার মধ্যে মূল হচ্ছে উৎপাদন বাড়ানো ও মজুদ বৃদ্ধি। সরকারি মজুদ বাড়াতে চাল আমদানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে আট লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে আমনের বাম্পার ফলনের পরেও সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ এখনো একেবারে তলানিতে রয়েছে। ধান-চাল সংগ্রহে খাদ্য অধিদফতর রীতিমতো খাবি খাচ্ছে। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে স্থানীয় বাজারে ধানের মূল্য বেশি হওয়ায় কৃষকরা গুদামে ধান বিক্রি করতে যাচ্ছে না। গুদামে ধান বিক্রিতে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করতে খাদ্য বিভাগ থেকে মাইকিং, পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। সরকারকে কেউই ধান দিচ্ছে না। চলতি মৌসুমে ১৭ নভেম্বর থেকে ধান কেনা শুরু হয়েছে, চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ৩ লাখ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে মাত্র সাড়ে ৩শ’ টন।
ধানের বাজার এখন মিল মালিক, মজুদদার ও কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের দখলে। এতে ভাল দাম পেয়ে কৃষক খুশি হলেও বিষয়টি বিশেষজ্ঞদের ভাবিয়ে তুলছে। বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কর্পোরেট ব্যবসায়ী, মিল মালিক ও মজুদদারদের কারসাজিতেই আমনের ভরা মৌসুমেও চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। চালের দাম ক্রমশ বেড়েই চলছে। সরকার কিছুতেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এ অবস্থায় সরকার যদি ধান-চাল সংগ্রহের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারে, যদি সরকারের হাতে পর্যাপ্ত মজুদ না থাকে তাহলে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছা মতো দাম বাড়াবে। শুধু তাই নয়; তারা মজুদ করে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে দেশে দুর্ভিক্ষও সৃষ্টি করতে পারে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ইনকিলাবকে বলেন, সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে সরকার একেবারেই জিম্মি। তেল-চিনিসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের বাজার ব্যবসায়ীরা নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করছে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। চালের বাজারও দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। এখন অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ব্যবসায়ীরা ধান কিনে যেভাবে মজুদ করছে তা আগামীদিনের জন্য বড় ধরনের অশনি সঙ্কেত। সরকারের হাতে পর্যাপ্ত মজুদ থাকবে না, ব্যবসায়ীরা তখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে এবং তারা কারসাজি করে দামবৃদ্ধি করবে। শুধু তাই নয় অধিক মুনাফার জন্য তারা তখন কৃত্রিম খাদ্য সঙ্কট তৈরি করতে পারে।
করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সঙ্কট চলছে। এ বছর বিশ্বে ভয়াবহ খাদ্যসঙ্কট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থার (এফএও) প্রধান ডেভিড বিসেøর মতে, খাবারের অভাব এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে শুধু দুর্ভিক্ষই হবে তা নয়, বরং এর প্রভাবে বিভিন্ন দেশে বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে। বাংলাদেশেও খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে এমন আশঙ্কার কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এতে এক শ্রেনির অসাধু ব্যবসায়ী বেশি মুনাফার লোভে এখন ধান-চাল মজুদ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বগুড়ায় মেঘনা গ্রুপ ও -এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান তানভীর ফুড লিমিটেড অবৈধভাবে আড়াই হাজার টন ধান মজুত করার অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে বগুড়ার খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মামলা করেছেন। গত বছর ছয়টি করপোরেট প্রতিষ্ঠান এসিআই, আকিজ, বসুন্ধরা, প্রাণ, সিটি ও স্কয়ার গ্রুপ ৫ লাখ মেট্রিকটনের বেশি ধান-চাল মজুদ করেছিল। এতে চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠলে সরকার সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনেছিল। তাবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় অনেকেই আবার মজুদদারি করছে। সারাদেশে চালকল মালিক ও অন্যান্য ব্যবসায়ীরা যে ভাবে ধান কিনে মজুদ করছেন; সেটি খুবই আশঙ্কার বিষয়। এর বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা না নিলে ব্যবসায়ীদের হাতে বাজরের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে। তখন অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম খাদ্যসঙ্কট তৈরী করে দুর্ভিক্ষের দিকে দেশকে ঠেলে দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তাদের মতে, দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৪ সালে মজুদদাররাই দেশে দুর্ভিক্ষ তৈরি করেছিল।
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান ইনকিলাবকে বলেন, মিল মালিকরা বরাবরই সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেন, কিন্তু পরে চাল দেন না। তাদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেজন্য তারা বেপরোয়া। তাদের কারণে বারবার বাজারে চাল সরবরাহে ভাটা পড়েছে। এতে চালের দাম আরো বাড়ছে। নিজেদের হাতে চালের মজুদ রেখে দাম বাড়ানো তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে সরকার যদি নিজের মজুদ পর্যাপ্ত করতে না পারে, তাহলে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে খাদ্যসঙ্কট তৈরি করতে পারে।
এবার ১৭ নভেম্বর থেকে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমন মৌসুমের (২০২২-২৩) ধান-চাল সংগ্রহের সময়সীমা নির্ধারণ করেছে সরকার। এ সময়ে পাঁচ লাখ টন চাল ও তিন লাখ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। কিন্তু গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ টনের মধ্যে ধান সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৩০০ টন। দেশের হাট-বাজারে ধান কেনার উপযুক্ত সময় প্রায় শেষ দিকে। অথচ সরকারের গুদামে ধান দিচ্ছে না কৃষক। এ ছাড়া অনেক মিল মালিক সরকারের সঙ্গে চাল দেওয়ার চুক্তি পর্যন্ত করেনি। যারা চাল দেওয়ার চুক্তি করেছে তারাও চাল দিচ্ছেন না। মিল মালিক অনেকে নানান অজুহাতে শেষ পর্যন্ত চাল দিতে চুক্তির আওতায়ই আসেননি। মিল মালিকরা বলছেন, এবার সরকার প্রতি কেজি চাল কিনছে ৪২ টাকা আর ধান ২৮ টাকায়, যা বাজার দরের চেয়ে অনেক কম। বাজারে চালের সর্বনিম্ন মূল্য ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা। তাই লোকসান দিয়ে তারা চাল দিতে চাচ্ছে না। একই কারণে ধান দিচ্ছে না কৃষক। এছাড়া সরকারি গুদামে ধান বিক্রির ক্ষেত্রে কিছু প্রক্রিয়াগত জটিলতা থাকায় কৃষকরা স্থানীয় বাজারেই ধান বিক্রি করছেন। ধান দেওয়ার অ্যাপস ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত ঝক্কি-ঝামেলা। সব মিলিয়ে ব্যর্থ হতে চলেছে চলতি মৌসুমে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা।
সারাদেশে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদন নিচে তুলে ধরা হলো।
রাজশাহী থেকে রেজাউল করিম রাজু জানান, জেলায় গত ১৭ নভেম্বর থেকে আমন ধান, চাল সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু হলেও এখন পর্যন্ত কাক্সিক্ষত ধান, চাল ক্রয় করা যায়নি। কারণ হিসেবে জানা গেছে চুক্তিবদ্ধ মিল মালিকরা লোকসানের দোহাই দিয়ে সরবরাহ করছে না। এদিকে ধান ওঠার সাথে সাথে বড় মিলারদের গুদামে মজুদ হয়েছে ধান। গেরস্থ আর কৃষকের হাতে রয়েছে কম মজুদ। মিলাররা ইচ্ছেমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেেেছ, চলতি আমন মওসুমে রাজশাহীতে ছয় হাজার আঠারো টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহের জন্য লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। চুক্তিযোগ্য চালকলের সংখ্যা ছিল ১৩৪ অথচ মাত্র ৩৬ টি চালকল চাল সরবরাহের চুক্তি করে। ফলে লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক চাল সংগ্রহকারীর চুক্তি করা যায়নি। ৩৬ চালকল সাড়ে পাঁচ হাজার মেট্রিকটন চাল সরবরাহ করার চুক্তি করলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এক হাজার তিনশ মেট্রিকটন চাল সরবরাহ করেছে। এখনো চার হাজার মেট্রিকটনের বেশি চাল সরবরাহ বাকি রয়েছে। এখনো ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় রয়েছে। আশা করা যায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে।
লক্ষ্যমাত্রা খুব কম হলেও মিল মালিকরা লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে সরকারি খাদ্য গুদামে চাল সরবরাহ করতে অনীহা প্রকাশ করছে। চলতি মওসুমে ২৮ টাকা কেজি দরে ধান ও ৪২ টাকা কেজি দরে চাল কেনার সিদ্ধান্ত রয়েছে। মিল মালিকরা বলছেন বাজারে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকার ওপরে এ কারণে তারা গুদামে চাল দিতে পারছেন না। একজন মিল মালিক বলেন, আমি চুক্তি করেছি সে অনুযায়ী চাল সরবরাহ করলে পঞ্চাশ লাখ টাকার বেশি লোকসান হবে। আর চাল না দিলে জামানতের লাখ দশেক টাকা বাজেয়াপ্ত হবে। তাই চাল না দিলে ক্ষতিই কম হবে।
যশোর থেকে শাহেদ রহমান জানান, এ জেলায় সরকারিভাবে আমন ধান সংগ্রহ নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত দেড় মাসের বেশি সময় পার হলেও সংগ্রহ অভিযানের এক ছটাকও আমন ধান দেয়নি কৃষক। খোলা বাজারে দর সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি পেয়ে সরকারি গুদামমুখী হয়নি কৃষক। স্থানীয় বাজারে ব্যবসায়ীরা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে ধান ক্রয় করছেন। এ কারণে সরকারের কাছে কেউ ধান বিক্রি করছে না। যশোর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিত্যানন্দ কুন্ডু বলেন, এখন পর্যন্ত ধান কেনা সম্ভব হয়নি খাদ্য গুদামে ধান বিক্রিতে কৃষক যাতে উদ্বুদ্ধ হয় সে জন্য খাদ্য বিভাগ মাইকিং, পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ করে। তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। খোলাবাজারে ধানের দাম বেশি পেয়ে কৃষক সরকারি গুদামমুখী হচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বাজারে ধানের দাম কমতে শুরু করেছে। সরকারি গুদামে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধান কেনা হবে।
কুষ্টিয়া থেকে এস এম আলী আহসান পান্না জানান, চালের মোকাম খ্যাত এ জেলায় চলতি মৌসুমে এ পর্যন্ত এক টন ধানও সংগ্রহ করতে পারেনি খাদ্য বিভাগ। চাল সংগ্রহেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। মিল মালিকরা বলছেন, হয় সরকারি দাম বাড়াতে হবে, নয়তো বাজারে ধানের দাম কমাতে হবে। তা’ না হলে গুদামে চাল দিয়ে লোকসান হবে তাদের। খাদ্য বিভাগ ধান সংগ্রহের আশা ছেড়ে দিলেও চালের বিষয়ে আশাবাদী। কুষ্টিয়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলায় এবার ৫ হাজার ৫৬৮ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। কিন্তু গত দেড় মাসে এক টন ধানও সংগ্রহ করা যায়নি। ধান নিয়ে কৃষকরা গুদামে আসছেন না।
বাংলাদেশ অটোরাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কুষ্টিয়া জেলা শাখার সভাপতি ও ফ্রেশ এগ্রো ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওমর ফারুক বলেন, কুষ্টিয়ার অধিকাংশ অটোমিলের মালিক চাল দিতে খাদ্য বিভাগের সঙ্গে চুক্তি করেছেন। কিন্তু বাজারে ধানের দাম না কমলে সবাই চাল দিতে পারবেন না। সবাই লোকসান মেনে সরকারকে চাল দেয়ার মতো আর্থিক পরিস্থিতিতে নেই।
দিনাজপুর থেকে মাহফুজুল হক আনার জানান, আমনের বাম্পার ফলনের পর এখন বাজারে ধানের আকাল চলছে। ধানের দাম চড়া হওয়ায় চালের দামও বেশি। সরকারি ক্রয় অভিযানে চাল ক্রয় কিছুটা সন্তোষজনক হলেও ধান ক্রয় সন্তোষজনক নয়। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আমন ধান কাটা মাড়াই শেষ না হতেই বাজারে ধানের সঙ্কট কেন? খাদ্যে উদ্বৃত্ত জেলা দিনাজপুরে ধানের সঙ্কটের কারন খুজতে যেয়ে একটি বিষয় সামনে চলে আসে; তা হলো গুদামজাতকরণ। অটোরাইস মিলগুলোতে ধান চাল মজুদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অপরদিকে অটো মিল মালিকেরা বলছে মিল চালু রাখার মতো ধান তারা মজুদ রাখতে পারছে না। মিল চালু রাখতে ধানের জন্য ফড়েয়া ও মজুদদারদের শরনাপন্ন হতে হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে ধান বা চালের সঙ্কট নেই। মজুদ করার কারণে কৃত্রিম এ সঙ্কট বাজারে তৈরি হয়েছে। মজুদদারী আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে দীর্ঘদিন গুদামে রেখে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কটের পথ থাকবে না।
দিনাজপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. হোসেন জানান, বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় সরকারি কেন্দ্রে ধান বিক্রি করছে না কৃষকেরা। কিন্তু মৌসুমের শুরুতে ধানের আকাল অবস্থা সর্ম্পকে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অতিতের চেয়ে মজুদদারী ব্যবসা এখন অধিক লাভ। ঊর্ধ্বগতির বাজারে মজুদকৃত পণ্যের লাভ ছাড়া ক্ষতির কোনো সম্ভাবনা নেই। তারপরও মজুদের মাল ক্রয়ে নিজের টাকার প্রয়োজন হয় না। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ট্রেডিং ব্যবসার ওপর কোটি কোটি টাকা ঋণ প্রদান করছে। মওসুমভিত্তিক এসব ঋণের টাকা পুরোটাই ধান, গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য মজুদে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমন, বোরো, ভুট্টা ক্ষেত থেকে উঠার আগেই এবং বাজার থেকে এসব পণ্য ক্রয় করে গুদামজাত করছে। লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে বড় বড় গোডাউন তৈরি করে জামানত হিসাবে জমি ও গোডাউন ব্যাংকে বন্ধক রেখেই কোটি কোটি টাকা ঋণ মিলছে। এতে ব্যাংকগুলো নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। অপরদিকে ব্যবসায়ীয়া গোডাউন, জমি বন্ধক রেখে প্রাপ্ত ঋণের টাকায় ধানসহ উৎপাদিত পণ্যক্রয় করে গুদামে রাখছে। ৬ থেকে ৮ মাসের মধ্যে পণ্যের দাম বেড়ে গেলেই তা চড়া দামে বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা সুদসহ পরিশোধ করছে। ব্যাংকের সহযোগিতায় মজুদীকরণ ব্যবসা এখন দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলে অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী জানালেন, মওসুমের শুরুতে ধান, গম, ভুট্টা কিনলেই কোটিপতি হতে সময় লাগে না। তার মতে, ব্যাংক সিসি ঋণের বিপরীতে সর্বোচ্চ সুদ নিচ্ছে বাৎসরিক ১৪ শতাংশ। ব্যাংকের টাকায় পণ্য মজুদ করলে একবছর বা ৯-৬ মাসের মধ্যেই ৫০ শতাংশ লভ্যাংশ গোনা যায়। ঝুঁকিছাড়া মজুদ ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় অনেকেই মিল বন্ধ রেখে মালামাল মজুদ করছে। তার মতে, মজুদ আইনে সরকারি তদারকি না থাকা এবং স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারী একেবারেই না থাকায় মজুদদাররা আরো বেশি উৎসাহিত হচ্ছে। একটি সূত্র মতে, দিনাজপুর জেলায় চলতি মৌসুমের উৎপাদিত ধানের অর্ধেক মজুদ রয়েছে।
দিনাজপুর জেলায় অটোরাইস মিলের সংখ্যা হচ্ছে ১৮৮ ও মেজর হাসকিং মিলের সংখ্যা হচ্ছে ১ হাজার ৩৪৮। দিনাজপুর জেলা চাউল কল মালিক গ্রুপের সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, যত দোষ নন্দঘোষ। মিলাররা চাল মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির অভিযোগ বরাবর। কিন্তু একটি অটোমিলের প্রতিদিনের ধান মাড়াই চাহিদা কত। তার মতে, ন্যূনতম ১৫ দিনের ধান মজুদ না থাকলে অটোমিল চালানো অলাভজনক। তার মতে, মিলাররা যদি খাদ্য দফতরের বিধি-বিধানের বাইরে চাল মজুদ করে রাখে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যেতেই পারে। কিন্তু মিল চালু রাখার মতো ধান মজুদ রাখার মতো সহযোগিতা দিতে হবে সরকারকে। কেননা চাল যত উৎপন্ন হবে বাজার ততই নিয়ন্ত্রিত হবে। আর চাল উৎপাদনের জন্য ধান অপরিহার্য। তাই মৌসুমী মজুদদারদের ধান মওজুদ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
নওগাঁ থেকে এমদাদুল হক সুমন জানান, নওগাঁর হাটে ধানের সরবরাহ বেড়েছে। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারে ধানের দাম অনেক বেশি। দাম বেশি পাওয়ায় কৃষকরা খুশি। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ধান কিনছে। এ কারণে সরকারি গুদামে কৃষক ধান দিচ্ছে না। এক পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, বাংলাদেশে যে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, তারা আমাদের ধানের দাম বেঁধে দিয়েছে। বর্তমানে ধানের বাজার ভালো রয়েছে।
জয়পুরহাট থেকে মশিউর রহমান খান জানান, সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বাজারে বেশি দামে ধান বিক্রি হচ্ছে। এ কারণে সরকারি গুদামে কেউ ধান বিক্রি করছে না। ব্যবসায়ীরা ধান কিনে মজুদ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জয়পুরহাট সদর উপজেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক অরুন কুমার প্রমানিক বলেন, জয়পুরহাটে পাঁচটি উপজেলার মধ্যে শুধু সদর উপজেলায় ১ টন ধান কিনে উদ্বোধন করা হয়েছে। এবার ধানের মূল্য বাজারে চড়া থাকায় কৃষক সরকারিভাবে ধান বিক্রি করতে আগ্রহী হচ্ছে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন