বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

বাড়ছে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ২০ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

লাইসেন্সকৃত অস্ত্র নিয়ে চাঁদাবাজি-প্রভাববিস্তারকারীদের তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ : আইজিপি :: অবৈধ কাজে বৈধ অস্ত্র যারা ব্যবহার করেছেন তাদের অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা উচিত : সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ :: বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে পাঁচ হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরে
রাজধানীর গুলশানে বলপ্রয়োগ ও প্রতারণার কাজে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার বৈধ অস্ত্র দিয়ে গুলি করার ঘটনায় নড়েছড়ে বসেছে প্রশাসন। সারাদেশে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে পুলিশ। গত ১০ বছরে সারাদেশ থেকে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে ৫ হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরে। একই সময়ে পাঁচ শতাধিক বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রধারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও হয়েছে। খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধী কর্মকাÐের মাধ্যমে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণের জন্য বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার হওয়ায় এসব অভিযোগ জমা পড়েছে।

বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার বন্ধে দেশের সকল আগ্নেয়াস্ত্রের ডাটাবেজন তৈরির কাজ অনেকটাই জিমিয়ে পড়েছে। অথচ ২০২১ সালে বৈধ অস্ত্রের ডাটাবেজ তৈরির কাজ হাতে নিয়েছিল অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। অভিযোগ রয়েছে অস্ত্রের ব্যবহারে নীতিমালা থাকলেও তার তোয়াক্কা করছেন না অনেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এসব তথ্য জানা জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার গুলশানে একটি বিকাশের দোকান থেকে ৭৫ হাজার টাকা বিকাশ করে টাকা না দিয়ে আরিফ নামে এক ব্যক্তি চলে যেতে চাইলে ব্যবসায়ীরা তাকে আটক করে। স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি আবদুল ওয়াহিদ ওরফে মিন্টু ও তার লোকজন আরিফকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে ব্যবসায়ীরা বাধা দেয়। এ সময় মিন্টু তার লাইসেন্সকৃত পিস্তল দিয়ে বেশ কয়েক রাউন্ডগুলি করে। এতে দু’জন আহত হয়। ২০১৬ সালে এ অস্ত্রের লাইসেন্স করা হয়। মেয়াদ শেষে ২০২১ সালে লাইসেন্সটি নবায়ন করেন তিনি। পুলিশ অস্ত্রটি জব্দ এবং মিন্টুকে গ্রেফতার করে।

অন্যদিকে গত বছর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে যুবলীগের আহŸায়ক ও শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজালাল মজুমদারের ওপর কথিত যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান জুয়েলের নেতৃত্বে এক দল সন্ত্রাসী অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। হামলায় চেয়ারম্যানের গাড়িচালক আমজাদ হোসেন আহত হন। ওই ঘটনার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ওই ঘটনায় জুয়েলকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, আধিপত্য বিস্তার, পূর্বশত্রæতা, জমিজমার বিরোধ, ছিনতাই, ডাকাতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের পাশাপাশি বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের অভিযোগের কলেবর বাড়ছে। প্রভাবশালী রাজনীতিক থেকে শুরু করে শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, ঠিকাদারসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষজনের আত্মরক্ষার্থে যে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে তা অপরাধ জগতে চলে যাওয়ার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এমনকি অবৈধভাবে ভাড়াও দেয়া হচ্ছে এসব বৈধ অস্ত্র। প্রকাশ্যে এসব অস্ত্র উঁচিয়ে একদিকে যেমন ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে, তেমনি ব্যবহার হচ্ছে চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক সংঘর্ষ এবং খুনও করা হচ্ছে।

আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন ইনকিলাবকে বলেন, লাইসেন্সকৃত অস্ত্র কেউ অপব্যবহার করছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোন সন্ত্রাসী বা অপরাধী বৈধ অস্ত্র পেয়েছেন কিনা তাও আমরা তদন্ত করছি।
এক প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, লাইসেন্সকৃত অস্ত্র নিয়ে চাঁদাবাজি-প্রভাববিস্তারকারীদের তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ। কারো বিরুদ্ধে বৈধ অস্ত্রের অপব্যবহারের তথ্য পাওয়া গেলে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের পাশাপাশি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করার পদক্ষেপ নেয়া হবে।

সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ ইনকিলাবকে বলেন, লাইসেন্স করা অস্ত্র ব্যবহারেরও বিভিন্ন নিয়ম রয়েছে। এর মধ্যে বিনা কারণে অহেতুক কাউকে হুমকি বা ভয় দেখানোর জন্য এসব অস্ত্র প্রদর্শন করতে পারবে না। কারও কাছে অস্ত্র থাকলে তিনি সেটিকে গোপনে রাখবেন। কখনও নিরাপত্তার শঙ্কা দেখা দিলে প্রদর্শন করতে পারবেন। আবার ওই ব্যক্তি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভ্রমণের সময়ও অস্ত্রটি খুবই সতর্কতার সঙ্গে গোপনে বহন করবেন। চাইলেই কাউকে দেখিয়ে ভয় দেখানো বা প্রদর্শন করে আতঙ্ক তৈরি করা যাবে না। বাসা-বাড়িতেও ব্যবহারের ক্ষেত্রে এমন বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গুলশানে বৈধ অস্ত্র দিয়ে যেভাবে গুলি করা হয়েছে তা আইনসম্মত নয়। তদন্ত করে ওই অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা উচিত। একই সাথে বৈধ অস্ত্রের যারা অবৈধ ব্যবহার করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) হালনাগাদ বৈধ অস্ত্রের তথ্যভান্ডার ফায়ার আর্মস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এফএএমএস) সূত্র মতে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৪৪ হাজার ১০৪টি অস্ত্রের লাইসেন্সের তথ্য এতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ হাজার ৭৭৭টি অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে ব্যক্তির নামে। বাকি ৩ হাজার ৩২৭টি অস্ত্র রয়েছে আর্থিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছেÑএকনলা ও দোনলা বন্দুক, শটগান, পিস্তল, রিভলবার ও রাইফেল। এসব অস্ত্রের লাইসেন্স নেওয়ার তালিকায় রয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। একজনের নামে একাধিক অস্ত্রের লাইসেন্সও আছে। তবে সারাদেশে বৈধ অস্ত্র রয়েছে আরো অনেক বেশি। যার সঠিক তথ্য নেই সংশ্লিষ্ট্র শাখায়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য কিছু মানদÐ রয়েছে, সেগুলো পূরণ হলেই একজন নাগরিক আবেদন করতে পারবেন। আবেদনকারীর জীবনের বাস্তব ঝুঁকি থাকলে তিনি আবেদন করতে পারবেন ‘শর্ট ব্যারেল’ আগ্নেয়াস্ত্রের ক্ষেত্রে আবেদনকারীর বয়স ন্যূনতম ৩০ বছর, ‘লং ব্যারেল’ আগ্নেয়াস্ত্রের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ২৫ বছর হতে হবে, ৭০ বছরের নিচে হবে বয়স। আবেদনকারীকে অবশ্যই আয়করদাতা হতে হবে, বছরে ন্যূনতম ৩ লাখ টাকা আয়কর দিতে হবে। অনুমতি পেলে আবেদনকারী অস্ত্র আমদানি করে আনতে পারেন অথবা দেশীয় বৈধ কোনো ডিলারের কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে পারবেন। কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুটি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, পুলিশকে অস্ত্রের লাইসেন্স এবং এর কার্যক্রম আগে হাতে-কলমে নিবন্ধন করা হতো। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন হলে তাৎক্ষণিক সঠিক তথ্য পাওয়া যেত না। ডিজিটাল তথ্যভান্ডার চালু হওয়ায় কেউ বৈধ অস্ত্র অবৈধভাবে বিক্রি করতে গেলে ধরা পড়বে। আবার যদি কেউ অবৈধ অস্ত্রকে বৈধ বলে দাবি করে, তাও মুহূর্তেই যাচাই করা যাবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ অনেক সময় বিশেষ প্রয়োজনে সরকার সংশ্লিষ্ট থানায় বৈধ লাইসেন্সধারীদের আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। সে ক্ষেত্রে অস্ত্র জমা পড়ার তথ্যও দ্রæত জানা যাবে।

অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে লাইসেন্স বা অনুমোদন প্রাপ্ত প্রায় দুই লাখ বৈধ অস্ত্র রয়েছে। তবে এসব বৈধ অস্ত্রের মালিকদের পরিচয় সুনির্দিষ্টভাবে কোন ডিলারের কাছে সংরক্ষিত নেই। তাই অস্ত্রের ডাটা তৈরিতে সিআইডি দেশের ৬৪ জেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। আর এ জন্য দেশের সব জেলার সিআইডির বিদ্যমান অফিসে বৈধ অস্ত্রের মালিকরাও অস্ত্রের নমুনা দিতে পারবেন। প্রতিটি আগ্নেয়াস্ত্রেরই কিছু স্বতন্ত্র কোড আছে। এটা অনেকটা মোবাইল ফোনের আইএমইআই-এর মতো। তাহলেই বোঝা যাবে অস্ত্রের ধরন কী। নতুন করে কোনো অস্ত্র কিনলে এখন থেকে সঙ্গে সঙ্গে সে অস্ত্রের কোড সিআইডিকে দেয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের জানানো হয়েছে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন