শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

আল-কিন্দী : কম্পাঙ্ক বিশ্লেষণ পদ্ধতির আবিষ্কারক মুসলিম দার্শনিক-১

কামরুল হাসান আকাশ | প্রকাশের সময় : ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

আল-কিন্দী’র সম্পূর্ণ নাম আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল-কিন্দী। ল্যাটিন ভাষায় আল-খিন্ডাস এবং পাশ্চাত্য বিশ্বে তিনি”আলকিন্ডাস” (অষশরহফঁং) নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, বিজ্ঞানী, জ্যোতিষী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত¡বিদ, রসায়নবিদ, যুক্তিবিদ, গণিতজ্ঞ, সঙ্গীতজ্ঞ, পদার্থবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী এবং আবহবিজ্ঞানী। মুসলিমবিশ্বের পেরিপ্যাটেটিক দার্শনিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম। তাই তাকে মুসলিম পেরিপ্যাটেটিক বা ভ্রাম্যমাণ দর্শনের জনক বলা যায়। তার অনেক অর্জনের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল, গ্রীক এবং হেলেনীয় দর্শনকে আরব জগতে পরিচিত করে তোলা। এছাড়া বিজ্ঞানের অনেকগুলো শাখায় তিনি অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন।
আল-কিন্দী ছিলেন কিন্দা গোষ্ঠীর লোক। তার জন্ম বর্তমান ইরাকের কুফা নগরীতে আনুমানিক ৮০১ খ্রীস্টাব্দে। প্রখ্যাত এই আরব পÐিতের এখানেই শিক্ষা জীবন হাতেখড়ি হয়। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বাগদাদ যান। সেই সময় বাগদাদ ছিল ইসলামের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক রাজধানী। আল-কিন্দী দর্শনের পাশাপাশি পরিচিত হন ভারতীয় এবং গ্রিক বিজ্ঞানের সাথে। ফার্সি দ্বারা আরবীতে অনুবাদকৃত হিন্দু রচনা এবং সিরিয়াকের মাধ্যমে অনুবাদকৃত গ্রিক রচনা। সেসব তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন। আল-কিন্দী-ও সিরিয়াক থেকে আরবীতে কিছু অনুবাদ করেছিলেন। তার চিন্তাধারা সর্বদা বিভিন্ন দার্শনিকে পুনর্মিলনের একটি সারগ্রাহী প্রবণতাকে প্রতিফলিত করত।
বাইতুল হিকমায় আল-কিন্দী’র বিশেষ গুরুত্ব ছিল। আব্বাসীয় (৭৫০-১২৫৮) বংশের খলিফারা তাকে গ্রীক বিজ্ঞান ও দর্শন গ্রন্থসমূহ আরবীতে অনুবাদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। মুসলিমরা গ্রীক ও হেলেনীয় দর্শনকে ‘প্রাচীনের দর্শন’ নামে অভিহিত করতো। প্রাচীনের দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে আল-কিন্দী নিজস্ব দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ধারণা তুলে ধরেন। এই জ্ঞানই তাকে ইসলামী নীতিবিদ্যা থেকে অধিবিদ্যা এবং ইসলামী গণিত থেকে ঔষধবিজ্ঞানের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মৌলিক গ্রন্থ ও ভাষ্য রচনায় অণুপ্রাণিত করেছিল। আল-কিন্দী-ই প্রথম ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতিকে মুসলিম বিশ্বের পাশাপাশি খ্রিস্টান বিশ্বে পরিচিত করে তোলেন। ক্রিপ্টোলজি ও ক্রিপ্ট্যানালাইসিসে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। গুপ্ত সংকেতের মর্ম উদ্ধারের জন্য কয়েকটি নতুন গাণিতিক পদ্ধতিও আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। যার মধ্যে কম্পাঙ্ক বিশ্লেষণ পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য। গণিত ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের জ্ঞানকে ব্যবহার করে ডাক্তারদের জন্য একটি স্কেল নির্ধারণ করেছিলেন। এই স্কেল দিয়ে ডাক্তাররা তাদের প্রস্তাবিত ঔষুধের কার্যকারীতা পরিমাপ করতে পারতেন। এছাড়া তিনিই প্রথম সঙ্গীত থেরাপি পরীক্ষা করে দেখেছিলেন।
আল-কিন্দীর দর্শনের প্রধান বিষয় ছিল মূলধারার ইসলামী ধর্মতত্তে¡র সাথে তার সংযোগ। অনেক ইসলামী চিন্তাবিদের মত তিনিও ধর্মতত্তে¡র সাথে দর্শনের সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্দী’র অনেক রচনাতেই ধর্মতত্তে¡র মৌলিক বিষয়ের দেখা মিলে। যেমন : আল্লাহর প্রকৃতি, আত্মা এবং ভবিষ্যদ্বাণী। মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কাছে দর্শনের গুরুত্ব তুলে ধরার ক্ষেত্রে তার কাজ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার নিজস্ব দার্শনিক ভাবনা খুব একটা প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। আল-ফারাবী’র (৮৭২-৯৫৬) দার্শনিক মতবাদ তার দার্শনিক ধারাকে অনেকটাই ¤øান করে দিয়েছে। আল কিন্দী’র উপর বর্তমান যুগে পরীক্ষা করার মত খুব কম ডকুমেন্টই পাওয়া যায়। আল- কিন্দী’কে আরব ইতিহাসের অন্যতম সেরা দার্শনিকের মর্যাদা দেয়া হয়। আর এই কারণেই তাকে অনেকে সরাসরি ‘আরবদের দার্শনিক’ আখ্যা দিয়েছেন।
আল- কিন্দী তার কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় বাগদাদে শিক্ষক হিসাবে কাটিয়েছেন। তিনি আল-মুতাসিমের ( ৮৩৩ – ৮৪২) পুত্রের শিক্ষক হিসাবে কাজ করেছিলেন। তার তরুণ ছাত্রকে নিয়ে বেশ কয়েকটি কাজ করেছিলেন রক্ষণশীল খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিলের (৮৪৭-৮৬১) অধীনে। তবে একবার আল-কিন্দী অপমানিত হয়েছিলেন। ফলে তার শেষ ঠাঁই হয়েছিল আদালতে। তার পরবর্তী জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তবে ঐতিহাসিকরা মনে করেন, তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একজন ব্যক্তিগত পÐিত হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
দার্শনিক প্রয়োগ পদ্ধতি বিষয়ে আল-কিন্দী’র ধারণা বেশ মৌলিক। তিনি নিছক ধ্যান বা অণুধ্যানের মাধ্যমে দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার পক্ষে ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, সঠিক দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে হলে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট এবং নির্ভরযোগ্য জ্ঞানের আশ্রয় নিতে হবে। এজন্যই তিনি দর্শনে গাণিতিক পদ্ধতি ব্যবহারের পক্ষপাতি ছিলেন। কারণ, তা সুনির্দিষ্ট তথ্য এবং যুক্তির ভিত্তিতে কাজ করে। এদিক দিয়ে তার সাথে ইউরোপের আধুনিক দর্শনের জনক ফরাসী দার্শনিক রেনে দেকার্ত (১৫৯৫-১৬৫০) এর মিল লক্ষ্য করা যায়। রেনে দেকার্ত গণিতের মাধ্যমেই তার মৌলিক সংশয়গুলো নিরসন করতেন। এর মাধ্যমেই তার চূড়ান্ত দার্শনিক মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্দী’র মতবাদে দেকার্তের এই চিন্তাধারার পূর্বাভাস পাওয়া যায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন