বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

টেন্ডার সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল

শফিকুল ইসলাম বেবু, কুড়িগ্রাম থেকে | প্রকাশের সময় : ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

কুড়িগ্রামের ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল টেন্ডার সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। ৮ বছর ধরে একই পরিবারের হাতে ওষুধসহ চিকিৎসা যন্ত্রপাতি (এমএসআর) সরবরাহ ‘জিম্মি’ থাকায় ভোগান্তি থেকে মুক্তি মিলছে না জেলার ১৮ লাখ মানুষের। ফলে স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ভ‚ক্তভোগীরা। ওষুধ ও যন্ত্রাংশ সরবরাহের নামে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বিল হাতিয়ে নিলেও নীরব ভ‚মিকা পালন করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বিশ^স্ত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছর থেকে মেডিসিন ও মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ক্রয়ের (এমএসআর) টেন্ডার প্রক্রিয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর থেকে বিগত আট বছর ধরে রাজশাহীর এক পরিবারের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে হাসপাতালের এমএসআর পণ্য সরবরাহ। অভিযোগ রয়েছে, সিন্ডিকেট বাণিজ্যের কারণে ঘুরে ফিরে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিয়ে আসছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওই তিন প্রতিষ্ঠানের মালিক একই পরিবারের সদস্য। এই সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবার কার্যক্রম। দেশের বেশির ভাগ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) প্রক্রিয়ায় দরপত্র আহŸান করলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখনও সনাতন পদ্ধতিতে দরপত্র আহŸান করায় এই সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ সাধারণ ঠিকাদারদের।
হাসপাতালটির এমএসআর টেন্ডারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছর এমএসআর টেন্ডারের কার্যাদেশ পায় রাজশাহীর ‘মেসার্স টোটন ফার্মেসি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এর মালিকের নাম মো. নাসিমুল গণি খান (টোটন)। এর পরের বছর একই ঠিকাদার (টোটন) প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে ‘মেসার্স মাইক্রো ট্রেডার্স’ নামে কার্যাদেশ পান। এরপর টানা তিন বছর একই নামে এমএসআর পণ্য সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ রাখে ‘মেসার্স মাইক্রো ট্রেডার্স’। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে কিছুটা কৌশলি হয়ে টোটন তার শ্যালক জাহিদুল ইসলামের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘প্যারাগন এন্টারপ্রাইজ’ সহ যৌথভাবে এই টেন্ডারের কার্যাদেশ পান। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে আবারও একক ভাবে কার্যাদেশ পায় টোটনের ‘মেসার্স মাইক্রো ট্রেডার্স’। পরের বছর (২০২১-২০২২) শ্যালকের স্থলে নিজ বড় ভাই রফিক উদ্দিন খানের মেসার্স হারামাইন এন্টারপ্রাইজসহ যৌথভাবে আবারও কার্যাদেশ পায় ‘মেসার্স মাইক্রো ট্রেডার্স’। বিতর্ক এড়াতে পরের বছর (২০২২-২০২৩) আরো খানিকটা কৌশলি হয়ে কার্যাদেশ দেয়া হয় টোটনের বড় ভাই ও শ্যালকের নামে।
হাসপাতালের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, গত বছর এমএসআর টেন্ডারে প্রায় ১২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। ঘুরে ফিরে একই পরিবারের হাতে জিম্মি থাকা এমএসআর টেন্ডারে সরবরাহকৃত পণ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে পড়ে আছে। বেশ কিছু ওষুধ সরবরাহ না করেই বিল তুলে নেয়ার অভিযোগ আছে।
চলতি বছর হাসপাতালের এমএসআর টেন্ডারে টোটনের পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্য নিশ্চিত করতে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে দরপত্রে ‘অভিনব’ শর্ত জুড়ে দেন হাসপাতালের তত্ত¡াবধায়ক। বিগত বছরগুলোতে এই দরপত্রে গ্রæপভিত্তিক আলাদা ব্যাংক স্থিতি ও তিন বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হলেও চলতি অর্থ বছরে সকল গ্রæপের জন্য একক ব্যাংক স্থিতি- পাঁচ কোটি টাকা এবং চার বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। দরপত্রে অংশ নেয়া অন্য ঠিকাদারদের অভিযোগ, মূলত সিন্ডিকেটকে কাজ পাইয়ে দিতে এমন অভিনব শর্ত দেন তত্ত¡াবধায়ক।
কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতাল সূত্র জানায়, চলতি অর্থ বছরের এমএসআর টেন্ডারে বিভিন্ন গ্রæপে ৪৪টি দরপত্র দাখিল হয়। তবে ‘চিরাচরিত নিয়মে’ আবারও কর্তৃপক্ষের কাছে বৈধ বিবেচিত হয় রাজশাহীর তিন প্রতিষ্ঠান- মেসার্স মাইক্রো টেডার্স, প্যারাগন এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স হারামাইন এন্টারপ্রাইজ। তবে এখনও কাউকে কার্যাদেশ দেয়নি কর্তৃপক্ষ।
দরপত্রে অংশ নেয়া মেসার্স স্বর্ণা এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. সাহাদৎ হোসেন খন্দকার বলেন, তত্ত¡াবধায়ক তার পছন্দের ঠিকাদারের সাথে যোগসাজসে টেন্ডারে বিধি বহিভর্‚ত শর্ত দিয়েছেন। দেশের কোনও হাসপাতালের ক্রয় প্রক্রিয়ায় এ ধরণের শর্ত দেয়া হয় না। এটা প্রহসনের টেন্ডার প্রক্রিয়া বলে আমি মনে করি।
‘সাহিদা ট্রেডার্স’ নামে আরেক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি গোলাম রব্বানি বিপ্লব বলেন, আমরা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও সিলেটের ওসমানী মেডিকেলসহ দেশের কয়েকটি বড় বড় হাসপাতালে এমএসআর পণ্য সরবরাহ করি। এবছর সকল শর্ত মেনে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের টেন্ডারে অংশ নেই। সেখানে অধিকাংশ আইটেমে আমরা সর্বনিম্ন দরদাতা হই। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেটের সাথে হাত মিলিয়ে দরপত্র থেকে আমাদের কাগজ সরিয়ে দিয়ে আমাদেরকে নন রেসপনসিভ করে। পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতেই কর্তৃপক্ষ উদ্দেশ্যমূলক ভাবে এটা করেছে।
এ ব্যাপারে মেসার্স হারামাইন এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. রফিক উদ্দিন খানের সাথে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, আমার ছোট ভাই আমার নামে কাজ করেন। তার সাথে কথা বলেন।
পরে তার ছোট ভাই মেসার্স মাইক্রো ট্রেডার্সের মালিক মো. নাসিমুল গণি খান (টোটন) এর সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে তাকে ক্ষুদে বার্তা দিলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত¡াবধায়ক ডা. মো. শহিদুল্লাহ সিন্ডিকেটের সাথে যোগসাজসের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ঠিকাদারদের অভিযোগ সঠিক নয়। আমি বিধি অনুযায়ী টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি। পিপিআর অনুযায়ী শর্তারোপ করেছি। বিগত বছরেও একই শর্ত দেয়া হয়েছিল।
তবে হাসপাতালের বিগত বছরগুলোর এমএসআর দরপত্রের শর্তে তত্ত¡াবধায়কের এমন দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি।
টেন্ডার প্রক্রিয়া অনলাইনে দেয়ার প্রশ্নে তত্ত¡াবধায়ক বলেন, আমরাতো চাই অনলাইনে দিতে। কিন্তু প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব ও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না মেলায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না।
তত্ত¡াবধায়ক এমএসআরের দরপত্রে বিগত বছরগুলোতে একই ধরণের শর্ত থাকার দাবি করলেও হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। ২০২০-২০২১ এবং ২০২১-২০২২ অর্থ বছরের দরপত্রের শর্তে দেখা গেছে, এমএসআরের দরপত্রে গ্রæপ ভিত্তিক কাজে ‘ক’ গ্রæপের জন্য ব্যাংক স্থিতি চাওয়া হয়েছে ১ কোটি টাকা। অন্য সকল ( ‘খ’ থেকে ‘চ’ গ্রæপ) গ্রæপের জন্য চাওয়া হয়েছে ৫০ লক্ষ টাকা। শুধুমাত্র ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে সকল গ্রæপের জন্য ব্যাংক স্থিতি চাওয়া হয়েছে ৫ কোটি টাকা। অথচ গত অর্থ বছরে ‘ক’ গ্রæপে কয়েক ধাপে বিল দেয়া হয়েছে ৮ কোটি ৪৩ লাখ ২৬ হাজার ৫৮৫ টাকা। একই ভাবে ‘খ’ গ্রæপে দেয়া হয়েছে ১ কোটি ২৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৬৫ টাকা, ‘গ’ গ্রæপে ৫৫ লাখ ৮৩ হাজার ১৬৪ টাকা, ‘ঘ’ গ্রæপে ৫৬ লাখ লাখ ৩৪ হাজার ৯০০ টাকা, ‘ঙ” গ্রæপে ১ কোটি ৩৪ লাখ ৪৫ হাজার ৩৬৫ টাকা এবং ‘চ’ গ্রæপে দেয়া হয়েছে ২০ লাখ ৩৩ হাজার ৭০০ টাকা। এর মধ্যে মেসার্স হারামাইন এন্টারপ্রাইজকে দেয়া হয়েছে ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৬০ হাজার ২৮৫ টাকা। আর প্যারাগন এন্টারপ্রাইজকে দেয়া হয়েছে ৩ কোটি ৭৬ লাখ ১৭ হাজার ৭৯৪ টাকা। এসব বিল তিন ধাপে দেয়া হয়েছে বলে হাসপাতালের হিসাব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
আবার বিগত বছরগুলোতে গ্রæপভিত্তিক কাজে এমএসআর পণ্য সরবরাহে বিগত ৫ বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৩ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হলেও চলতি অর্থ বছরের দরপত্রে এই অভিজ্ঞতা ৫ বছরের চাওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২ অক্টোবর কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের এমএসআর দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। একই বছরের ২ নভেম্বর দুপুরে ১২টা পর্যন্ত দরপত্র জমা নেয়া হয়। একই দিন দরপত্র খোলা হয়। এরপর দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি দরপত্র মূল্যায়ন করে রাজশাহীর একই পরিবারের তিন প্রতিষ্ঠানকে বৈধ বিবেচনা করে স্বাস্থ্য অধিদফতরে প্রতিবেদন পাঠায়। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এখনও প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়নি স্বাস্থ্য অধিদফতর।
এ ব্যাপারে কথা হলে কুড়িগ্রাম জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি সামিউল হক নান্টু বলেন, কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের সেবার মান খুবই নিম্নমানের। অভিযোগ রযেছে ঔষধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়সহ নানা দুর্নীতি হচ্ছে। সেবার মান ফিরিয়ে আনতে সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন