বেশ কয়েক বছর পর আবার একটি বড়সড় স্ক্যামের আশঙ্কায় কাঁপছে ভারতের শেয়ার বাজার। আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের মূল্য নিয়ে আমেরিকার ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ সংস্থা’-র একটি রিপোর্ট আলোড়ন তুলে দিয়েছে দেশটিতে। ৩২ হাজার শব্দের রিপোর্টটি গত ২৪ জানুয়ারি প্রকাশ পেয়েছে। তারপর থেকেই তোলপাড় ভারতের শেয়ার বাজার। বাজার খুললেই রোজ ধস নামছে একের পর একটা সংস্থার শেয়ারে। অবশ্যই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আদানিদের সাতটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার। ধাক্কা খেয়েছে ভারতীয় জীবনবিমা নিগম তথা এলআইসি এবং অধিকাংশ ব্যাংকের শেয়ার। বিশেষত, স্টেট ব্যাংকের শেয়ারমূল্য হাজার হাজার কোটি টাকা নেমেছে। এলআইসি ও স্টেট ব্যাংকের বিপুল লগ্নি রয়েছে আদানির সংস্থায়।
আদানি গোষ্ঠী অবশ্য সবটাই চক্রান্ত বলে দাবি করেছে। ২৭ জানুয়ারি বাজারে আদানি এন্টারপ্রাইজ ‘এফপিও’ তথা ফলোঅন পাবলিক অফার ছেড়েছে। একটা তালিকাভুক্ত কোম্পানি যখন বাজারে ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং তথা ‘আইপিও’-র পর আবার কিছু শেয়ার ছাড়ে, তখন তাকে ‘এফপিও’ বলা হয়। এই ‘এফপিও’-র দর কমাতেই তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে বলে আদানিদের দাবি। মার্কিন ‘শর্ট সেলার’ তথা স্বল্পমেয়াদি লগ্নিকারী সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ না আদানি গোষ্ঠী– কার দাবি সঠিক, তা হয়তো জানা যাবে কিছুদিন পর। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ তাদের রিপোর্টে আদানিদের উদ্দেশে করা ৮৮টি প্রশ্ন জুড়ে দিয়েছে। এই প্রশ্নের সদুত্তর কেন মিলছে না, প্রশ্ন তাদের। আদানিরা ৪১৩ পাতার জবাবে জানিয়েছে, হিন্ডেনবার্গের প্রশ্নের অধিকাংশই অপ্রাসঙ্গিক।
হিন্ডেনবার্গের মূল অভিযোগ, আদানিদের সাতটি সংস্থার শেয়ারের মূল্য বাজারে ব্যাপক হারে ফোলানো-ফাঁপানো হয়েছে। তাদের আশঙ্কা, আদানিদের শেয়ার দর ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। গত বছর আগস্ট মাসে রেটিং সংস্থা ‘ফিচ’ তাদের রিপোর্টে জানিয়েছিল, আদানির সংস্থার সম্পত্তির মূল্য বাড়িয়ে দেখিয়েছে ব্যাঙ্কগুলি। নিজেদের সম্পত্তির মূল্য বাড়িয়ে দেখিয়ে আদানিরা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির থেকে অনেক বেশি পরিমাণে ঋণ সংগ্রহ করেছে। আদানির একেকটি সংস্থায় ৩৩ থেকে ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত ব্যাঙ্ক ঋণ রয়েছে বলে দাবি। আদানির সাতটি সংস্থার মধ্যে পাঁচটিরই ‘কারেন্ট রেশিও’ এক শতাংশের চেয়ে কম। কারেন্ট রেশিও হল, কোম্পানির সম্পদ ও দায়ের অনুপাত। কারেন্ট রেশিও এক শতাংশের কম হওয়ার অর্থ হল, কোম্পানির সম্পদের চেয়ে দায় অনেক বেশি।
আগস্ট মাসে ‘ফিচ’ তাদের রিপোর্টে যে-আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, এবার হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে সেটাই প্রকারান্তরে বলা হয়েছে। ‘ফিচ’-এর রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর আদানিদের শেয়ারের দর এভাবে পড়েনি। কিন্তু হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট বাজারে ধস নামিয়ে দিয়েছে। হিন্ডেনবার্গের মূল অভিযোগ, আদানিরা মরিশাস, আরব আমিরাত-সহ কয়েকটি ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ভুয়া কোম্পানি খুলে তার মাধ্যমে শেয়ার বাজারে কারচুপি করে তাদের সাতটি নথিভুক্ত সংস্থার শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে। মরিশাস, আরব আমিরাত ও এই সব ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে আয়করে ছাড় মেলে। এসব জায়গায় ভুয়া কোম্পানির মাধ্যমে আদানিরা তাদের সম্পদ সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এসব ভুয়া কোম্পানিগুলি দেশের শেয়ার বাজারে আদানিদের সংস্থায় লগ্নি করেছে।
কীভাবে শেয়ার বাজারে কারচুপি করে শেয়ারের দর বাড়ানো সম্ভব? আদানিদের নথিভুক্ত সংস্থায় তাদের নিজেদের শেয়ার ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ। বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘সেবি’-র নিয়ম অনুযায়ী, শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত সংস্থাগুলিকে ২৫ শতাংশ শেয়ার বাজারে জনগণের হাতে ছাড়তে হয়। যদি সেটা না ঘটে তাহলে সংস্থাগুলি কারচুপি করে নিজেদের শেয়ারের দাম বাড়িয়ে নিতে পারে। হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ, এই কাজটিই আদানিরা করেছে। প্রথমত, তারা নিজেদের হাতে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ শেয়ার রেখে দিয়েছে।
এরপর মরিশাস, আরব আমিরাত বা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে খোলা তাদের ভুয়া সংস্থাগুলির মাধ্যমে নিজেদের সংস্থার আরও শেয়ার কিনেছে। সব মিলিয়ে এভাবে নিজেদের সংস্থার ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ শেয়ার আদানিরা নিজেদের হাতে রেখেছে। এরপর বাজারে কৃত্রিমভাবে তারা তাদের শেয়ারের চাহিদা বাড়িয়েছে। যেহেতু, নিজেদের কোম্পানির ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ শেয়ার তারা নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করে, তাই বাজারে চাহিদা বাড়ালেও শেয়ারের জোগান বাড়ায়নি। জোগান কম ও চাহিদা বেশি হলে সবসময় বাজারে জিনিসের মূল্য বাড়ে। আদানিদের শেয়ারের ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই হয়েছে বলে হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ। অর্থাৎ, শেয়ারের বাজারে জোগান তথা ‘ফ্লোট’ কম রেখে আদানিরা তাদের কোম্পানির শেয়ারের দাম আকাশে তুলে দিয়েছে।
মহামারীর তিন বছরে আদানিদের শেয়ারের দাম ৮১৯ শতাংশ বেড়েছে। শেয়ারের দাম বাড়ায় আদানিদের সম্পদও বেড়েছে। যেহেতু নিজেদের সংস্থার প্রায় সব শেয়ার তাদের হাতেই, তাই গত তিন বছরে আদানিরা দেশের তো বটেই, বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। আদানিদের সম্পদের পরিমাণ ১৭ লাখ কোটি রুপিয় পৌঁছেছিল।
হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর আদানিদের শেয়ার নিয়ে অবিশ্বাস ছড়িয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক সংস্থাগুলির মধ্যে। ফলে, হু হু করে দাম পড়ছে শেয়ারের। আদানিদের সাম্রাজ্যে ফাটল ধরায় আশঙ্কা ছড়িয়েছে গোটা বাজারে। এলআইসি ও স্টেট ব্যাংক যেহেতু আদানিদের শেয়ারে অনেক টাকা লগ্নি করেছে, তাই আদানিদের শেয়ারে ধস নামাতে তারাও বিপুল ক্ষতির মুখে। ব্যাঙ্ক ও বিমায় সাধারণ মানুষের লগ্নি থাকে। ফলে ব্যাংক ও বিমা কোম্পানি ডুবলে ডুববে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়।
অতীতে ভারতীয়রা ছিল টাটা-বিড়লাদের যুগে। গত কয়েক বছর ধরে তারা রয়েছে আদানি-আম্বানিদের যুগে। হিন্ডেনবার্গ আশঙ্কা করেছে, আদানিদের শেয়ারের দাম ৮৫ শতাংশ কমে যাবে। যদি সেটা সত্যি হয়, তাহলে ধস নেমে যাবে ভারতের অর্থনীতিতেও। আদানি গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে অবশ্য এসব আশঙ্কাকে অমূলক বলে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। শেয়ার বাজারের পতন বন্ধ না হলেও আদানি গোষ্ঠীর দাবি, তাদের ‘এফপিও’-র ক্ষতি করতেই এসব প্রতিদ্বন্দ্বীদের চক্রান্ত। কয়েক দিনের মধ্যেই বাজার আবার ঠিক হয়ে যাবে।
আদানি গোষ্ঠীর কর্ণধার গৌতম আদানি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত। আদানিদের বিপুল উত্থান মোদি জমানাতেই। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে মোদিকে দেশজুড়ে প্রচার করতে দেখা গিয়েছিল আদানিদের বিমানে চেপেই। খুব স্বাভাবিকভাবেই আদানিদের শেয়ারে ধস নামায় সরব হয়েছে কংগ্রেস-সহ বিজেপি বিরোধীরা। দাবি উঠেছে, কেন এলআইসি ও স্টেট ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি রুপি আদানিদের সংস্থায় লগ্নি করে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়কে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া হল?
সত্যি সত্যি আদানিদের সংস্থাগুলি যদি ডোবে, তাতে শুধু ভারতীয় অর্থনীতিই বড় ধাক্কার মুখে পড়বে না, দেশের রাজনীতিতেও বড় ঝড় উঠে যাবে। লোকসভা ভোট খুব দূরে নেই। অতএব বলাই যায়, দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি আদানিদের সংস্থাগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে এক চরম সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সূত্র: টাইমস নাউ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন