শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

আদানির বিদ্যুৎ বাংলাদেশে সরবরাহ অনিশ্চিত

কলকাতা হাইকোর্টে ৩০ কৃষকের মামলা

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

আদানির বিদ্যুৎ বাংলাদেশে সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। গত ১০ ডিসেম্বর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করেছে আদানি। এ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ভারতের ঝাড়খন্ড থেকে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। এর মধ্যে সংকটে পড়তে যাচ্ছে ভারতের প্রভাবশালী আদানি গ্রæপ। তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ক্ষতিপূরণ না দিয়ে কৃষিজমির ওপর খুঁটি বসিয়ে বিদ্যুতের লাইন নেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কার কৃষকরা।

গত মঙ্গলবার ৩০ কৃষক কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন। ওই লাইন দিয়ে বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে আদানি গ্রæপ। মামলার কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আগামী ৭ ফেব্রæয়ারি মামলার শুনানির দিন ধার্য করেছেন প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব ও বিচারক রাজর্ষি ভরদ্বাজের হাইকোর্ট বেঞ্চ। কৃষকদের দাবি, বিদ্যুৎ সঞ্চালন এবং বন আইনের লঙ্ঘন করা হয়েছে। ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের গোড্ডায় একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ শেষ করেছে আদানি গ্রæপ। সেখান থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ১০৬ কিলোমিটার ও বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে জাতীয় গ্রিড পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইনের কমিশনিং সম্পন্ন হয়েছে। গত ১০ ডিসেম্বর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করেছে আদানি। এখন ২০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ আসছে। এ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ভারতের ঝাড়খন্ড থেকে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। শুরু থেকেই মুর্শিদাবাদের কৃষকরা এ নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। গত বছর গ্রামবাসী বিক্ষোভ করলে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয়। কৃষকদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ না দিয়ে আম ও লিচুবাগানের ওপর দিয়ে বিদ্যুতের উচ্চ ক্ষমতার লাইন নেওয়া হচ্ছে। এতে আম-লিচুর বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ছয় মাসে রাজ্য সরকারের নিরাপত্তায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ হলেও ক্ষতিপূরণ পাননি চাষিরা। এ কারণে তাঁরা মামলার পথ বেছে নিলেন। তাঁদের পক্ষে মামলাটি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ঝুমা সেন। মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের কর্মী রণজিৎ সুর বলেন, পুরো প্রক্রিয়া বেআইনিভাবে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে আদানির বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন যাবে, অথচ রাজ্যটির সঙ্গে তাদের কোনো চুক্তি নেই। যাঁদের জমির ওপর দিয়ে সঞ্চালন লাইন যাচ্ছে, তাঁদের সঙ্গেও চুক্তি নেই। তাঁদের সম্মতিও নেওয়া হয়নি। ভারতের বিদ্যুৎ সঞ্চালন আইন বা বন সংরক্ষণ আইন-কোনোটাই মানা হয়নি। তাই আদালতের কাছে আদানির বিদ্যুৎ প্রকল্পের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে তদন্ত কমিটি ও কৃষকরা সম্মত হলে তাঁদের চুক্তির মাধ্যমে প্রতি বছর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করে আদানি যে লাভ করবে, এর লভ্যাংশও কৃষকদের দিতে হবে। আইনজীবী রণজিৎ জানান, গাছ কাটার জন্য পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, এর জন্যও উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। গত জুলাইয়ে কৃষকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাঁদের ওপর থেকে সব মামলা তুলে নিতে হবে।

মার্চে আদানির বিদ্যুৎদেশে আসা অনিশ্চিত
গত ৩ জানুয়ারি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ঝাড়খন্ডের আদানি গ্রæপের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন,আদানির ঝাড়খন্ডের কেন্দ্র থেকে মার্চ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা সম্ভব হবে। এ কেন্দ্র থেকে প্রাথমিকভাবে আমরা ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাব। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের দিকে ইঙ্গিত করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আগামী গ্রীষ্মে আমাদের চাহিদা মেটাতে আরও বিদ্যুৎ প্রয়োজন। এ জন্য আমরা বিকল্প উৎসের সন্ধানে রয়েছি। সুলভমূল্যে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করাই আমাদের অগ্রাধিকার। এ জন্য আমরা কাজ করছি। ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে ইতোমধ্যে একটি ডেডিকেটেড ট্রান্সমিশন লাইনের কাজ শেষ হয়েছে। চাপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়ায় দুটি উপকেন্দ্র ও ট্রান্সমিশনের কাজও সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী।

২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর ভারতের আদানি গ্রæপের সঙ্গে ঝাড়খন্ডে ওই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার চুক্তি করে বাংলাদেশ। প্রাথমিকভাবে চুক্তিটি ২৫ বছর মেয়াদী। কেন্দ্রটির দুটি ইউনিট দৈনিক ৮০০ করে মোট ১৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে। আদানি গ্রæপের কর্ণধার গৌতম আদানি ভারতের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ী ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি।

কতটা লাভজনক
গত ডিসেম্বরে ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ১৬৩ পৃষ্ঠার বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির গোপন নথি তাদের হাতে এসেছে। ওয়াশিংটন পোস্টের অনুরোধে তিনজন শিল্প বিশ্লেষক ওই চুক্তি পর্যালোচনা করেছেন। তারা দেখেছেন, ২৫ বছর মেয়াদি এই গোড্ডা চুক্তি বাংলাদেশের জন্য নিতান্তই লাভজনক নয়। প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর বিদ্যুৎ উৎপাদন যতটুকুই হোক না কেন, ক্যাপাসিটি ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হিসেবে আদানিকে বছরে মোটামুটি সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা (৪৫০ মিলিয়ন ডলার) দিতে হবে। সিডনিভিত্তিক জ্বালানি অর্থায়ন বিশ্লেষক টিম বাকলের মতে, ওই রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ জ্বালানি খাতের প্রচলিত দরের তুলনায় অনেক বেশি।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য এই প্রকল্প থেকে বিদ্যুতের প্রয়োজন নাও হতে পারে। বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ীই পিক আওয়ারের সর্বোচ্চ চাহিদার ৪০ শতাংশ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে। বছরের পর বছর কয়লা ও গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগের কারণে বাংলাদেশ এই সক্ষমতা অর্জন করেছে। টিম বাকলের মতে, বাংলাদেশ তার অভ্যন্তরীণ বিদ্যুতের পাইকারি বাজারের চেয়ে পাঁচগুণেরও বেশি দামে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনবে। এমনকি কয়লার দাম ইউক্রেন যুদ্ধের আগের পর্যায়ে ফিরে এলেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের জনসমক্ষে প্রকাশ করা ব্যয়ের চেয়ে আদানির বিদ্যুতে প্রতি কিলোওয়াট-ঘণ্টায় ৩৩ শতাংশ বেশি খরচ হবে। বাংলাদেশের কাপ্তাই সৌর খামারের সঙ্গে তুলনা করলে আদানির বিদ্যুৎ পাঁচগুণ বেশি ব্যয়বহুল হতে পারে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন