শীতের মৌসুমে ট্রেনে যারা গফরগাঁও হয়ে যাতায়াত করেন, তাদের অনেকের কাছেই ফেরিওয়ালাদের এ সংলাপটি দীর্ঘদিন ধরে পরিচিতÑ ‘বাইগুইন নিবাইন, বাইগুইন, গোল বাইগুইন’। অর্থাৎ বেগুন নিবেন, বেগুন, গোল বেগুন। বহুকাল ধরে গফরগাঁওয়ের ঐতিহ্যবাহী গোল বেগুন দেশ-বিদেশের মানুষের মন কাড়ছে। তবে দুঃখের বিষয় হলো, হারিয়ে যেতে বসেছে গুনেমানে সুস্বাদু, নয়নকাড়া মনোলোভা অনন্য এ গোল বেগুন।
বিশেষ জাতের এ বেগুন দেখতে গোলাকার। কিন্তু দেহ মসৃণ নয়, অনেকটা ঢেউ খেলানো খঁাঁজকাটা। বেশ বড় আকারের। এর একটি বেগুনের ওজন এক-দেড় কেজি থেকে তিন-চার কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। বিশেষ করে বড়া বা ভাজি খেতে এ বেগুনের জুড়ি মেলা ভার।
এক সময় গফরগাঁও উপজেলার ৩ নম্বর চরআলগী ইউনিয়নের চরমছলন্দ গ্রামের কাচারী পাড়ায় চাষ হতো এ বেগুন। মাত্র ৫০-৬০ জন সৌভাগ্যবান কৃষক এ কাজ করতেন। ওই এলাকা ছাড়া অন্য এলাকার জমিতে শত চেষ্টা করেও এর ফলন ঘটানো আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। আঞ্চলিকভাবে এর নাম লাফা বেগুন। এর ফলন খুব অল্প সময়েই হয়ে থাকে।
বেগুন চাষীদের মতে, এর ফলনে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। ভরা শীতের মধ্যে এর ফলন শুরু হয়। তাই প্রতিদিন হাড় কাঁপানো শীতে রাতের শেষ প্রহরে জেগে ক্ষেতের মাটি পা দিয়ে ওলট-পালট করে দিতে হয়। তারপরও প্রতি সপ্তাহে পানি দিয়ে মাটি ভিজিয়ে দিতে হয়। কারণ এ বেগুন গাছ মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণে রস শুষে নেয়। এর বাইরেও কিছু নিয়ম-আচার পালন করতে হয়, যা বর্তমানে নতুন প্রজন্মের মানুষের কাছে অনেকটা কুসংস্কারের মত মনে হয়। তাই চাষীদের নানা রকম ঠাট্টা-বিদ্রæপ সহ্য করতে হয়। এ বেগুন উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণে জৈব ও রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন কারণে এখন কৃষকরা গরু পালন কমিয়ে দিয়েছেন। তাই গোবর ও জৈব সার এখন আর আগের মতো পাওয়া যায় না। যান্ত্রিক চাষে বেগুনের আবাদ, প্রচুর রাসায়নিক সারের আর্থিক যোগান দেওয়া অনেক চাষীর পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। এ ব্যাপারে স্থানীয় কৃষি অফিস ও কৃষি ব্যাংকের সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছেনা বলেও অভিযোগ রয়েছে কৃষকদের।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, গোল বেগুন উৎপাদন না হওয়ার দুটি কারণ রয়েছে :
১. যেসব জমিতে গোল বেগুন সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হতো, সেসব জমির বেশির ভাগ ব্রহ্মপুত্র নদে বিলীন হয়ে গেছে। ২. গোল বেগুন চাষাবাদ করতে যে পরিমাণে অর্থ খরচ হতো- তার চেয়ে কম খরচ লাগে ইরি-বোরো ধান চাষাবাদ করতে। ফলে কৃষকরা গোল বেগুন চাষের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন।
বিশেষ এ গোল বেগুন চাষে অনেক নিয়ম কানুন মেনে না চললে ফলন হয় না বলে জনশ্রæতি রয়েছে। নিয়মগুলো হলো মাথায় তেল, পায়ে জুতা এবং নাপাক শরীরে বেগুন ক্ষেতে প্রবেশ করা নিষেধ। মহিলারা এসব বেগুন ক্ষেতে প্রবেশ করতে পারেন না। এসব নিয়ম পালন না করলে বেগুন হবে না। কোনো কোনো বেগুন ক্ষেতে রোগ দেখা দিলে উল্লেখিত কারণ ভঙ্গ হয়েছে বলে অনেক কৃষকরা মনে করেন।
এছাড়াও বিভিন্ন কারণে ধীরে ধীরে গোল বেগুন চাষের উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন চাষীরা। তারা এ বেগুন চাষ নিয়ে কোনো কথা বলতে চান না। তাদের অনেকের মতে, এ বেগুনের পেছনে যে শ্রম দিতে হয়, এ শ্রম ধান চাষের পেছনে দিলে আর্থিকভাবে অনেক বেশি লাভবান হওয়া যায়। বিশিষ্টজনদের মতে, এ বেগুনের চাষ টিকিয়ে রাখতে হলে, কৃষকদেরকে কৃষি ব্যাংক ও কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে উৎসাহ প্রদানের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করতে হবে। তাহলেই সেই গফরগাঁওয়ের সেই ঐতিহ্যবাহী গোল বেগুন চাষের প্রতি কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হবেন। বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে ঐতিহ্যবাহী গফরগাঁওয়ের গোল বেগুন।
ইদানিং দেশের বিভিন্ন বাজারে গফরগাঁওয়ের গোল বেগুন বলে ধোঁকা দিয়ে এক ধরনের গোল বেগুন বিক্রি করা হয়ে থাকে। ওসব আসলে গফরগাঁওয়ের নয়। এসব বেগুনের দেহ মসৃণ অর্থাৎ সাদামাটা। রং-ও সম্পূর্ণ বেগুনী নয়।
বর্তমানে গফরগাঁওয়ের চরাঞ্চলে বেশ কিছু চাষী গোল বেগুন চাষ করছেন। তবে এগুলোর আকৃতি ‘আদি গোল বেগুনের’ মতো বড় নয়। তবে এগুলোর ভাজি খেতেও বেশ সুস্বাদু।
গফরগাঁও উপজেলার ৩ নং চরআলগী ইউনিয়নের চরআলগী নয়াপাড়া গ্রামে গোল বেগুন চাষী বছির আহম্মেদ জানান, বাংলাদেশের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী লাফা গোল বেগুন চাষ শুধুমাত্র চরআলগী নয়াপাড়া গ্রামে গোটা কয়েক কৃষক করে থাকেন। গোল বেগুন চাষ বৃদ্ধি করার ব্যাপারে সরকারিভাবে কৃষিবিভাগের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এছাড়া কৃষকদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়াও প্রয়োজন। প্রায় ১শ’ বছর আগে রেওয়াজ ছিল গফরগাঁওয়ের ঐতিহ্যবাহী লাফা গোলবেগুন উচ্চ পর্দস্ত কর্মকর্তাদেরকে উপহার দিয়ে চাকরি হয়ে যেতো। গ্রামবাংলায় এখনো এ প্রচারণা রয়েছে। সারা দেশে এখনো গফরগাঁওয়ের গোল বেগুনের ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। গফরগাঁও উপজেলার বাইরে দেশ-বিদেশেও গফরগাঁও উপজেলার নাম উল্লেখ করলেই গোল বেগুনের নাম চলে আসে।
উপজেলা কৃষি অফিসার নূর মোহাম্মদ বলেন, চরআলগী নয়াপাড়া গ্রামের কৃষকরা গফরগাঁওয়ের ঐতিহ্যবাহী লাফা গোল বেগুন চাষে নতুন করে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। গোল বেগুন আবাদের প্রতি ধীরে ধীরে আগ্রহ বাড়ছে তাদের। চলতি মৌসুমে বেগুনের আবাদী জমির পরিমাণ হলো ৩ শত হেক্টর। আশা করা যাচ্ছে লাফা গোল বেগুনের আবাদের পরিমাণ অদূর ভবিষ্যতে আরো বেড়ে যাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন