শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

এখনো সেকেলে সেবা

দেশের একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ক্যান্সার ইনস্টিটিউট বিশ্ব ক্যান্সার দিবস আজ

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

ষাট বছর বয়সী সাবিয়া বেগম দীর্ঘদিন ধরে মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে রেডিওথেরাপি নিতে পারমর্শ দিয়েছেন। পরামর্শ অনুযায়ী, গত বছরের ২৮ নভেম্বর তিনি জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগে যান। সেখান থেকে তাকে ২০২২ সালের দুই মার্চ অর্থাৎ চার মাস পরের একটি সিরিয়াল দেয়া হয়। তবে চার মাস পরে হাসপাতালে এসেও তিনি বেঁচে থাকতে কাক্সিক্ষত রেডিওথেরাপি পাননি। সেখান থেকে তাকে পুনরায় ১৭ এপ্রিল হাসপাতালে যেতে বলা হয়। একই অবস্থা ৫২ বছর বয়সী কুদ্দুস খানের। গত এক মার্চ তার কেমো থেরাপি নেয়া শেষ হয়। এর এক মাসের মধ্যে তার রেডিওথেরাপি শুরু করতে বলেছেন চিকিৎসকরা। তাকে হাসপাতাল থেকে সিরিয়াল দেয়া হয়েছে জুলাই মাসের ৬ তারিখে। তবে ওই দিন তিনি থেরাপি পাবেন কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

শুধু সাবিয়া বেগম বা কুদ্দুস খানই নয় ক্যান্সার চিকিৎসায় দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রেডিওথেরাপি নিতে আসা সব রোগীর ক্ষেত্রেই ঘটছে এই ঘটনা। পাঁচ মাসের আগে কোনো রোগীই রেডিওথেরাপি পাচ্ছেন না। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সেখানে ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় ছয়টি রেডিওথেরাপি মেশিন থাকলেও ৪টি অকোজো হয়ে পড়েছে। দুটি এক্সরে মেশিনই নষ্ট, রেডিয়েশন থেরাপির জন্য দুটি ব্র্যাকি থেরাপির একটি নষ্ট। এমনকি রেডিওথেরাপি ভবনের দু’টি লিফটই নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এতে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়েছেন রোগীরা। এমনকি হোটেলে থাকতে না পেরে দরিদ্র রোগীরা হাসপাতালের সামনে মাদুর বিছিয়ে থাকতেন। কিন্তু স¤প্রতি রোগীদের হাসপাতালের সামনে থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে সহসা এই সমস্যায়র সমাধান হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ২০৩০ সালেল মধ্যে অসংক্রামক রোগ (ক্যান্সার) সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমে অকাল মৃত্যু এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আর নানামুখী এ সব সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে বিভিন্ন আয়োজনে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস উদযাপন করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন ক্যান্সার রোগী অস্ত্রপচারের পরে বা কেমো থেরাপি দেয়ার পরে রেডিওথেরাপি নিতে গেলে কমপক্ষে ৬ মাস পরে সিরিয়াল পাচ্ছেন। যথা সময়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পেয়ে তারা আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এমনকি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। ক্যান্সার আক্রান্ত কোনো রোগীকে যদি যথা সময়ে রেডিওথেরাপি দেয়া সম্ভব না হয় তাহলে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে থেরাপি দেয়া সম্ভব না হলে রোগী অ্যাডভান্স স্টেজে চলে যায়। এ পর্যায়ে গেলে রোগী ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এমনকি তার মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের রেডিয়েশন থেরাপি দেয়ার জন্য ৬টি মেশিন রয়েছে। এরমধ্যে ৪টি লিনিয়ার এক্সিলারেটর এবং দু’টি কোবাল্ট-৬০ মেশিন। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে ৩টি (১,২,৪) লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিন বিকল হয়ে পড়ে আছে। অন্যদিকে ৩ নম্বর লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিনটি বিকল প্রায় দুই সপ্তাহ। বর্তমানে কার্যকর রয়েছে কোবাল্ট-৬০ মেশিন দু’টি।
এই চারটি মেশিন দিয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ৯০ জন করে ৩৬০ জন রোগীকে রেডিওথেরাপি দেয়া হতো। কিন্তু নষ্ট হওয়ার কারণে এই বিপুল সংখ্যক রোগীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বর্তমানে রোগীর ভীষণ চাপ থাকা সত্তে¡ও দু’টি কোবাল্ট মেশিন দিয়ে মাত্র ১৮০ জনের মতো রোগীকে সেবা দেয়া হয়। এরমধ্যে একটি মেশিন দিয়ে দুই শিফটে ৩৩ জন করে ৬৬ জন এবং অন্য মেশিন দিয়ে তিন শিফটে ৩৭ জন করে ১১১ জনকে সেবা দেয়া হচ্ছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তবে কোবাল্ট-৬০ মেশিনে এক্সপোজার সোর্স হিসেবে গামা-রশ্মি ব্যবহার করা হয়। যার হাফ লাইফ টাইম সাড়ে ৫ বছর। এই মেশিন দু’টি ২০১২ সালে স্থাপন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দু’টি মেশিন থেকে সেবা দেয়া হলেও এটি মূলত রোগীদের জন্য ঝুকিপূর্ণ। এসব মেশিন থেকে থেরাপি নিলে ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ হওয়ার চেয়ে আরো ছড়িয়ে পড়তে পারে।

হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, রোগীদের সঠিক ভাবে রেডিওথেরাপি দেয়ার জন্য একটিমাত্র টিপিএস (ট্রিটমেন্ট প্লানিং সিসটেম) বিকল হয়ে পড়ে আছে। এখন রোগীদের সঠিক স্থানে থেরাপি দেয়ার জন্য শরীরে স্কেল দিয়ে মেপে দাগ কেটে দেয়া হয়। এই পদ্ধতিতে দেশে ৩০ বছর আগে থেরাপি দেয়া হতো বলে জানান তারা। অর্থাৎ দেশের একমাত্র ক্যান্সার ইনস্টিটিউট আধুনিক হওয়ার পরিবর্তে সেকেলে হয়ে পড়ছে।
এদিকে দেশে নারীদের মধ্যে সার্ভিক্যাল ক্যান্সারে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি। তাদের চিকিৎসায় ইনস্টিটিউটে দু’টি ব্র্যাকি থেরাপি মেশিন থাকলেও তার একটি অকেজো প্রায় ৩ বছর। একটি মাত্র ব্র্যাকি থেরাপি মেশিন দিয়ে চলছে আক্রান্ত নারীদের চিকিৎসা।

শুধু রেডিওথোরাপি মেশিনই নয়, দেশের একমাত্র ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের দু’টি এক্সরে মেশিন নষ্ট হয়ে পড়ে আছে এক বছরের বেশি সময় ধরে। একটি এমআরআই মেশিন থাকলেও সেটিও অকেজো। এমনকি প্রশাসিনক ভবনের দু’টি লিফটই নষ্ট প্রায় তিন মাস।
এ বিষয়ে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. উম্মে রুমান সিদ্দিকী বলেন, লিফটের সমস্যা দ্রæতই সমাধান হয়ে যাবে। তবে রেডিওথেরাপিসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে অনেক সময় লাগবে। কারণ সরকারিভাবে যন্ত্রপাতি কেনাকাটা একটি জটিল ও সময় সাপেক্ষ পক্রিয়া। এক্ষেত্রে কবে ঠিক হবে সুনির্দিষ্ট করে বলার সুযোগ নেই।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এই হাসপাতালে চিকিৎসায় আসা রোগীদের ৮০ শতাংশই স্বাক্ষরজ্ঞানহীন এবং তিন চতুর্থাংশই দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির। দেশের একমাত্র এই প্রতিষ্ঠানে মাত্র ১০০ টাকায় কোবাল্ট মেশিনের রেডিওথেরাপি এবং ২০০ টাকায় লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিন এর থেরাপি পাওয়া যায়। এছাড়া এখানে ব্র্যাকি থেরাপি পেতে দিতে হয় ১৫শ’ টাকা। অন্যদিকে যেকোন বেসরকারি হাসপাতালে এই সেবা পেতে গুনতে হয় কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা।

হাসপাতালের কয়েজন চিকিৎসক জানান, এখানে মেশিন নষ্ট থাকার সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা জড়িত থাকতে পারে। বর্তমানে আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতাল, ল্যাবএইড, ডেল্টা হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, এভার কেয়ার এবং স্কয়ার হাসপাতালে রেডিওথেরাপি দেয়ার সুযোগ আছে। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের চিকিৎসকরা এসব হাসপাতালে প্রাক্টিস করেন। তারা অনেকই এখানকার রোগীদের ওইসব হাসপাতালে যেতে প্ররোচিত করেন। ওইসব হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় ক্যান্সার হাসপাতালের তুলনায় ৫ থেকে ১০ গুণ বেশি। অথচ ক্যান্সার হাসপাতালে আসা ৮০ শতাংশ রোগীর পক্ষে ওই ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব নয়।

অবশ্য নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে আশার সংবাদও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের তত্ত¡াবধানে দেশের ৮টি বিভাগীয় শহরে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১শ’ শয্যাবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে। দেশের বিপুল সংখ্যক ক্যান্সার রোগীর দেশের বাইরে যাওয়া বন্ধ এবং যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে চিকিৎসাকেন্দ্র নির্মাণের ৩৫ শতাংশ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। এটি পুরোপুরি চালু হলে ক্যান্সার চিকিৎসায় অকাল মৃত্যু অনেকটা রোধ করা সম্ভব হবে।

সামগ্রিক বিষয়ে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক প্রফেসর ডা. মোল্লা ওবায়েদ উল্লাহ বাকী বলেন, দেশের একমাত্র ক্যান্সার হাসপাতালে একদিনের জন্য কোনো ধরনের সেবা বন্ধ থাকা ঠিক নয়। মেশিন পত্রের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সবসময় তদারকি করা উচিত। যাতে আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়। নয়তো দেশের গরীব রোগীদের বাঁচানো সম্ভব হবে না।

এদিকে দিবসটি উপলক্ষে ওয়ার্ল্ড ক্যান্সার সোসাইটি নানামুখী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় প্রেসক্লাবে বিকালে আলোচনা সভা, সকালে সচেতনতামূলক র‌্যালি এবং লিফলেট বিতরণ করবে। এছাড়া সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে কমিউনিটি অনকোলজি সেন্টার ট্রাস্ট ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন