বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

ই-কমার্সের নামে হাতিয়ে নিয়েছে ৩শ’ কোটি টাকা

জেনিভিয়া এক্সপ্রেস শপ

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

এক লাখ টাকা লগ্নি করলে ৩ মাস পর ফেরত দেয়া হবে ২ লাখ টাকার পণ্য কিংবা নগদ টাকা। লোভনীয় এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে অন্তত ৩শ’ কোটি টাকা। ‘জেনিভিয়া এক্সপ্রেস শপ’ নামের কথিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এ অর্থ হাতিয়ে নেয়।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজধানীর মোহাম্মদপুর টিক্কাপাড়া নিবাসী মো. জাহিদুল ইসলাম। স্ত্রী জেসমিন আক্তারকে রাখা হয়েছে চেয়ারম্যান হিসেবে। এ দুই ব্যক্তি সামনে থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির নেপথ্যে ক্ষমতাসীন প্রভাবশালীদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে মর্মে অভিযোগ আছে। ফলে দিন-দুপুরে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও ভুক্তভোগীদের যেন কিছুই করার নেই। প্রথমত: ভুক্তভোগীরা কেউ নালিশ জানালে তাদের অর্থ পাওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনাটুকুও অনিশ্চিত হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত: রয়েছে উল্টো মামলা, হামলাসহ রোষানলে পড়ার ভয়। তৃতীয়ত: পাসপোর্ট-ভিসা রেডি থাকায় জাহিদুল ইসলাম সপরিবারে দেশত্যাগ করতে পারেন। ফলে দিন-দুপুরে ডাকাতির মতোই নিঃশব্দে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয়ে ‘জেনিভিয়া এক্সপ্রেস শপ’ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজী নন ভুক্তভোগীরা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানায়, ইলেকট্রনিক নেটওয়ার্ক, বিশেষ করে, ইন্টারেনট ব্যবহার করে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, অর্থ লেনদেন ও ডাটা আদান-প্রদানের মাধ্যমে কার্যক্রম সম্পাদনের নামই হচ্ছে ‘ই-কমার্স’। ই-মেইল, ফ্যাক্স, অনলাইন ক্যাটালগ, ইলেকট্রনিক ডাটা ইন্টারচেঞ্জ (ইডিআই), ওয়েব বা অনলাইন সার্ভিসেস ইত্যাদির মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। সাধারণত ই-কমার্স সুসম্পন্ন হয় এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আরেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের (বি টু বি) মধ্যে। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও ভোক্তার (বি টু সি) মধ্যে, ভোক্তা ও ভোক্তার (সি টু সি) মধ্যে। অনেকটা স্বয়ংক্রিয় আদান-প্রদানের এই বিপণন প্রক্রিয়াকে বলা হয়, ই-কমার্স। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ই-কমার্স সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনার মধ্য দিয়ে মানুষের নির্ভরতা তৈরি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের এ বিষয়ে ধারণা অস্পষ্ট। বিশেষত: ই-কমার্সের নামে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি ঘটনার পর এমন ধারণাই বদ্ধমূল হয়েছে যে, ই-কমার্স মানেই প্রতারণা। টাকা হাতিয়ে নেয়া। অহরহ ঘটছেও তাই। ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, কিউকম, ধামাকা শপিং ও দালাল প্লাসের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। অর্থ হাতিয়ে নেয়ার পর এ নিয়ে হৈ চৈ পড়ে যায়। মামলা হয়। কিন্তু গ্রাহক যে টাকা খুইয়েছেন সেটি তারা আর ফেরত পান না। যে কারণে প্রতারিত গ্রাহকরা প্রতিকার চাইলেও মামলা দায়ের কিংবা গণমাধ্যমে প্রচারনায় আগ্রহী নন।

সূত্রমতে, ই-কমার্স প্রতারণা রোধ এবং জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে সম্প্রতি ডিজিটাল বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর (ডিবিআইডি) গ্রহণের বিধান করা হয়েছে। কিন্তু এই বিধানে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধারের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। বলা হয়েছে, আত্মসাৎকৃত অর্থ আদায়ের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করবেন আদালত। অর্থাৎ, বিষয়টিকে ‘আদালতি ব্যাপার’ করে রাখা হয়েছে। যা ই-কমার্স প্রতারকদের জন্য পোয়াবারো। অর্থ আত্মসাৎকারীরা বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রির ষোলোআনা সুবিধা নিচ্ছে। দেদারসে অর্থ হাতিয়ে নিলেও আপাতত কোনো টাকা গ্রাহককে ফেরত দিতে হচ্ছে না। ই-অরেঞ্জ, ই-ভ্যালি গ্রাহকরা একাধিক মামলা করলেও একটি টাকাও ফেরত পাননি।

নানা প্রলোভনে টাকা নিলেও ওই টাকা গ্রাহককে ফেরত দিতে হয় না-এমন দৃষ্টান্তই উদ্বুদ্ধ করে জাহিদুল ইসলামকে। এক সময় ডেসটিনি করা জাহিদুল ইসলাম সেই দীক্ষা থেকে মেয়ে জেনিভিয়া ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘জেনিভা এক্সপ্রেস শপ’। ওয়েবসাইটে ঠিকানা দেয়া হয়েছে, হাউস নং-১২/১৩, ব্লক-এফ, আজিজ মহল্লা, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭। বাহ্যত এটি রেডিমেড তৈরি পোশাক, কসমেটিকসহ বিভিন্ন গৃহসামগ্রি বিক্রয় প্রতিষ্ঠান। প্রকৃতপক্ষে ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, আলেশা মার্টের মতো নিছক অর্থ হাতিয়ে নেয়াই যাদের উদ্দেশ্য। আজ ১ লাখ টাকার পণ্য কিনলে ৩ মাস পর পণ্য সরবরাহ কিংবা পণ্যের পরিবর্তে দ্বিগুণ টাকা ফেরত দানের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। আস্থায় নিতে প্রথম প্রথম কিছু পণ্য সরবরাহও করেন। প্রথম প্রলুব্ধ করেন নিজ আত্মীয়-স্বজনদের। তাদের মাধ্যমে আকৃষ্ট করেন দূর সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনকে। পিরামিড পদ্ধতিতে একজনকে দিয়ে আরো ১০ জনকে সম্পৃক্ত করা হয়। করোনাকালিন দুই বছর কর্মহীন মানুষ ‘জেনিভিয়া এক্সপ্রেস শপ’র ঘরে বসে অর্থ আয়ের প্রলোভনে ব্যপকভাবে প্রলুব্ধ হন। এ সময় অর্থকষ্টে সাধারণ মানুষ যখন মানবেতর জীবন যাপন করছিলেন, তখন ‘জেনিভিয়া এক্সপ্রেস শপ’র সংশ্লিষ্টরা টাকা হাতিয়েছেন বস্তা বস্তা। করোনার প্রকোপ হ্রাস পেলে বিনিয়োগকারীরা তাদের প্রতিশ্রুত পণ্য কিংবা সম অঙ্কের টাকা ফেরত চাইতে ভিড় জমান। তখনই বন্ধ করে দেয়া হয় জেনিভা এক্সপ্রেস শপের কার্যক্রম। বিনিয়োগকারীরা এখন তাদের পাওনা চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। ভুক্তভোগীদের অনেকেই আশু প্রতিকার চেয়ে স্মরণাপন্ন হয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও এখন পর্যন্ত অনুসন্ধান কিংবা তদন্ত শুরু করেনি সংস্থাটি। অনুসন্ধান তদন্তে প্রতিষ্ঠানটির আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতায় হতাশ হয়ে পড়েছেন অভিযোগকারীরা।

মোহাম্মদপুর, আজিজ মহল্লার ভুক্তভোগী আমিনুর রহমানের অভিযোগ করেন, জাহিদুল ইসলামের এক আত্মীয়ের পরিচয়ে তিনি করোনকালে ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন ‘জেনিভা এক্সপ্রেস শপ’ এ। আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি একটি টাকাও ফেরত পাননি।

লিখিত অভিযোগে এই ভুক্তভোগী আরো জানান, স্থানীয় বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম ও তার স্ত্রী জেসমিন আক্তার কয়েক বছর ধরে ই-কমার্সের নামে মূলত এমএলএম প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সামনে জাহিদ এবং তার স্ত্রী থাকলেও নেপথ্যে রয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। জাহিদের স্ত্রীর বড় বোন শাহীন আক্তার সাথী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৯, ৩০ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত কাউন্সিলর। তিনি সরকার দলীয় স্থানীয় নেতা ওমর ফারুক মাস্টারের স্ত্রী। তাদের আত্মীয় পরিচয়ে জাহিদুল ইসলাম দম্পত্তি ‘জেনিভা এক্সপ্রেস শপ’র মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। হাতিয়ে নেয়ার এ অর্থের চূড়ান্ত গন্তব্য অনেক উপরে। সেই ‘উপর মহলই’ এ চক্রকে সার্বিক নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন বলে জানা যায়।

দুদকের অভিযোগে বলা হয়, কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার আগে সাথীর জীবন-যাপন ছিল সাদা-সিধে। কিন্তু কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর তিন বছরে ৩টি বাড়ির মালিক হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, তার এক আত্মীয়ের একটি দোতলা বাড়ি (নং-১০৩৫, রোড-১৭/এ, বাইতুল আমান রোড, উত্তর আদাবর, মোহাম্মদপুর,ঢাকা।) দখল নিয়ে কার্যালয় স্থাপন করেছেন। এছাড়া মোহাম্মদপুর এলাকায় স্বামী ওমর ফারুকের আছে ডজন খানেক বাড়ি। এর মধ্যে, বাড়ি নং-১৬/১৭, টিক্কাপাড়া, ৬ তলা একটি ভবন। বাড়ি নং-৮৫/সি/২, ব্লক-সি, মোহাম্মদপুর,আদাবর, শেখের টেক, শ্যামলী হাউজিং। রাণী মঞ্জিল, বাড়ি নং-৭/২, ২য় প্রকল্প, ৮ তলা ভবন। আদাবর, মোহাম্মদপুর, ঢাকা। বাড়ি নং-২৫/৪/এ, ব্লক-বি, বিজলি মহল্লা, জান্নাত বাগ বাই লেন, মোহাম্মদপুর, ঢাকা অন্যতম। এসবই ‘অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ’ বলে উল্লেখ করা হয়, দুদকে জমা দেয়া অভিযোগে। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয় কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। প্রক্রিয়া সম্পাদনে কিছুটা সময় লাগে। অভিযোগ যদি তফসিলভুক্ত অপরাধের মধ্যে পড়ে তাহলে যাচাই-বাছাই কমিটির সুপারিশক্রমে নিশ্চয়ই অনুসন্ধানে আসবে। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যে দলেরই হোন না কেন। আইনে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।

এদিকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে গতকাল শনিবার বিভিন্ন সময়ে ফোন দেয়া হয় ‘জেনিভা এক্সপ্রেস শপ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাহিদুল ইসলামকে। কিন্তু প্রতিবারই তার মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

অন্যদিকে ‘জেনিভা এক্সপ্রেস শপ’র সঙ্গে কোনো ধরণের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত ২৯, ৩০ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহিন আক্তার সাথী। তিনি বলেন, জাহিদ আমার বোনের স্বামী-এ কথা সত্য। কিন্তু তার কর্মকা-ের সঙ্গে আমার কিংবা আমার স্বামীর ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। আমার বোনের বিয়ে আমরা দেইনি। তাদের কোনো দায়-দায়িত্ব কেন আমার ওপর বর্তাবে? আমি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আহতদের একজন। নেত্রী ভালোবেসে আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন। আমি নিজে কখনও কোনো অন্যায় করিনি, অন্যায়কে প্রশ্রয়ও দিই না। ‘জাহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন কি না’-প্রশ্ন করা হলে এই ওয়ার্ড কাউন্সিলর বলেন, যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে, তাদের ৯৫ ভাগই আমাদের আত্মীয়-স্বজন। প্রতারণার শিকার অন্তত ৫০/৬০ জনকে আমি বলেছি যাকে তারা টাকা দিয়েছেন তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার। একজন ব্যক্তিও জাহিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি। তাহলে বলুন, আমি কি করতে পারি?

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Md. Aman Ullah Talukder ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১০:০৯ এএম says : 0
শতকোটি কেন হাজারকোটি নিয়ে গেলেও লোভী মানুষদের ঘুম ভাঙবে না! এটাই বাস্তবতা! এত টাকা লাভ কোন প্রতিষ্ঠানে রাখলে পাওয়া যায় না, তাহলে তারা কোথা থেকে দিবে? তারা কি আলাদিনের চেরাগ (?) হাতে পেয়েছে?
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন