শীতেও চট্টগ্রামে কমেনি লোডশেডিং। রাতে দিনে দফায় দফায় বিদ্যুতের আসা যাওয়া চলছে। তাতে ত্যক্ত-বিরক্ত মানুষ। বিদ্যুতের অভাবে কলকারখানায় উৎপাদনও বিঘিœত হচ্ছে। বার বার বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। কিন্তু গ্রাহক বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। মাঘ মাসের শীতে আবাসিক খাতে চাহিদা কমে গেলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাস, তেল ও পানির অভাবে এই অঞ্চলের ১১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে আছে। তাতে উৎপাদন কমে যাওয়ায় সরবরাহও কমেছে। ফলে মহানগরী থেকে গ্রামে বিদ্যুতের আসা-যাওয়া চলছে। সামনে গ্রীষ্মের তাপদাহ শুরু হবে। আসছে পবিত্র মাহে রমজান। বন্ধ বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু না হলে তখন পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সরকারি হিসাবে বর্তমানে চট্টগ্রামে পিকআওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা এক হাজার এক মেগাওয়াট। আর দিনের অন্য সময়ে এই চাহিদা ৯২০ মেগাওয়াট। তবে বেশির ভাগ সময় ওই চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ মিলছে না। যদিও সরকারি তরফে দাবি করা হচ্ছে যান্ত্রিক ত্রæটিসহ নানা কারণে বিদ্যুৎ সরবাহও বিঘিœত হয়। তবে চট্টগ্রামে বিদ্যুতের লোডশেডিং সহনীয় পর্যায়ে রাখা হয়েছে। গ্রাহকেরা বলছেন, শীতেও লোডশেডিং চলছে। কোনো কোনো এলাকায় রাতে দিনে কয়েক দফা বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। নগরীর ঘনবসতিপূর্ণ এবং শিল্প এলাকাগুলোতে প্রায়ই বিদ্যুতের আসা-যাওয়া চলছে।
এতে জনজীবন ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যুতের অভাবে কলকারখানায় উৎপাদনের চাকা থমকে যাচ্ছে। বৈশি^ক অর্থনৈতিক মন্দা এবং সেই সাথে দেশে অব্যাহত ডলার সঙ্কটে শিল্পকারখানাগুলো নানামুখি সঙ্কটে পড়েছে। তার উপর বিদ্যুতের সঙ্কট পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলেছে। বিকল্প উপায়ে উৎপাদনের চাকা সচল রাখতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। তাতে লোকশান গুণছেন শিল্প মালিকেরা। বিদ্যুৎখাতে উন্নয়নে বিগত দেড় দশকে চট্টগ্রামে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তার সুফল পাচ্ছে না। এই অঞ্চলে গড়ে উঠা বেশির ভাগ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্যাস ও তেল নির্ভর। ডলার সঙ্কটে তেল-গ্যাসের আমদানি কমে যাওয়ায় এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র সচল রাখা যাচ্ছে না। নতুন নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলেও পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে সংস্কার না করায় উৎপাদন ক্ষমতা কমে গেছে। এতে একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হচ্ছে।
পিডিবির তথ্য বলছে এখন এই অঞ্চলে ১১টি কেন্দ্র বন্ধ আছে। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ৯১৭ মেগাওয়াট। সচল ১৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে মিলছে ৮০০ থেকে সোয়া ৮০০ মেগাওয়াট। উৎপাদন ক্ষমতা আরো বেশি হলেও সচল এসব কেন্দ্রের অনেকগুলো জরাজীর্ণ। কোন রকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। আবার গ্যাস ও তেল সাশ্রয়ে চালু বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো দিনের বেলায় বেশির ভাগ সময় বন্ধ রাখা হচ্ছে। পিকআওয়ারে কয়েক ঘণ্টার জন্য এসব কেন্দ্র চালু রাখা হচ্ছে। বন্ধ ১১টির মধ্যে গ্যাস ও তেল সঙ্কটের কারণে ৫টি কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। কাপ্তাই এবং টেকনাফ সোলার প্ল্যান্ট দুটি বন্ধ রয়েছে দীর্ঘ দিন থেকে। এছাড়া পানি স্বল্পতায় দেশের একমাত্র পানিবিদ্যুৎ মহাপ্রকল্প কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫টি ইউনিটের মধ্যে ৪টি ইউনিটই বন্ধ রয়েছে। সেখানে ২ নম্বর ইউনিট থেকে মাত্র ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। কাপ্তাই হ্রদে পানির স্তুর নিচে নেমে যাওয়ায় সব ইউনিট চালু রাখা যাচ্ছে না। সর্বশেষ রোববার সেখানে পানির লেভেল ছিল ৮৩.২৪ এমএসএল। থাকার কথা ৯৬.৫৮ এমএসএল।
রাউজান ২১০ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৪২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। গ্যাস সঙ্কটের কারণে এখন দুটি কেন্দ্রই বন্ধ রয়েছে। ১৫০ মেগাওয়াটের শিকলবাহা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ রয়েছে। সেখানে সচল ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার সিসিপিপি কেন্দ্র থেকে সরবরাহ মিলছে ১৫২ মেগাওয়াট। একই এলাকার ৫৫ মেগাওয়াট অপর কেন্দ্র থেকে সরাবরাহ পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১৭ মেগাওয়াট।
২৪ মেগাওয়াটের রিজেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট, ১০০ মেগাওয়াটের এনার্জি প্যাক বন্ধ রয়েছে। ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দোহাজারী কেন্দ্র থেকে ৬৮ মেগাওয়াট এবং ১০০ মেগাওয়াট হাটহাজারী কেন্দ্র থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৩০ মেগাওয়াট। ফার্নেস অয়েল চালিত এই দুটি কেন্দ্র পুরোদমে সচল রাখা যাচ্ছে না। জুলদা ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ৭২ মেগাওয়াট, ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ইউনাইটেড থেকে দুই মেগাওয়াট, ২৬ মেগাওয়াট আরপিসিএল থেকে ১৭ মেগাওয়াট, ৫০ মেগাওয়াট বারাকা থেকে ৩২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে।
সব মিলিয়ে চট্টগ্রামে পিকআওয়ারে বিদ্যুতের সরবরাহ মিলছে আটশ’ থেকে সাড়ে নয়শ’ মেগাওয়াট। এসময়ে চাহিদা প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট। এই ঘাটতি পূরণে মাঝে মধ্যে জাতীয় গ্রিড থেকে সরবরাহ দেয়া হয়। আবার কখনো চট্টগ্রাম থেকে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ দেয়া হয়। ফলে প্রায়ই চট্টগ্রামে চাহিদার চেয়ে কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হচ্ছে। এতে জনভোগান্তি বাড়ছে।
গত আগস্ট থেকেই মূলত দেশের অন্য এলাকার মতো চট্টগ্রামেও বিদ্যুতের সঙ্কট শুরু হয়। অক্টোবরে পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়। নভেম্বরের শেষ দিকে এসে শীতের প্রকোপ বাড়লে বিদ্যুতের চাহিদা কমতে থাকে। তাতে লোডশেডিং কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে আসে। তবে শীতের প্রকোপ কমছে, সেই সাথে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ছে। আর তাতে ঘাটতিও বেড়ে চলেছে।
পিডিবি চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম বলেন, লোডশেডিং থাকলেও তা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। কারণ শীতকাল হওয়ায় চাহিদা কিছুটা কম। তবে গরমে চাহিদা বাড়লে লোডশেডিং বাড়বে। আর এ জন্য বন্ধ কেন্দ্র সচল করাসহ উৎপাদন বাড়াতে নানামুখি উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন