শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

বিষাক্ত বাতাসে ঢাকাবাসীর বসবাস

টানা কয়েকদিন বায়ুদূষণে শীর্ষে ঢাকা ক্যান্সারসহ নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ছে দূষণের মাধ্যমে মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে-হাইকোর্ট রাজধানীবাসীর গড় আয়ু ৮ বছর করে কমছে

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

ঢাকার বাতাস খুবই অস্বাস্থ্যকর। বলা যায় ঢাকাবাসী এখন বিষাক্ত বাতাসে বসবাস করছে। গত কয়েকদিন যাবৎ বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরে শীষে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর ২৪৬ নিয়ে গতকাল ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় শীর্ষে। এ স্কোর অনুযায়ী বাতাসের মান ধরা হয় ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’। গত রোববার বায়ুর মান সূচক ২৩০ নিয়ে ঢাকা ছিল দূষিত শহরের শীর্ষে। বায়ুর মান বিচারে এ পরিস্থিতি খুবই অস্বাস্থ্যকর।
একিউআই স্কোর ১৯৩ নিয়ে চীনের উহার শহর গতকাল ছিল দ্বিতীয় স্থানে এবং ১৮২ স্কোর নিয়ে ভারতের মুম্বাই ছিল দূষিত শহরের তৃতীয় স্থানে। ১০১ থেকে ২০০-এর মধ্যে একিউআই স্কোরকে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে মনে করা হয়। ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকা একিউআই স্কোরকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ এবং অসুস্থ রোগীদের বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। অন্যদিকে ৩০১ থেকে ৪০০-এর এর মধ্যে থাকা একিউআই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়, যা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে।

চলতি বছরের শুরু থেকে ঢাকা প্রায়দিনই দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় শীর্ষে থাকছে। বলা যায় গত মাসে একদিনও বিশুদ্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারেনি ঢাকাবাসী। প্রতিদিনই বিষে ভরা বাতাস নিশ্বাস নিচ্ছেন এ নগরবাসী। তাতে বাড়ছে স্বাস্থ্যগত সমস্যাও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণ শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। দীর্ঘদিন বায়ুদূষণের মধ্যে থাকলে বা এরকম পরিবেশে কাজ করলে ফুসফুসের ক্যান্সার এবং হৃদরোগের দেখা দিতে পারে। এমনকি সেটা মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও তৈরি করতে পারে। বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে তার অধিকাংশই বায়ু দূষণজনিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণের কারণে বছরে ৪২ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের সা¤প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, বায়ুদূষণে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু কমেছে ৭ বছর। আর রাজধানীবাসীর গড় আয়ু কমছে ৮ বছর করে। ওই গবেষণায় বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে।

অপরিকল্পিত নগরায়ন, অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন ও শিল্পকারখানা স্থাপনের ফলে রাজধানীর বাতাসে যুক্ত হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন, হাইড্রোকার্বন, বেনজিন, সালফার ও ফটোকেমিক্যাল অক্সিডেন্টস। জ্বালানির দহন, বনভ‚মি উজাড় প্রভৃতি কারণে বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। কলকারখানা, মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরযানের অনিয়ন্ত্রিত কালো ধোঁয়া বাতাসে সবচেয়ে বেশি কার্বন-মনোক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাসের বিস্তার ঘটায়। এসব উৎস থেকে সৃষ্ট মিথেন, ইথেলিন বাতাসে মিশ্রিত হয়ে প্রাণিদেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এসবেস্টস আঁশ, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট নির্মাণ থেকে ধুলাবালি, সিগারেটের ধোঁয়া ও কীটনাশক স্প্রের কণা বাতাসকে দূষিত করে মানবদেহে ক্যান্সারসহ অ্যালার্জিজনিত নানা জটিল রোগের সংক্রমণ ঘটায়। শুধু ধুলার মতো কঠিন পদার্থ ছাড়াও দূষিত তরল বর্জ্য থেকে বাতাস অধিকতর দূষিত হয়ে থাকে। চামড়া শিল্প, রঙ কারখানা, রাসায়নিক গবেষণাগার, পয়ঃশোধনাগার থেকে উৎপন্ন হাইড্রোজেন সালফাইড জীবজগতের অস্তিত্বের ওপর হুমকিস্বরূপ।

ঢাকার বাতাসে সিসাজনিত দূষণ জাতিসংঘের গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে কমপক্ষে হাজার গুণ হওয়ায় ঢাকায় বসবাসকারী মানুষ শ্বাসকষ্ট ও ফুসফুসের নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু শ্বাসকষ্টজনিত জটিল সমস্যার শিকার হয় এই বায়ুদূষণে। ইউনিসেফ বলছে, বিশ্বে ৩০ কোটি শিশু দূষিত বায়ু অধ্যুষিত এলাকায় বাস করে, যার মধ্যে ২২ কোটিই দক্ষিণ এশিয়ায়। বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর শ‚ন্য থেকে ৫ বছর বয়সী ৬ লাখ শিশুর মৃত্যু ঘটে। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে বাধা, স্নায়বিক ক্ষতি এবং গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। ঢাকার অবস্থা পর্যালোচনা করে বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, পারিপার্শ্বিক বায়ুদূষণের কারণে বছরে মারা যায় সাড়ে ৬ হাজার মানুষ এবং আবাসিক দূষণের কারণে বছরে সাড়ে চার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে।

বায়ু দূষণ রোধে আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন না করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে হাইকোর্ট। গত ৫ ফেব্রæয়ারি বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, দূষণের মাধ্যমে মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে। বায়ু দূষণের হাত থেকে মানুষকে বাঁচান। আদালত বলেন, উচ্চ আদালত বায়ু দূষণ রোধে যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তার ছিটেফোঁটাও বাস্তবায়ন হয়নি। অবৈধ ইটভাটাও বন্ধ করা হয়নি। দূষণের মাধ্যমে মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে। অনেকে বিদেশে থাকেন, তাদের ছেলে মেয়েরাও বিদেশে থাকে। ঢাকার বায়ু দূষণে তাদের কিছু আসে যায় না। কিন্তু আমরা তো এ দেশেই থাকি। এ দেশেই থাকতে হবে। বায়ু দূষণের হাত থেকে মানুষকে বাঁচান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন