শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

তুরস্কে মানবিক বিপর্যয়

খাদ্য-পানীয় সঙ্কটের সাথে ঠান্ডার প্রকোপ নিহত বেড়ে ১৭০০০:: এখনো উদ্ধার হচ্ছে আটকেপড়ারা :: ক্ষীণ হয়ে আসছে বেঁচে থাকার আশা :: বাংলাদেশে এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন :: উদ্ধারের ধীরগতিত

ইনকিলাব ডেস্ক : | প্রকাশের সময় : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

তুরস্কে ভূমিকম্পে আটকেপড়াদের উদ্ধারে ধীরগতি, প্রচন্ড ঠান্ডা, উদ্ধার যান এবং সর্বোাপরি খাদ্য-পানীয়র অভাবে চরম মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। খোদ তুর্কিয়ে প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান উদ্ধার কাজের ধীরগতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সময় যত গড়াচ্ছে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা মানুষের বেঁচে থাকার আশা অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে আসছে। তবে উদ্ধারকারীরা হাল না ছেড়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এখনো জীবিত থাকাদের উদ্ধারে। সফলতাও আসছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উড়ে আসছে ত্রাণবাহী বিমান। সাথে আসছে উদ্ধারকারী দল ও যান। তবে উপদ্রুত এলাকার রাস্তাঘাট তছনছ হয়ে যাওয়ায় সেগুলো পৌঁছাতে বেগ পেতে হচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশে গতকাল একদিনের রাষ্ট্রীয় শোকদিবস পালন করা হয়েছে। আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ শক্তিশালী এ ভূমিকম্পের শিকার হয়েছেন বলে ধারণা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। এতে মৃত্যুর সংখ্যা কয়েক গুণ বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি। গত সোমবার তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চল এবং সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় দুটি ভয়াবহ ভূমিকম্পে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত প্রায় ১৭ হাজার মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সময় যতই যাচ্ছে, লজিস্টিক ও পর্যাপ্ত ত্রাণ সুবিধার অভাবে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া মানুষদের বাঁচানোর আশা হতাশায় পরিণত হচ্ছে। ত্রাণের স্বল্পতা এবং ধীরগতির কারণে জনগণের সমালোচনার খবরাখবর গণমাধ্যমে উঠে আসছে। নজিরবিহীন ওই ভূমিকম্পে বহু নিহত মানুষ এখনও ধ্বংসস্তুপের নীচে আটকা পড়ে আছে।

ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ার নাগরিকদের মৃত্যুতে গতকাল বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ১ (এক) দিনের শোক পালন করা হয়েছে। এ উপলক্ষে গতকাল বাংলাদেশের সকল সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশস্থ বাংলাদেশ মিশনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং নিহতদের রূহের মাগফিরাত কামনায় দেশের সকল র্ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়।

তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেন, তার দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য দুটি অতিরিক্ত সীমান্ত গেট খুলে দিতে কাজ করছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেইন বলেন, সোমবারের ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত সিরিয়া ও তুরস্কে আন্তর্জাতিক সহায়তা পাঠানোর বিষয়ে আগামী মার্চে একটি সম্মেলনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। গত ২৪ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ইস্তাম্বুল স্টক এক্সচেঞ্জ জানায়, ভূমিকম্পের প্রেক্ষিতে এটি পাঁচ দিন বন্ধ থাকছে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান দুর্যোগ কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। বড় ধরনের ভূমিকম্পের পর দেশটিতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ অপর্যাপ্ত বলে স্বীকার করেছেন তিনি।
কাহরামন মারাশ এলাকার এক তুর্কি অধিবাসী বলেছেন: তার ১৩ ও ১৫ বছর বয়সী ২ সন্তান এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছে। তারা মহাবিপদে আছেন বলে তিনি হাহাকার ব্যক্ত করেন। ওই তুর্কি নাগরিক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সাহায্যের আবেদন জানান। অপর এক তুর্কি নাগরিক বলেন: ‹৩ দিন ধরে অপেক্ষায় আছি, যদি ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ফেলা হতো তাহলে হয়তো সন্তানকে জীবিত পেতাম’। আরেকজন নাগরিক উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার ধীর গতির সমালোচনা করেন। তিনি বলেন: যত দ্রুত সম্ভব ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ফেলা উচিত। তা না করে সবাই কেবল ঘুরে বেড়াচ্ছে। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত ২৮ হাজার মানুষকে নিরাপদ এলাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে।

গত বুধবার তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের ইস্কেন্দেরুন শহরের একটি ভবনের ধ্বংসস্তূপে উদ্ধারকাজ চালানোর সময় এক পর্যায়ে উপস্থিতদের নীরব থাকার অনুরোধ করেন উদ্ধারকারীরা। সেসময় ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে আসা শব্দ থেকে তারা ধারণা করেন যে, সেখানে জীবিত মানুষ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ঐ ভবনে বসবাসকারী পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীরা উদ্ধারকাজ দেখতে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষও কিছুক্ষণের জন্য কথা বলা বন্ধ করে দেন। আশেপাশের ক্রেন ও উদ্ধারকাজে ব্যবহৃত অন্যান্য যন্ত্রপাতি বন্ধ করে দেয়া হয়।

কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পর উদ্ধারকারী দলের কয়েকজন অ্যাম্বুলেন্স ডাকার আহ্বান জানান। তারা জানান যে, ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে এক নারীকে জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেছে। উদ্ধারকারীদের কাছ থেকে এ ঘোষণা আসার সাথে সাথে উপস্থিত জনতা আনন্দে হর্ষধ্বনি করে ওঠে। অনেকেই চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন জানান, সোমবার ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হওয়ার পর ঐ ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রথম কোনো জীবিত ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হল। এ ঘটনার পর স্বজনের খোঁজ না পাওয়া অনেকের মধ্যেই নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। অনেকেই বলছেন যে, তাদের পরিচিতদের জীবিত উদ্ধার করা যাবে - এমন আশা ফিরে পেয়েছেন তারা।

এক নারীর ভাষ্যে, তিনি ‘অলৌকিক’ কিছুর জন্য অপেক্ষা করছেন। এ বিচ্ছিন্ন ঘটনাটি সেখানকার উদ্ধারকর্মীদের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য প্রাণসঞ্চার করে।
স্থানীয় চিকিৎসক মেহমেত রিয়াত বলেন, সোমবার থেকে বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক ও সেবা দানকারী উদ্ধার হওয়া মানুষের চিকিৎসায় কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এমন রোগী পেয়েছি যারা প্রায় পিষে গেছে। আমরা এ ক’দিন শুধু ভাঙা হাড়, ভাঙা ঘাড়, মাথায় আঘাত দেখেছি। আর দেখেছি অনেক অনেক মৃত্যু’।
ইস্কেন্দেরুন শহরের যেখানেই তাকান আপনি শুধু ধ্বংসস্তূপই দেখতে পাবেন। এখানে একটি ব্যস্ত হাসপাতাল সহ বহু ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে।

সমালোচকদের অভিযোগ, উদ্ধারকাজের সহায়তার উদ্দেশ্যে নেয়া জরুরি সেবা কার্যক্রম ধীরগতিতে চলছে এবং ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট জনাব এরদোগান গত বুধবার এক বক্তব্যে বলেন, শুরুর দিকে উদ্ধার তৎপরতা কিছুটা ধীরগতির হলেও এখন পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণে’ রয়েছে। তবে তিনি এমনও বলেছেন যে: ‘এত বড় মাপের দুর্যোগের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নেয়া সম্ভব নয়’।
গত সোমবার ভোরে তুরস্কের দক্ষিণের শহর গাজিয়ানটেপ শহরের কাছে ৭.৮ মাত্রার এই ভূমিকম্প আঘাত হানে, যাতে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৭ হাজার মানুষ মারা গেছে বলে জানা যাচ্ছে।

তুরস্ক বা সিরিয়ায় ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত কাউকে বের করা যেন এক অলৌকিক ঘটনা৷ এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুরের সহায়তা নেয়া হচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে উদ্ধার-কাজে রোবট ব্যবহার করা হতে পারে। বিভিন্নভাবে ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া জীবিতদের উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে। যেখানে জীবিত মানুষ পাওয়ার সম্ভাবনা, উদ্ধারকারীরা সেখানে সরাসরি তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। চিৎকার করে অবস্থান জানানোর পাশাপাশি মোবাইল ফোন থেকে পরিবারের সদস্যদের বার্তা দেয়ারও অনুরোধ করছেন উদ্ধারকারীরা। তবে এ ধরনের উদ্ধার তৎপরতায় সাধারণত আধুনিক যন্ত্রপাতির ওপর নির্ভর করতে হয়। নতুন নতুন অনেক সরঞ্জাম যুক্ত হচ্ছে উদ্ধার কাজে। গত মঙ্গলবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক প্রকল্পের আওতায় ধ্বংসস্তূপ থেকে মানুষ উদ্ধারে রোবট ও ড্রোন ব্যবহারের কথা জানিয়েছে। অনুসন্ধান অভিযানে রোবোটিক সরঞ্জাম ও উন্নত সেন্সর সমন্বিত ইনফ্রারেড এবং থার্মাল ক্যামেরার মাধ্যমে ধ্বংসস্তূপের মাঝে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং মানুষের প্রোটিন বাতাসে পরীক্ষা করা হবে। ফলে জীবিত কেউ থাকলে তা জানা সম্ভব হবে। এরপর উদ্ধারকারীরা লাউডস্পিকার এবং মাইক্রোফোনের সাহায্যে সম্ভাব্য বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবেন। এ ক্ষেত্রে জীবিত ব্যক্তির অবস্থান নির্ণয়ে ড্রোনের নেয়া থ্রি-ডি চিত্র কাজে আসবে। দুটি প্রকল্পের আওতায় কিছু রোবটের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। এর ফলে ভবিষ্যতে ভূমিকম্পে উদ্ধার-কাজে রোবট ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সত্যিকার ভূমিকম্পের উদ্ধারে রোবট এখনো ব্যবহৃত হয়নি। এছাড়াও ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপে ব্যবহার করতে হলে নতুন করে রোবট তৈরি করতে হবে, যা অনেক ব্যয়বহুল। এ কারণে সিরিয়া ও তুরস্কের উদ্ধার তৎপরতায় এগুলো ব্যবহার করার কোনো সম্ভাবনা নাই। তাই আপাতত উদ্ধারকারী কুকুরের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সূত্র : বিবিসি, আল-জাজিরা, ডিডব্লিউ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (6)
Mojammel Haque ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১১:১০ এএম says : 0
ইয়া রব এই অসহায় মানুষদের আপনি দয়া করুন মালিক।
Total Reply(0)
She ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১১:১০ এএম says : 0
· দেখার কেউ নেই,,শোনার কেউ নেই,,,একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসাই বিপদ থেকে উত্তোরনের উপায়,,,হে আল্লাহ তাদের রক্ষা করুন।
Total Reply(0)
M. Asad ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১১:১০ এএম says : 0
নবীজি যা বলছে তাই সত‍্য হলে কিয়ামতের বার বার ভূমিকম্প হবে।
Total Reply(0)
Kire ariyan ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১১:১০ এএম says : 0
· ১৭ সেকেন্ডের ভূমিকম্পের আগে লোকটি ছিলো বাড়ির মালিক। আর সেই লোকই ১৭ সেকেন্ড পর একটি রুটিরও মালিক না। অন্যের দেওয়া রুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। #PrayForTurkeyAndSyria
Total Reply(0)
Kamrun Nahar Lipi ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১০:০৭ এএম says : 0
· বিপদ-আপদের সময়, দুনিয়ার সকল দরজা বন্ধ থাকলেও,আল্লাহ তায়ালার দরজা সবসময় খোলা থাকে,হে আল্লাহ আপনি সকল মানুষদের হেফাজত করুন,আমীন।
Total Reply(0)
Zakiul Islam ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১০:৩৪ এএম says : 0
দয়া করে ফেক নিউজ ছাপাবেন না । তুরস্ক তার সর্ব শক্তি নিয়োগ করে জনগণ কে উদ্ধার করছে । দুর্গত এলাকার আয়তন প্রায় পুরু বাংলাদেশের সমান । এটা যে কত বড় বির্পযয় তা সেখান কার লোকজন রাই বুঝতে পারছে । কোন দেশের পক্ষেই এর চেয়ে দ্রত উদ্ধার কাজ চালানো সম্ভব হতো না । পশ্চিমাদের চোখের বালি এরদোয়ান তাদের লক্ষ্য । তার নেতিবাচক ইমেজ তুলে ধরাই পশ্চিমাদের উদ্দেশ্য ।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন