মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে গৌতম আদানি ছিলেন বিশ্বের তৃতীয় ধনী ব্যক্তি। কিন্তু গত ২৪ জানুয়ারি তার শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলে এবং শেয়ার জালিয়াতির অভিযোগ এনে এ কর্পোরেট টাইটানিকে আঘাত হেনেছে সংক্ষিপ্ত-বিক্রেতা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ। আদানি সদুত্তর দিতে না পারায় বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে যান এবং তার সম্পদের বাজারম‚ল্য ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার হ্রাস পায়। সাত দিনের একটু বেশি সময়ের মধ্যে আদানির ব্যক্তিগত সম্পদেও কোটি কোটি টাকার মন্দা ঘটেছে। এর শেয়ারের দাম কমেছে এবং অর্থায়ন পরিকল্পনা ব্যাহত হয়েছে। আদানির কারণে বাজারে সৃষ্ট অস্থিরতা ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং আদানির ঘনিষ্ঠ সহযোগী নরেন্দ্র মোদিকে রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এবং এটি বছরের পর বছর ধরে চলে আসা ভারতীয় পুঁজিবাদ ও অর্থনীতিকে কঠোরতম পরীক্ষার সম্মুখীন করেছে। আদানির বিস্তৃত সাম্রাজ্য লাখ লাখ ভারতীয়দের দৈনন্দিন জীবিকাকে জড়িয়ে নিয়েছে। কারণ এটি ভারতের কিছু বড় বন্দর চালায়, তার শস্যের এক তৃতীয়াংশ সংরক্ষণ করে, তার বিদ্যুৎ সরবরাহের এক পঞ্চমাংশ পরিচালনা করে এবং তার সিমেন্টের এক পঞ্চমাংশ তৈরি করে। তিনি দেশের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলোর প্রভাবশালী পরিচালক। তার সংস্থা মুম্বাইতে একটি নতুন বিমানবন্দর এবং গুজরাটের স্টিল কারখানার মতো জিনিসগুলোতে ৫ হাজার কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে। যদিও, আদানি গ্রæপ বলেছে যে, তাদের নির্মাণাধীন সব প্রকল্প সম্পন্ন করার জন্য যথেষ্ট নগদ রয়েছে। কিন্তু এর ঋণ জর্জরিত উন্মত্ত সম্প্রসারণের রূপটি এখন সর্বজনবিদিত। যখন তার বিনিয়োগগুলোতে ঘাপলা ঘটবে, তখন জাতীয় প্রকল্পগুলো আবারও অর্ধ-সমাপ্ত রয়ে যাবে।
নরেন্দ্র মোদির সাথে আদানির গাঁটছড়া কয়েক দশক আগে গুজরাটে তৈরি হয়েছিল, যে রাজ্যে মোদি ২০০১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং যেখানে আদানি তার বানিজ্য শুরু করেছিলেন। মোদি যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তিনি শপথ নিতে আদানির ব্যক্তিগত বিমানে চড়ে দিল্লি যান। তখন এবং হিন্ডেনবার্গ প্রতিবদেন প্রকাশের মধ্যকার সময়ে আদানির ব্যক্তিগত ভাগ্য প্রায় ৭শ’ কোটি ডলার থেকে ১২হাজার কোটি বিলিয়ন পর্যন্ত বেড়েছে। সরকার তার পক্ষপাতিত্বের উপর লাগাম টেনে বড় বড় ব্যবসাগুলো যাচাই বাছাই করে শুরু করতে পারত। যদি হিনডেনবার্গের মতো একটি ক্ষুদ্র মার্কিন সংস্থা কঠিন প্রশ্ন তুলতে পারে, তাহলে ভারতের বানিজ্য নিয়ন্ত্রকরা কেন করেনি? হিন্ডেনবার্গ অভিযোগ করেছে যে, ভারতের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড, দেশের বাজারের ওপর নজরদারি করা সংস্থাগুলো ২০২১ সালে আদানি সম্পর্কে তদন্ত শুরু করেছিল, তবে তখন থেকেই মুখে কূলুপ এঁটেছে।
মোদি তার মিত্র আদানি এবং ভারতের বর্তমান অস্থিতিশীল বাজার সম্পর্কে নীরব থাকলেও, তার মন্ত্রীরা বিনিয়োগকারীদের বলছেন যে, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলো অক্ষত রয়েছে। কিন্তু, ব্যবসা করার জন্য ভারত যে একটি নির্ভরযোগ্য জায়গা, তা দেখানোর জন্য তাদের এর থেকেও বেশি কিছু করতে হবে। বিশ^ বাণিজ্যে ভারতের দ্রæত বৃদ্ধি ঘটাতে হলে, মোদি সরকারকে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পুঁজি আনতে হবে, আংশিক কারণ হ’ল, দেশটি এখন চলতি হিসাবের ব্যাপক ঘাটতিতে রয়েছে। নরেন্দ্র মোদির সরকার এখন প্রলুব্ধ হতে পারে আদানিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন দিতে। কিন্তু আদানির পতন বিদেশী বহুজাতিক সংস্থাগুলো এমন দেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে সতর্ক হয়ে উঠেছে, যেখানে শাসনব্যবস্থাকে জবাবদিহীতায় আনা যায় না। কারণ এখানে লাইসেন্স ত্বরান্বিত করার নীতিও পক্ষপাতিত্বে পতিত হতে পারে। আরেকটি বিপদ হল যে, মোদি যাকে তার উন্নয়নের নায়ক হিসেবে বাছাই করে থাকেন, সে তার প্রতিশ্রæতি প‚রণ নাও করতে পারে।
মোদির শাসনকাল অনেকভাবে ভারতের সার্বিক ভারসাম্য নষ্ট করেছে। তার সরকার আদালত ও পুলিশের স্বাধীনতা ক্রমাগতভাবে খর্ব করেছে। গণমাধ্যম বেশিরভাগই শক্তিশালীদের তদন্ত করতে খুব ভয় পায়। খুব কম ভারতীয় সংবাদপত্র আদানি সম্পর্কে এমন তথ্য তুলে ধরতো, যদি না মার্কিন সংস্থাটি প্রথমে কঠিন প্রশ্ন তুলতো। আদানি নিজেই সম্প্রতি এনডিটিভি কিনে নিয়েছেন, যেটি একসময় সরকারের সমালোচনা করত কিন্তু এখন এটি নিশ্চুপ। ভারতের উন্নতির জন্য এর প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘমেয়াদে তার অবকাঠামোর মতোই গুরুত্বপ‚র্ণ। তাই ভারতের বাজার নিয়ন্ত্রকদের উচিত আদানি সম্পর্কে চলমান তদন্তের অবস্থা জানানো। এবং মরিশাস ভিত্তিক বিনিয়োগ সংস্থাগুলোর কাছ থেকে স্বচ্ছতার দাবি করা উচিত, যা প্রায়শই ভারতীয় শেয়ার বাজারে কেলেঙ্কারির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। সন্দেহ নেই, ভারতীয়রা দূষণমুক্ত জ¦ালানী এবং সমতল রাস্তা থেকে উপকৃত হয়েছে, কিন্তু তাদের জন্য দূষণমুক্ত শাসন এবং সমতল খেলার ক্ষেত্রও প্রয়োজন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন