অবশেষে শিক্ষামন্ত্রী ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গেলেন। দেশের আলেম-ওলামা, মাদরাসার শিক্ষার্থী-শিক্ষক, অভিভাবক ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের চাপের মুখে সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য হলেন। তিনি ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের ভুল তথ্য, ইচ্ছকৃতভাবে ইতিহাস বিকৃতি, মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য বাদ দিয়ে হিন্দুত্ববাদকে অধিক গুরুত্ব দেয়া, বিতর্কিত তত্ত¡, ইসলামবিরোধী ছবি, লেখা দিয়েই প্রকাশ করা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বিতর্কিত দু’টি বই প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
গতকাল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ফরহাদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ ও ‘অনুশীলনী পাঠ’ পাঠ্যপুস্তক দুইটি প্রত্যাহার করা হলো। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি আগের দিনের বক্তব্য ‘বই নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, গুজব ছড়ানো হচ্ছে’ বক্তব্য থেকে সরে গিয়ে গতকাল চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলায় এক উঠান বৈঠকে বলেছেন, এখন থেকে আগের ছাপানো বই দুটি ক্লাসে পড়ানো বন্ধ থাকবে। আমরা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন দুটি বই প্রণয়ন করে দেবো।
এর আগে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের বই দুটিতে সংযোজিত বিতর্কিত তথ্য তুলে ধরে গত ২০ জানুয়ারি দৈনিক ইনকিলাব ‘কী শিখবে শিক্ষার্থীরা?’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিষয়টি নিয়ে আরো একাধিক প্রতিবেদন ইনকিলাব প্রকাশ করে। এ সব প্রতিবেদন প্রকাশের পর ‘বিতর্কিত বই’ নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। দেশের আলেম-ওলামা, মাদরাসার শিক্ষার্থী-শিক্ষক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ বিতর্কিত বইগুলো বাতিলের দাবি জানান। দেশের মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের পেশাজীবী অরাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ও ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দলগুলো বিতর্কিত বইগুলো বাতিলের দাবিতে উচ্চকণ্ঠ হয়ে উঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বিতর্কিত বইগুলো বাতিলের দাবিতে নেটিনেজরা সোচ্চার বক্তব্য দিতে থাকেন। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী নিজের অবস্থানে অটল থাকেন এবং আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে বিয়োদগার করেন।
ইনকিলাবের প্রতিবেদনে বিতর্কিত বইগুলোর পাঠ্যসুচিতে ভুল বানান, অন্যের লেখা চুরির ঘটনা, অসঙ্গতি, নীতি-নৈতিকতাহীন, মুসলিম শাসকদের উপেক্ষা করে হিন্দু শাসকদের গুনগান ও শিশুদের ইসলামবিরোধী কৃষ্টি-কালচার শেখানোর অপকৌশলগুলো তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদন প্রকাশের পর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাফর ইকবাল অন্যের লেখা চুরির কথা স্বীকার করে বিবৃতি দেন। তিনি এ জন্য দু:খ প্রকাশ করেন। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী ডা.দীপু মনি আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে ‘মিথ্য তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো’ এবং ‘স্বাধীনতা বিরোধীরা গুজব ছড়াচ্ছে’ অভিযোগ তোলেন। তার সঙ্গে দিল্লির সেবাদাস কিছু শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী আলেমদের এসব দাবি উপেক্ষা করে নতুন বইয়ে কোনো বিকৃত তথ্য নেই দাবি করে লেখালেখি, বক্তৃতা, বিবৃতি দেন। অন্যদিকে দেশের মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের সবচেয়ে বড় অরাজনৈতিক সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের পক্ষ্য থেকে সারাদেশে মানববন্ধন করা ছাড়াও দাবি অব্যহত রাখাসহ জনমত গঠন করা হয়।
নতুন কারিকুলামে মাদরাসার ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইগুলো প্রকাশের আগেই বিতর্কিত লেখা, ছবি বাদ দেয়ার দাবি জানিয়ে দেশের আলেম-ওলামা ও মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আন্দোলন গতকাল পর্যন্ত চলছিল। তারা সারাদেশে স্মারকলিপি প্রদান, মানববন্ধন, সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন। তবে তাদের বেশির ভাগই মনে করতেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্যই ‘বিতর্কিত বই’ বাদ নেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন। কিন্তু তাদের সেই দাবির কোনো তোয়াক্কা না করেই পাঠ্যপুস্তকে ডারউইনের বিতর্কিত মতবাদ, হিন্দুত্ববাদ, হাজার হাজার বছরের সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি বিনষ্টকারী, নগ্ন ও অশ্লীল ছবি যুক্ত করা এবং বাংলাদেশের কৃষ্টিকালচার বিরোধী বিষয় অন্তর্ভুক্ত রেখেই বইগুলো কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছিল। অবশ্য ‘বিতর্কিত বই’ ক্লাসে পড়ানোয় শিক্ষামন্ত্রীর গোয়ার্তুমিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এবং আমলাদের অনেকেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তুলে নেয়া বিতর্কিত পাঠ্য বইগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মাদরসার জন্য ছাপানো বইগুলোতে এদেশের মুসলমানদের তাহজীব-তামাদ্দুন, কৃষ্টি-কালচার মাদরাসা শিক্ষার অনুপযোগী। মাদরাসার সাথে সংশ্লিষ্টরা জানান, ৬ষ্ঠ শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, গণিত, শিল্প সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও ধর্ম শিক্ষা এ ৯টি বিষয়ের কোথাও কোরআন সুন্নাহ, মুসলিম মনীষী, বিজ্ঞানী, গবেষকদের কোনো বাণী বা জীবনী থেকে কিছুই অন্তভূক্ত করা হয়নি। বরং ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে বিবর্তনবাদ, প্রাচীন সভ্যতার নামে মূর্তি, হিজাববিহীন মেয়েদের ছবি, গান-বাজনা, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার, খেলাধুলা, মোবাইল ব্যবহারের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। বিজ্ঞানের নামে নগ্ন অশ্লীল ছবি, কুকুরের ছবি, সভ্যতার নামে উলঙ্গ ও অর্ধউলঙ্গ মূর্তির ছবি দেয়া হয়েছে। দেড় হাজার বছরের মুসলিম ঐতিহ্য, নীতি-নৈতিকতা, কবি সাহিত্যিকদের অবদান উপেক্ষা করা হয়েছে। বাংলাদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির আলোচনা খুবই কম। বইগুলোতে তিনশতাধিক মেয়ের ছবি পর্দাবিহীনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
বিতর্কিত বইগুলো প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন করেছেন মাদরাসার এমন একাধিক গতকাল শিক্ষক বলেন, এ সরকার মাদরাসা শিক্ষার অনেক উন্নতি করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদেও মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির হিন্দুত্ববাদী চেতনা ধরণের গোয়ার্তুমির কারণে বিষয়টি এতোদূর ফেব্রæয়ারি মাস) গড়ালো। না হলে জানুয়ারি মাসে ক্লাস শুরুর আগেই বিতর্কিত বইগুলো সংশোধন করা যেত।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বিজ্ঞপ্তি : ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ ও ‘অনুশীলনী পাঠ’ পাঠ্যপুস্তক দুইটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ফরহাদুল ইসলামের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, শ্রেণিগুলোর জন্য প্রণীত ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলনী পাঠ’ এবং ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ পাঠ্যপুস্তকসমূহের কতিপয় অধ্যায়ের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে। পাঠ্যপুস্তকগুলোর অন্যান্য সব অধ্যায়ের পাঠদান অব্যাহত থাকবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, সংশোধনীসমূহ শিগগিরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে অবহিত করা হবে।
এদিকে গতকাল শুক্রবার চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলায় এক উঠান বৈঠকে অংশ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি বলেন, আমরা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন দুটি বই প্রণয়ন করে দেবো। এখন থেকে ওই বই দুটি পড়ানো বন্ধ থাকবে। ওই বিষয়ের (ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান) দুইটা করে বই। একটা করে পড়ানো বন্ধ থাকবে। ওটা পড়ার দরকার নাই। বইয়ে ইসলামবিরোধী কিছুই নাই, তারপরও আমরা মানুষের কথা শুনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন