প্রস্তুত কর্ণফুলীর তলদেশে দেশের প্রথম সুড়ঙ্গ পথ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। শিগগির টানেল চালুর আয়োজন এগিয়ে চলছে। নদীর নীচে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম এই টানেলটি প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। টানেলের ভেতর দিয়ে যানবাহন চলবে ৮০ কিলোমিটার গতিতে। টানেল চালু হলে শুরুতে বছরে ৬৩ লাখ যানবাহন চলাচল করবে। সে হিসাবে টানেল দিয়ে দিনে চলতে পারে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে দিনে গড়ে ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন যাতায়াত করবে। আগামী ২০৩০ সালে যানবাহনের এ সংখ্যা এক কোটি ৩৯ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
তবে এতো বেশি যানবাহনের চাপ সামাল দেয়ার মতো সংযোগ সড়কসহ অবকাঠামো এখনও গড়ে না উঠায় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকার টানেলের সুফল নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। নগরীর পতেঙ্গা প্রান্তে টানেলের প্রবেশ পথে একটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ চারটি সড়কের সংযোগ স্থল। এরফলে সেখানে টানেলের যে গোলচত্বর নির্মাণ করা হয়েছে তাকে ঘিরে যানজটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই গোলচত্বর হয়েই টানেলের গাড়ি আসা-যাওয়া করবে। টানেলের সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সংযোগ সৃষ্টিকারী সিটি আউটার রিং রোড যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হলেও তিনটি সংযোগ সড়কের একটিও নির্মাণ শেষ হয়নি। আবার এলিভেডেট এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজও চলছে ধীরগতিতে।
অন্যদিকে টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে একটি ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও আট কিলোমিটার দীর্ঘ ছয় লেন সড়কের কাজ এখনও বাকি। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক এখনও দুই লেনের হওয়ায় সে মহাসড়কেও টানেলমুখী যানবাহনের জটের আশঙ্কা রয়েছে। টানেল খুলে দেওয়ার পর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বাড়বে। এমনিতেই সরু ওই মহাসড়কে তীব্রজট, চরম বিশৃঙ্খলা। তার উপর টানেলমুখী যানবাহনের চাপ বাড়লে মহাসড়কটিতে রীতিমত অচলাবস্থার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে টানেল হয়ে দ্রæত কক্সবাজার আসা-যাওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। প্রকৌশল খাতে বিশেষজ্ঞরা এসব বাধা দূর না হলে টানেলের পুরোপুরি সুফল পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন।
টানেল ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিট পুলিশের (সিএমপি) কমিশনারের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ইতোমধ্যে এসব বাধা চিহ্নিত করে তা অপসারণের পরামর্শ দিয়েছে। তবে এসব সমস্যার শিগগির সমাধান হচ্ছে না। বাধা দূর করতে আউটার রিং রোডসহ কিছু প্রকল্প সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধীরে ধীরে এসব এসব অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হলে টানেলের অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ সামাল দেয়া যাবে।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সড়ক বিভাগের তরফে বলা হচ্ছে আগামী মার্চে টানেল চালু করা হবে। চীনের আর্থিক ও কারিগড়ি সহযোগীতায় নির্মিত টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। দুই সুড়ঙ্গে দুটি করে মোট চারটি লেন রয়েছে। মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক রয়েছে। আর আনোয়ারা প্রান্তে রয়েছে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার। ফ্লাইওভারের পর ছয় লেনের আট কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের কাজ চলছে।
চালু হলে টানেল ব্যবহারকারী সব গাড়ি বর্তমান নকশায় বিদ্যমান গোলচত্বর দিয়ে চলাচল করবে। আবার এই গোলচত্বর দিয়ে চলাচল করবে সিটি আউটার রিং রোড, লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পতেঙ্গা সৈকত সড়ক, বিমানবন্দর সড়ক ও সৈকতে আসা গাড়িগুলো। আবার চট্টগ্রাম বন্দর, আশপাশের বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো ও ইপিজেডগুলোর আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল করবে টানেল দিয়ে। কিন্তু বিদ্যমান নকশার গোলচত্বর এত গাড়ির চাপ সামাল দিতে পারবে না। যান চলাচলের বাধা দূর না হলে টানেলের দুই প্রান্তে যানজটের শঙ্কা রয়েছে।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি ও বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়–য়া বলেন, দুই প্রান্তে সড়ক অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা না হলে টানেলের সুফল মিলবে না। টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে কিছু সড়ক সম্প্রসারণ করা হলেও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ওই অঞ্চলের প্রায় সব সড়ক অপ্রশস্ত। আবার পতেঙ্গা প্রান্তে এক সাথে চারটি সড়কের সংযোগ স্থল হওয়ায় সেখানে যানবাহনের জটলা তৈরী হবে।
ইতোমধ্যে সিটি আউটার রিং রোড ও বন্দরের টোল রোড হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাট অংশে যানজট হচ্ছে। টানেল কোন ব্রীজ নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ধরনের স্পর্শকাতর স্থাপনার সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না হলে এটি এক সময় সুফল দেয়ার বদলে বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সিটি আউটার রিং রোড চালুর পর ওই সড়কে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। তবে ওই সড়কের সাথে নগরমুখী তিনটি সংযোগ সড়কের একটিও চালু হয়নি। তাতে রিং রোডের সুফল পুরোপুরি মিলছে না। নগরীর যানবাহনগুলোকে অনেক পথ ঘুরে চলাচল করতে হচ্ছে। বন্দর, ইপিজেড এবং বেসরকারি ডিপোতে ভারী যানবাহনের চাপ বাড়ছে। বর্তমানে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারমুখী পণ্য ও যাত্রীবাহী যানবাহন চলাচল করে কর্ণফুলী সেতু ও কালুরঘাট সেতু দিয়ে। টানেল চালু হলে শুরুতে কর্ণফুলী সেতু দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের একাংশ সেতুর বদলে টানেল দিয়ে চলাচল করবে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের শিল্পকারখানার পণ্যবাহী গাড়ি। ধীরে ধীরে এই সংখ্যা বাড়বে আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহন ঘিরে।
চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কন্টেইনার চালু হলে যানবাহনের চাপ আরো বাড়বে। ওই দিকে কালুরঘাট সেতু জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় টানেল চালু হলে কক্সবাজার, বান্দরবান ও দক্ষিণ চট্টগ্রামমুখী উত্তর চট্টগ্রামের যানবাহনগুলো টানেল হয়ে চলাচল করবে। কিন্তু এসব যানবাহনের জন্য এলিভেডেট এক্সপ্রেসওয়ের পতেঙ্গা থেকে বন্দর নিমতলা পর্যন্ত অংশ গত ডিসেম্বরে খুলে দেয়ার কথা থাকলেও কাজ এখনও শেষ হয়নি। টানেলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে আসা যানবাহনের চাপও বাড়বে। তবে এখন যে অবকাঠামো তাতে এতো বেশি যানবাহনের চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। মহেশখালীতে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর এবং চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় প্রকল্প বে-টার্মিনাল চালু হলে টানেল হয়ে যানবাহনের চাপ আরো বেড়ে যাবে।
পতেঙ্গাপ্রান্তে গোলচত্বর ছাড়া বাকি অবকাঠামো নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ। সিডিএর কর্মকর্তারা জানান, পতেঙ্গা এলাকায় টানেলের প্রবেশ পথের কাছে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পগুলো মিলিত হয়েছে। সেখানে রয়েছে সমুদ্র সৈকত। প্রতিদিন সেখানে হাজারো মানুষের সমাবেশ ঘটে। এসব মাথায় রেখে টানেল কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছিল, তারা যে গোলচত্বর করছে, তা যথেষ্ট নয়। কিন্তু বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি সেতু কর্তৃপক্ষ। যদিও সেতু বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেই গোলচত্বর নির্মাণ করা হয়েছে। টানেল চালু হলেই যে সমস্যা দেখা দেবে বিষয়টি এমন না। তবে ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে।
টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস। তিনি বলেন, আউটার রিং রোডের সংযোগ সড়কের কাজ দ্রæত এগিয়ে যাচ্ছে। খুব শিগগির একটি সড়ক চালু করা যাবে। ট্রাফিক বিভাগের পরামর্শে রিং রোডে সার্ভিস লেন, ইউটার্ন নির্মাণ করা হয়েছে। টানেলমুখি যানবাহনের চাপ কমাতে এক্সপ্রেসওয়ের বন্দর নিমতলা পর্যন্ত চালুর কাজও এগিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে আনোয়ারা প্রান্তে আট কিলোমিটার সংযোগ সড়কের চার লেনের কাজ হলেও আরো দুই লেনের কাজ এখনও বাকি। এ প্রসঙ্গে প্রকল্পের পরিচালক দোহাজারী সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন সিংহ বলেন, প্রকল্পের চার লেনের কাজ শেষ হয়েছে। তাতে টানেলমুখি যানবাহন চলাচলে কোন সমস্যা হবে না। কারণ টানেলও চার লেনের। তবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ছয় লেনের কাজ শেষ হবে বলে জানান তিনি। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চার লেনের কাজ দ্রæত শুরু হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন