সউদী প্রবাসী আতাউর মোল্লা। এবার ছুটিতে এসেছেন ভাই-বোনদের সঙ্গে পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা করার জন্য। এক বোন সম্পত্তি বিক্রি করবেন। কিন্তু বণ্টননামা না হওয়ায় কেউ কিনছে না। বণ্টননামা রেজিস্ট্রিও করতে পারছেন না। সম্প্রত্তি যিনি ক্রয়ে আগ্রহী তিনিও মালয়েশিয়া প্রবাসী। দু’জনেরই ফুরিয়ে আসছে ভিসার মেয়াদ। তাহলে কি বিষয়টির ‘ফয়সালা’ না করেই ফিরে যেতে হবে বিভুই-কর্মস্থলে? দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে উভয়ের কপালে। সাব-রেজিস্ট্রার নেই দু’মাস হলো। ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে বদলি করে দেয়া হয় নারায়ণগঞ্জ সোনারগাঁ উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার বজলুর রহমান মÐলকে। তাকে গাইবান্ধায় বদলি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তিনি চলে যাওয়ার পর এখানে স্থায়ীভাবে কাউকে পোস্টিং দেয়া হয়নি। পার্শ্ববর্তী আড়াইহাজারের সাব-রেজিস্ট্রার আলী আসগর চার্জে ছিলেন কিছু দিন। সপ্তাহে দু’দিন কাজ চালাতেন। কিন্তু তার পক্ষে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হতো না। অতি সম্প্রতি ফতুল্লার সাব-রেজিস্ট্রারকে চার্জে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। বজলুর রহমানকে গাইবান্ধা পোস্টিং করলেও যোগদান করেননি। তিনি আবারও সোনারগাঁওয়ে আসার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। দুই মাসেও এখানে কাউকে পদায়ন না করায় বন্ধই হয়ে গেছে সোনারগাঁয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাব রেজিস্ট্রার অফিসের দলিল নিবন্ধন।
শুধু সোনাউল্লা মৌজার আতাউর মোল্লাই নন। তার মতো ভুক্তভোগী এমন হাজারও মানুষ। জমি ক্রয়-বিক্রয় রেজিস্ট্রিসহ সব ধরণের নিবন্ধন এবং অন্যান্য কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রয়েছে সোনারগাঁও সাব রেজিস্ট্রি অফিসে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের অত্যন্ত শিল্পঘন এলাকা সোনারগাঁও। পাশদিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘনা নদী, ঘোষিত অর্থনৈতিক অঞ্চল, অবকাঠামো ও যোগাযোগ সুবিধার কারণে অঞ্চলটিতে বাড়ছে শিল্পসম্প্রসারণ। রাজধানী সংলগ্ন হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান এখানে খুলে বসেছে আবাসন ব্যবসা। এতে জমির দাম যেমন অবিশ্বাস্য হারে বেড়েছে। তেমনি বেড়েছে ক্রয়-বিক্রয়। এখানে দ্রæত হাতবদল হয় জমি। দলিল নিবন্ধনের হারও বেশি। এ কারণে সোনারগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসটি নিবন্ধন সেক্টেরে ‘এ গ্রেড স্টেশন’ হিসেবে পরিচিত। অনেক সাব-রেজিস্ট্রার এখানে ঘুষের বিনিময়ে এখানে বদলি হতে আগ্রহী। যিনি একবার পোস্টিং পানতো তিনি দীর্ঘদিন থাকার চেষ্টা করেন। এ বাস্তবতার মধ্যেও স্টেশনটি দীর্ঘদিন সাব- রেজিস্ট্রার শূন্য।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বছরে এখানে ২২ থেকে ২৫ হাজার দলিল রেজিস্ট্রি হয়। গতবছর সর্বনি¤œ প্রায় ১৮ হাজার দলিল নিবন্ধন হয়েছে। প্রতিমাসে বিভিন্ন ধরণের দলিল নিবন্ধ হয় দেড় থেকে ২ হাজার। উপজেলার অধীন অন্তত ১২০টি মৌজা। এখানে দৈনিক দলিল রেজিস্ট্রি হয় দেড় থেকে দুইশ’। এসব কারণে সোনারগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল দাতা-গ্রহিতার ভিড় লেগেই থাকে। সব ধরণের দলিল নিবন্ধন ছাড়াও আরো অনেক কাজ রয়েছে সাব রেজিস্ট্রারের। দলিল নিবন্ধনের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব আদায়, সম্পত্তির সর্বনি¤œ বাজারমূল্য নির্ধারণ, আইন ও বিধি অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকার রেকর্ড সংরক্ষণ, গ্রাহকের চাহিদানুযায়ী বিভিন্ন দলিলের নকল সরবরাহ, নিবন্ধন আইনের ৬০ ধারা অনুযায়ী দলিল বালামভুক্তির পর মূল দলিল পক্ষগণকে ফেরত দেয়া, ভিজিট ও কমিশনের মাধ্যমে অসুস্থ রোগী, সম্ভ্রান্ত পরিবার ও পর্দানশীন মহিলাদের দলিল বাসায় গিয়ে নিবন্ধন সম্পাদন করা, নিকাহ রেজিস্ট্রার এবং হিন্দু বিবাহ নিবন্ধকগণের নিয়োগ কমিটির সদস্য-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন, সেবা গ্রহিতাদের বিভিন্ন রেকর্ড তল্লাশি ও পরিদর্শনের সুযোগ করে দেয়া, সেবা গ্রহিতাদের বিনাপণে রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত আইনি পরামর্শ প্রদান, অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মবণ্টন, পদায়ন ও শৃঙ্খলা বিধান। ১৯০৮ সালের রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী ভ‚মি হস্তান্তরে দলিল নিবন্ধন করা সাব-রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব বলে উল্লেখ করা হলেও তাদেরকে অন্তত ১৮ ধরনের কার্যক্রমের দায়িত্ব পালন করতে হয়। ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৫৩ (গ) ধারা অনুযায়ী জমি দাতা বা বিক্রেতার নামে খতিয়ান নিশ্চিত হওয়ার পর তারা দলিল সম্পাদন করেন। তা সত্তে¡ও নানাবিধ আইনি জটিলতার মুখোমুখি হন তারা। এসব বিবেচনায়ও সাব-রেজিস্টার পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সোনারগাঁও সাব রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক সমিতির সভাপতি হাজী মো. খলিলুর রহমান জানান, সাব রেজিস্ট্রার না থাকায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছেন এখানকার মানুষ। দাতা-গ্রহিতা ছাড়াও একটি দলিলের সঙ্গে অনেক বিষয় সম্পৃক্ত। আর্থিক লেনদেন, বিক্রেতার অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, স্ট্যাম্প ক্রয়, ব্যাংকে পে-অর্ডার, কোর্ট ফি ক্রয়, সাক্ষী-সাবুদ হাজির করা, ওয়ারিশান সংক্রান্ত জটিলতা, এমন অনেক বিষয় রয়েছে। দেখা গেলো ক্রেতা-বিক্রেতা সবধরনের প্রস্তুতি নিয়ে দলিল করতে আসেন। এসেই দেখেন সাব-রেজিস্ট্রার নেই। এতে দারুণ অসুবিধার সম্মুখিন হন দাতা কিংবা গ্রহিতা। তিনি বলেন, দুই মাস হলো সোনারগাঁয়ে জমি কেনা-বেচা তথা সব ধরনের হস্তান্তর বন্ধ। শত শত জমি রেজিস্ট্রি আটকে আছে। বিশেষ করে যেসব ক্রেতা-বিক্রেতা বিদেশে থাকেন তাদের জন্য মারাত্মক অসুবিধা। দলিল না করেই অনেককে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়তে হচ্ছে। শিল্প-কারখানার বন্ধকী দলিল নিবন্ধন, প্রকল্পের জন্য জমি ক্রয়-বিক্রয়, নকল উত্তোলন, তল্লাশী, সব কিছুই বন্ধ রয়েছে। বণ্টননামা দলিল না হওয়ায় অনেক ওয়ারিশ নামজারি করতে পারছেন না। কেনা-বেচাও করতে পারছেন না। শুধু যে ডিড রাইটারদের জীবিকা বন্ধ হয়ে গেছে বিষয়টি শুধু তেমন নয়। জমিজমা সংক্রান্ত প্রায় সব কার্যক্রমই এখন বন্ধ। এ নিয়ে আমরা জেলা রেজিস্ট্রারের কাছে একাধিকবার দেন-দরবার করেছি। তিনি স্থায়ী কোনো সমাধান দিতে পারেননি। এমতাবস্থায় অবিলম্বে একজন নিয়মিত সাব-রেজিস্ট্রার পদায়ন করে বিদ্যমান সঙ্কট নিরসনের অনুরোধ জানান হাজী মো. খলিলুর রহমান।
শুধু সোনারগাঁওই নয়। দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা রয়েছে সীমান্তবর্তী জেলা মেহেরপুর সদর রেজিস্ট্রারের পদ। চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার মেহেরপুর এসে সপ্তাহে দু’দিন অফিস করেন। ফলে সপ্তাহে মাত্র দু’দিন এখানে জমি বেচা-কেনা হয়। একই জেলার গাংনী উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কার্যক্রমও পুরোপুরি বন্ধ ছিলো। এখানকার সাব-রেজিস্ট্রার দুই মাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে ছুটিতে ছিলেন ২ মাস। এতে জমি ক্রেতা-বিক্রেতাদের মাঝে নেমে আসে দুর্ভোগ।
এদিকে সীমান্তবর্তী জেলা চাপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। গত ডিসেম্বরে এখানকার সাব-রেজিস্ট্রার মো. ইউসুফ আলীর ওপর হামলা করেন স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। হামলায় তিনি গুরুতর আহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে এমনিতেই বেশ কিছুদিন শিবগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রি অফিসের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। পরে নিকটস্থ ভোলাহাট উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার বিদ্যুৎ কুমার মন্ডলকে শিবগঞ্জের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু হামলার ঘটনার তদন্ত কাজে ব্যস্ত থাকায় তারপক্ষেও চাহিদানুযায়ী দায়িত্ব পালন সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে গুরুতর আহত ইউসুফ আলী এখনও সুস্থ না হওয়ায় কাজে যোগদান করতে পারেননি। এতে সেবা গ্রহিতাদের ওপর ভোগান্তি নেমে এসেছে সীমাহীন।
সাব-রেজিস্ট্রার পদায়ন না করায় দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জমি বেচা-কেনা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে জনদুর্ভোগের পাশাপাশি বন্ধ হয়ে গেছে দলিল নিবন্ধন বাবদ রাজস্ব আদায়। এতে জনসেবা বিঘিœত হওয়ার পাশাপাশি সরকার অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যমান সঙ্কট কবে নাগাদ দূর হবে নিশ্চিত করে বলতে পারছে না সাব-রেজিস্ট্রার নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ নিবন্ধন অধিদফতরও।
আইনমন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে ৫০১টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস রয়েছে। এসব অফিসে গড়ে আড়াই থেকে ৩ লাখ বিভিন্ন ধরনের দলিল নিবন্ধন হয়। ২০২০ সালের হিসেব মতে, ওই বছর দলিল নিবন্ধন বাবদ ৫শ’ ২৯ কোটি ৮১ লাখ ৫১ হাজার টাকার রাজস্ব আদায় হয়। রাজস্ব আয়ের বিশাল এই খাতের অন্তত ৭০টি অফিসে কোনো সাব-রেজিস্ট্রার নেই। জানা গেছে, আইনি বৈষম্য ও বিধানগত জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরে সাব-রেজিস্ট্রার নিয়োগ, পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া নিয়মিত বদলি,পদায়নও হচ্ছে না দু’মাস ধরে। মন্ত্রণালয়ের অধীন নিবন্ধন অধিদফতরের মহা-পরিদর্শক (আইজিআর) মো. শহীদুল আলম ঝিনুক গত ২৯ ডিসেম্বর অবসর-পূর্ব ছুটিতে চলে যান। এরপর এ পদে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। তখন বন্ধ রয়েছে সাব-রেজিস্ট্রার নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, পদোন্নতিসহ গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম। তবে রুটিন কার্যক্রম পরিচালনায় আইজি আর’র অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আইনমন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব উম্মে কুলসুমকে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি চার্জে আছি। এ বিষয়ে তেমন কিছু আমার জানা নেই। আইজি আর নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। তিনি যোগদান করলে হয়তো বিদ্যমান সঙ্কট কেটে যাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন