রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ চরম আকার ধারণ করেছে। গত টানা ৪৫ দিন ধরে ঢাকার বাতাস স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সুইজারল্যান্ডের বায়ুদূষণ পরিমাপক সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) তথ্য অনুযায়ী গত ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বায়ুমান সূচক ছিল ৩৩৫। যা চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির অর্থাৎ নাগরিকদের জন্য ছিল বিপজ্জনক। গত বছর ২৬ ডিসেম্বর থেকে অর্থাৎ গত দেড় মাস ধরে ঢাকার বাতাসের মান কখনো ‘অস্বাস্থ্যকর’, কখনো ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’, আবার কখনো ‘বিপজ্জনক’ এই তিন ক্যাটাগরিতেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৩১ দিনের ১০ দিনই বাতাসের মান বিপজ্জনক পর্যায়ে ছিল। অন্যদিকে বাকি ২১ দিন ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর কিংবা অস্বাস্থ্যকর। শুধু তাই নয়, চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের গেল ১৩ দিনেও রাজধানীবাসী দূষিত বাতাসেই নিঃশ্বাস নিয়েছেন।
উল্লেখ্য, বায়ুমানের ক্ষেত্রে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স তথা একিউআই’র মান ৫০ পর্যন্ত হলে তাকে স্বাস্থ্যকর বায়ু বলা হয়। ৫১ থেকে ১০০ পর্যন্ত থাকলে তা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের ধরা হয় যদিও ব্যক্তিবিশেষে তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত মাত্রাকে বলা হয় অরেঞ্জ লেভেল যা সাধারণ মানুষের জন্য খুব একটা ক্ষতিকর না হলেও কারো কারো স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। ১৫০ থেকে ২০০ পর্যন্ত থাকলে তা অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর এই মান ২০০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত চরম অস্বাস্থ্যকর। আর একিউআই ৩০০-এর বেশি হলে সেটিকে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ঢাকার বায়ুমান এখন প্রায়ই ৩০০ অতিক্রম করছে। এ ছাড়া বেশির ভাগ সময়ই ২৫০ থেকে ৩০০ এর মধ্যে থাকছে। সে হিসেবে ঢাকার বাতাস নগরবাসীর জন্য খুবই অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক।
বায়ুদূষণ শহরবাসীদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর, বিশেষ করে শিশু এবং বয়স্কদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে কয়েক গুণ। স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব মানে সবকিছুর ওপর প্রভাব পড়ছে। মানুষের কর্মক্ষমতা কমছে, উৎপাদন কমছে। উপর্যুপরি বায়ুদূষণে শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সায়েন্টিফিক জার্নাল জামা নেটওয়ার্কে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয় বায়ুদূষণের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিষণœতার ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণ শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। দীর্ঘদিন বায়ুদূষণের মধ্যে থাকলে বা এরকম পরিবেশে কাজ করলে ফুসফুসের ক্যান্সার এবং হৃদরোগের দেখা দিতে পারে। এমনকি সেটা মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও তৈরি করতে পারে। বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে তার অধিকাংশই বায়ু দূষণজনিত। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণের কারণে বছরে ৪২ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের সা¤প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, বায়ুদূষণে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু কমেছে ৭ বছর। আর রাজধানীবাসীর গড় আয়ু কমছে ৮ বছর করে। ওই গবেষণায় বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, নগরে অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প, নির্বিচারে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করা এবং নির্মাণ সামগ্রী প্রকাশ্যে পরিবহণ, ঢেকে না রেখে কাঠামো তৈরি করা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং ইটের ভাটা রাজধানীর বায়ুদূষণের প্রধান কারণ। পরিবেশবিদরা বলছেন, ঢাকার বায়ুদূষণের এই পরিস্থিতিতে এখনই জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয় নিয়ে চরম উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের। বিশেষজ্ঞরা ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য মূলত এ শহরের রক্ষকদের অর্থাৎ দুই সিটি কর্পোরেশনের অবহেলাই দায়ী বলে মনে করেন। রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সিটি কর্পোরেশনকে উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিলেও তা পুরোপুরি মানা হচ্ছে না। এতে আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করে আগামী ২০ ফেব্রæয়ারির মধ্যে বায়ুদূষণ রোধে তারা কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন তা জানাতে বলেছেন।
রাজধানীতে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পের কাজ চলছে। এসব কাজের জন্য মিরপুর, উত্তরা, ফার্মগেট, শহবাগ, পল্টন, মতিঝিল এসব এলাকায় রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ির ফলে ব্যাপক ধুলোবালি হচ্ছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর এসব এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে পানি ছিটানো হলেও তা খুবই অপ্রতুল। এ ছাড়া সুয়ারেজ লাইন মেরামত, গ্যাস লাইনসহ আরো নানাবিধ কাজের জন্য প্রতিনিয়ত রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি হচ্ছে। আর এসব কাজ করতে গিয়ে দীর্ঘ সময় নেওয়া হচ্ছে। এতে রাজধানীর বাতাস ব্যাপক হারে দূষিত হচ্ছে। নির্মাণ কাজ রাজধানীর বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস। নির্মাণকাজের মাধ্যমে বায়ুদূষণ রোধের জন্য সারা বিশ্বে প্লাস্টিকের একটি পরিবেষ্টন দেয়া হয়। অথচ আমাদের দেশে সেটা করা হয় না। উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকার পরও খোলামেলা ভাবে নির্মাণ কাজ চলে। সিটি কর্পোরেশন এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয় না। বায়ুদূষণের অরেকটি উৎস হলো যানবাহন। রাজধানীতে চলাচল করা যানবাহনগুলোয় মানসম্মত জ্বালানি ব্যবহার না করা, নিম্নমানের লুব্রিকেন্ট ব্যবহার, নিয়মিত রক্ষণা-বেক্ষণের অভাব এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন হতে সৃষ্ট ক্ষতিকর কার্বন-মনোক্সাইড, সীসা, সালফার, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ওজোন, নাইট্রোজেন-অক্সাইড, পলিনিউক্লিয়ার অ্যারোমেটিক্সসহ বিভিন্ন ধরনের হাইড্রোকার্বনই বায়ুদূষণের জন্য প্রায় ৭০ শতাংশ দায়ী। বায়ুদূষণের আরেকটি উৎস হলো ইটের ভাটা। ঢাকার চারপাশে অসংখ্য অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। যেগুলো থেকে বায়ুদূষণ হচ্ছে। তবে বর্তমানে এগুলো বন্ধে পরিবেশ অধিদফতর পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব ইনকিলাবকে বলেন, পরিবেশসংক্রান্ত আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সব ধরনের দূষণমুক্ত রাখার দায়িত্ব মূলত সিটি কর্পোরেশনের। তবে তারা সে দায়িত্ব পালনে খুব আন্তরিক নয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অধিকাংশ সরকারি সংস্থা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে দূষণ সৃষ্টি করছে। তারা রাস্তা খননের জন্য সিটি কর্পোরেশনের কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্স বা অনুমতি নেয়। রাস্তা খুঁড়ে দীর্ঘদিন ফেলে রাখে। তবে সিটি কর্পোরেশন এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। পরিবেশ অধিদফতর পরিবেশ সুস্থ রাখার একক কর্তৃত্ব থাকা সত্তে¡ও জনবলের অভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস ইনকিলাবকে বলেন, বায়ুদূষণ রোধে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ওপর অর্পিত দায়িত্বানুযায়ী আমরা কাজ করে চলেছি। খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি ও সংস্কার কাজ আমরা নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী সম্পন্ন করছি। এখন-যখন-তখন কোনো সংস্থা নিজেদের মতো করে আর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করতে পারে না। আমাদের সাথে সমন্বয় করেই সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে কাজ করতে হচ্ছে। এছাড়াও প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা সড়কে পানি ছিটিয়ে চলেছি। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। সেজন্য বলা যায়, বায়ুদূষণ রোধে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কাজ করে চলেছে। তবে বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদফতরকেই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনের যথাযথ ও বাস্তবিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদফতরকে আরো জোরালো ভ‚মিকা নিতে হবে। এছাড়াও প্লাস্টিক প্রক্রিয়াজাতকরণ কার্যক্রমে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাসমূহের নিবিড় তদারকি ও ভ‚মিকা আরো বলিষ্ঠ হতে হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, ধুলোবালি নিবারণে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন অত্যাধুনিক স্প্রে ক্যাননের মাধ্যমে পানি ছিটাচ্ছে। দু’টি স্প্রে ক্যানন ডিএনসিসি এলাকার মহাসড়কে পানি ছিটানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ডিএনসিসির আওতাধীন পুরো এলাকার মহাসড়ককে দু’টি ভাগে ভাগ করে একদিন অন্তর অন্তর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দু’টি মেশিন দিয়ে পানি ছিটানো হচ্ছে। নির্মাণাধীন সড়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বেশি পরিমাণ পানি ছিটানো হয়।
তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক ড. হোসেন জিল্লুর রহমান অবশ্য বায়ুদূষণের জন্য শুধুমাত্র সিটি কর্পোরেশকে দায়ী বলে মনে করেন না। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশনের দায়তো অবশ্যই আছে। তবে এ জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায় সবচেয়ে বেশি। ইটভাটা বন্ধ তো সিটি কর্পোরেশনের কাজ নয়। এটা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কাজ। শহরের বাইরেও জীবন তো বিষিয়ে উঠছে। গ্রামের নির্মল বাতাসকে দূষিত করছে, তাও তো দেখতে হবে। চিন্তা বা মানসিক উন্নয়ন না করলে আপনি দৃশমান উন্নয়ন দিয়ে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবেন না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন