দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের তিনটি খাতে প্রচুর দক্ষ বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা রয়েছে। দেশটিতে বর্তমানে ১ লাখ ১৫ হাজার বাংলাদেশি কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন। দেশটির সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার নস্যাতে জালিয়াত চক্র আবারো সক্রিয়। সাম্প্রতিককালে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সিঙ্গাপুরে জনশক্তি পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে। তথ্য গোপন এবং জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দেশটিতে প্রায় ৬০ হাজার কর্মী পাঠিয়ে চারটি সুবিধাবাদী রিক্রুটিং এজেন্সি বার বারই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
চারটি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) রিপোর্টও পাঠানো হয়েছে। অজ্ঞাত কারণে মন্ত্রণালয় নীরব ভ‚মিকা পালন করছে। চারটি প্রতিষ্ঠান মিথ্যা তথ্য দিয়ে গত চার বছর ধরে দেশটিতে বিপুল সংখ্যক কর্মী পাঠিয়েছে। গত ৮ নভেম্বর বিএমইটির তদন্ত কর্মকর্তা মো. মাসুদ আনাম এক নোটিশে অভিযুক্ত চারটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিককে সাত দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়।
নোটিশে বলা হয়, বিএমইটির সার্ভার যাচাই করে দেখা যায় ওটিসি নবায়ন বা নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) না থাকা সত্তে¡ও ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স আল জান্নাত ওভারসীজ প্রাইভেট লিমিটেড ২ হাজার ৮৯৫ জন, আরএক্স কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল ১৫ হাজার ৪৮৭ জন এবং ওয়েলটেক এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস ২৪ হাজার ২১০ জন সিঙ্গাপুরগামী কর্মীর বহির্গমন ছাড়পত্র গ্রহণ করেছে। যা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন ২০১৩ এর ১২ (গ) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
গত ১৭ নভেম্বর বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম এক চিঠিতে প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বলেন, দি গাজীপুর এয়ার ইন্টারন্যশনাল তথ্য গোপন করে ২৩ হাজার ৩৭৪ জন কর্মীর সিঙ্গাপুরে প্রেরণের জন্য বর্হিগমন ছাড়পত্র গ্রহণ করেছে। আল জান্নাত প্রাইভেট লিমিটেড, আরএক্স কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল, ওয়েলটেক এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস সিঙ্গাপুরগামী কর্মীর বর্হিগমন ছাড়পত্র গ্রহণ করেছে। বিএমইটির ডিজি ওই চিঠিতে বলেন, উল্লেখিত চারটি রিক্রুটিং এজেন্সি অসাধুভাবে তথ্য গোপন করে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ওটিসি এবং এসও এর নবায়ন গ্রহণ করেছে মর্মে প্রতীয়মান হয়। তথ্য গোপন করে ওটিসি ও এসও-এর নবায়ন গ্রহণ এবং এসও হিসেবে সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণ অব্যাহত রাখা বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন ২০১৩ এর লঙ্ঘন।
ওয়েলটেক কনস্ট্রাকশন প্রা: লি: সিঙ্গাপুর এবং অভিযুক্ত চারটি রিক্রুটিং এজেন্সির পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আনুষঙ্গিক কাগজপত্রাদি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্ত একটি প্রভাবশালী মহলের তদবিরে এসব অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত ফাইল চাপা পড়েছে। এছাড়া গত ১৯ জানুয়ারি বিএমইটির ডিজি শহীদুল আলম প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে লেখা অপর চিঠিতে সিঙ্গাপুরস্থ বিসিএ দক্ষ কর্মী প্রেরণে ট্রেনিং ও টেস্টিং সেন্টার বাতিলের তথ্য গোপন করে সেন্ডিং অরগানাইজেশনের নাম ব্যবহার করে চারটি রিক্রুটিং এজেন্সির দুর্নীতির মাধ্যমে বিএমইটির ছাড়পত্র গ্রহণ করে, দেশটিতে কর্মী প্রসঙ্গে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণে লোকাল এনওসি হোল্ডার রিক্রুটিং এজেন্সি দি গাজীপুর এয়ার ইন্টারন্যাশনাল। চারটি রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্সের নবায়নের মেয়াদ গত ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে।
তবে সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণের বিল্ডিং এন্ড কনস্ট্রাশন কর্তৃপক্ষ (বিসিএ) এর ওভারসীজ ট্রেনিং এর অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এক্ষেত্রে বিসিএ এর ওয়েব সাইট যাচাই করে দেখা গেছে ওভারসীজ ট্রেনিংয়ের জন্য অনুমোদন তালিকায় ওভারসীজ টেস্টিং সেন্টার হিসেবে ওয়েলটেক কনস্ট্রাকশন প্রা: লি: এর নাম নেই। অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তদন্তের প্রতিবেদন প্রেরণ করা হয়। প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের এনফোর্সমেন্ট শাখার উপ-সচিব মো. মঈনুল হাসান গত ১৮ জানুয়ারি ও ২৩ জানুয়ারি দি গাজীপুর এয়ার ইন্টারন্যাশানলসহ চারটি এজেন্সিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছে। দি গাজীপুর এয়ারসহ চারটি রিক্রুটিং এজেন্সি ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়ে এনওসি নিয়ে চার বছর যাবৎ সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে উপ-সচিব মঈনুল হাসান বলেন, এসব রিক্রুটিং এজেন্সি শর্ত ভঙ্গ করে জালিয়াতি করে কর্মী পাঠালে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদের ব্যাপারে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে।
উল্লেখিত এজেন্সির বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও উপসচিব উল্লেখ করেন। বিগত চার বছর যাবৎ তথ্য গোপন করে বেআইনীভাবে সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে দি গাজীপুর এয়ার ইন্টারন্যাশনালের মালিক ফেরদৌস আহমেদ বাদল গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, জাল-জালিয়াতি এবং অবৈধভাবে সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণ করিনি। তিনি বলেন, ১৪টি রিক্রুটিং এজেন্সি যে প্রক্রিয়ায় কর্মী পাঠাচ্ছে সেভাবেই কর্মী পাঠিয়েছি। চলতি বছর এনওসি নবায়নের আবেদন করেননি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি ঐতিহাসিকভাবে সর্বাপেক্ষা উন্নত ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির ফসলরূপে গড়ে উঠেছে। হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুর এ চারটি এশিয়ার অর্থনীতিতে বাঘ হিসেবে পরিচিতি পেলেও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দিক থেকে সিঙ্গাপুর বেশ এগিয়ে রয়েছে। বিশ্বে মাথাপিছু আয়ের দিক দিয়ে এটি তৃতীয় সর্বোচ্চ স্থানীয়। মোট দেশজ উৎপাদনের হার ১৪.২%। ২০১৫ সালে ইকোনোমিক ফ্রিডমের ইনডেক্সে বিশ্বের দ্বিতীয় মুক্ত অর্থনীতির দেশ হিসেবে সিঙ্গাপুরকে চিত্রিত করা হয়েছে। দেশটির জাহাজ মেরামত শিল্প বিশ্বের ২০তম স্থান দখল করে রেখেছে। এ খাতে প্রায় ৭০ হাজার দক্ষ কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করছে। দেশটির তিনটি খাতে বর্তমানে প্রচুর বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা রয়েছে।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানায়, নিবন্ধন হওয়ার পর থেকেই ওয়েসিস সার্ভিসেস মন্ত্রণালয়ের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নানা প্রতারণা করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে ২০১৮ সালে ওয়েসিসকে সিংগাপুরে কর্মী প্রেরণের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। এরপর তাদের জামানতের অর্থ ৩০ লাখ টাকাও ফেরত দেয়া হয়। কিন্তু তারা তথ্য গোপন করে ৩ হাজারেরও বেশি কর্মী সিঙ্গাপুরে পাঠানোর জন্য ছাড়পত্র নেয়। এক্ষেত্রে তারা সিঙ্গাপুরের অংশীদার প্রোগ্রেসিভ বিল্ডার্সের সহায়তা নেয়।
বিএমইটি তদন্ত করে এর সত্যতা পেলে মন্ত্রণালয় ওয়েসিস ওভারসিজ লিমিটেডের লাইসেন্স বাতিলসহ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হুদা মেহেদিকে জরিমানাসহ প্রোগ্রেসিভ বিল্ডার্সের টেস্ট সেন্টারের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণ না করার সুপারিশ করে। জানা গেছে, বিএমইটির সুপারিশের পর মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কয়েক দফা শুনানি করে। সেখানেও প্রোগ্রেসিভ এবং ওয়েসিস এর বিরুদ্ধে জালিয়াতি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এরপর তা আদালতে গড়ায়। আদালত ওয়েসিস এর বিরুদ্ধে দেয়া শাস্তি স্থগিত করে মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি এক মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির আদেশ দেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ওয়েসিস সার্ভিসের লাইসেন্স দুই বছরের জন্য স্থগিত করাসহ প্রোগ্রেসিভ বিল্ডার্সের সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণের যাবতীয় এনওসি সংক্রান্ত কার্যক্রম স্থগিত রাখে। বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, এনওসি স্থগিত রাখার পরও প্রোগ্রেসিভ বিল্ডার্স নানা ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের সহায়তায় তারা ওয়েসিস-এর পরিবর্তে মাজ ওভারসিস নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে পার্টনার দেখিয়ে সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণের জন্য পুনরায় আবেদন করেছে। ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মোহাম্মদ আলী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ বিষয়ে বিএমইটির মহাপরিচালকের মতামত চাওয়া হয়েছে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গাইডলাইন ২০১৮-এর ১২ এবং ১৪ ধারা অনুযায়ী সিংগাপুরের কোম্পানির এনওসি পরিবর্তনসহ যে কোনো বিষয়ে বিবাদ দেখা দিলে তা মীমাংসা না করা পর্যন্ত নতুন এনওসি নিতে পারবে না। এটি জানার পরও মন্ত্রণালয়ের একটি অসাধু মহল তড়িঘড়ি করে প্রোগ্রেসিভকে সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণের এনওসি পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন