ছিলেন মেডিক্যাল অফিসার/স্ববেতনে সহকারী অধ্যাপক। অতিরিক্ত রেজিস্ট্রারের চিঠিতে পদোন্নতি পেয়ে হয়ে যান নিয়মিত সহকারী অধ্যাপক। সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়মিত হওয়ার ৯ মাস ২৫ দিনে আগের রেজিস্ট্রারের এক চিঠিতে পান সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি!
এমন ঘটনার অভিযোগ উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ট্রেজারার প্রফেসর ডা. মো. আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে। তার সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতিতে মানা হয়নি কোনো নিয়ম। হয়নি সিন্ডিকেট সভাও।
বিএসএমএমইউর সিনিয়র শিক্ষকরা বলছেন, তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক হলে, তার বর্তমানের প্রফেসর পদটিও অবৈধ। দেশের স্বনামধন্য চিকিৎসা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান জাতির জনকের নামের মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ে এমন ঘটনায় রীতিমত বিস্মিত অনেকে।
সহকারী অধ্যাপক পদে স্থায়ী না হয়েই মেডিকেল অফিসার থেকে তিনি কিভাবে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি নিলেন সেই প্রশ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের। কিন্তু প্রভাবশালীদের সঙ্গে ডা. মো. আতিকুর রহমানের সখ্যতা থাকায় ভয়ে তার বিরুদ্ধে কেউই মুখ খুলছেন না।
ডা. মো. আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে বিগত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে ভূয়া তথ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতি ও নিয়োগবিধি ভঙ্গ করে উচ্চতর গ্রেডে উন্নীত হওয়ার প্রমাণ এসেছে এ প্রতিবেদকের হাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসনের অনৈতিক সহযোগিতারও প্রমাণ মিলেছে নিয়োগ প্রক্রিয়ায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের ১ জুলাই রেজিস্ট্রার মুহাম্মাদ আবদুল গফুর স্বাক্ষরিত এক পত্রে ৬ শর্তে দুই বছরের চুক্তিতে ডা. মো. আতিকুর রহমানকে সাময়িকভাবে কার্ডিওলজি বিভাগে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করতে বলা হয়। ডা. মো.আতিকুর রহমান ১৯৯৯ সালের ৪ জুলাই ৩০ বছর ১ মাস ১৯ দিন বয়সে যোগদান করেন। ওই নিয়োগপত্রে উল্লেখিত দ্বিতীয় শর্তে বলা হয়, ২ বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তার নিয়োগ স্বংয়ক্রিয়ভাবে বাতিল হবে। যার স্বারক নং- বিএসএমএমইউ- ৯৯/২৩২৭।
সিন্ডিকেট সভায় পাস হওয়া নিয়োগবিধি অনুযায়ী কোর্সে থাকা কোন চুক্তিভিত্তিক চিকিৎসক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ও স্থায়ী হতে পারবেন না। কিন্তু এসব আইন ও সংবিধি ভঙ্গ করে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অদৃশ্য ক্ষমতাবলে ২০০২ সালের ৩১ ডিসেম্বর ডা. আতিকুর রহমানকে নিয়মিত করে।
২০১৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মেডিসিন বিভাগের (রেসপিরেটরি) প্রফেসর পদে ডা. মো. আতিকুর রহমানের নিয়োগ কার্যপত্রের তথ্য অনুযায়ী, তিনি ১৯৮৪ সালে এসএসসি, ১৯৮৬ সালে এইচএসসি, ১৯৯৪ সালে এমবিবিএস এবং ২০০২ সালে এম ডি (বক্ষব্যাধি) পাস করেন।
নিয়োগ কার্যপত্রের অভিজ্ঞতায় উল্লেখ রয়েছে, ১৯৯৯ সালের ৪ জুলাই থেকে ২০০২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ে রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০০৭ সালে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বিশ^বিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগে (রেসপিরেটরি) সহকারী অধ্যাপক (নিয়মিত) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত মেডিসিন (রেসপিরেটরি) বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক (পি পি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ২০১৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মডিসিন (রেসপিরেটরি) বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক (নিয়মিত) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি তাকে রেসপিরেটরী মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে স্ববেতনে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিধি অনুযায়ী স্ববেতনে অস্থায়ী সহকারী অধ্যাপক পদটি বর্তমান নবম গ্রেডের মেডিকেল অফিসার সমমানের একটি পদ।
এই পদে ২০০৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তৎকালীন অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার ডা. কাজী এবাদুল্লাহ স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে তিনি স্থায়ী হন। যার স্মারক নং বিএসএমএমইউ ২০০৮/৮০৩০। যোগদানের তারিখ ০৭/১০/২০০৮ইং, স্মারক নং বিএসএমএমইউ ২০০৮/৮২৮১(৬)।
ওই আদেশে বলা হয়েছে, ‘এই বিশ^বিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক পদে প্রার্থীর আবেদন যাচাই বাছাই কমিটি গত-২৫/৯/২০০৮ইং তারিখ অনুষ্ঠিত সভার সুপারিশের ভিত্তিতে কর্তৃপেক্ষর অনুমোদনক্রমে নিম্নলিখিত মেডিক্যাল অফিসার/স্ববেতনে সহকারী অধ্যাপকগণকে নিয়মিত সহকারী অধ্যাপক পদে পদায়ন করা হল।’
তবে নিয়োগ বিধি অনুযায়ী অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার বা সহকারী রেজিস্টারের শিক্ষক নিয়োগ বা পদোন্নতির চিঠি প্রদানের এখতিয়ার নেই। সিন্ডিকেটের অনুমোদনের পর শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও স্থায়ীকরণ পত্রাদেশ শুধু রেজিস্ট্রার প্রদান করতে পারবেন।
অপরদিকে ২০০৯ সালের ২৫ মে এই বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. আব্দুল গফুর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ডা. মো. আতিকুর রহমানকে ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে ব্যক্তিগত পদোন্নতি দেয়া হয়!
ওই পদোন্নয়ন পত্রে বলা হয়েছে, ‘আপনার ২৯/০৯/২০০৮ইং তারিখের আবেদনের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিটির সুপারিশ এবং কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে আপনাকে জানানো যাচ্ছে, আপনি বর্তমানে মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপকের (মেডিসিন রেসপিরেটরী) যে পদে নিয়োজিত আছেন, সেই পদটিকে আপগ্রেডিং এর মাধ্যমে সহযোগী অধ্যাপক পদে রূপান্তর করে ব্যক্তিগত পদোন্নয়নের মাধ্যমে উক্ত পদে আপনাকে নিম্মলিখিত শর্তে নিয়োগ করা হয়েছে।’
এমন অস্বভাবিক ঘটনা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তার অনেক সহকর্মীও। চাকরীবিধি অনুযায়ী সহকারী অধ্যাপক পদে একই বিষয়ে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ৩ বছর স্থায়ী চাকরী করার পর সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হবেন। স্ববেতনে সহকারী অধ্যাপক মানে মেডিকেল অফিসারের চাকুরীকাল কখনোই সহযোগী অধ্যাপক হওয়ার জন্য বিবেচিত হবে না। কিন্তু ডা. মো. আতিকুর রহমানের বেলায় সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়মিত হওয়ার ৯ মাস ২৫ দিন আগেই স্ববেতনে সহকারী অধ্যাপক/মেডিকেল অফিসার থেকে সরাসরি তাকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়!
পদন্নোতি ও নিয়োগ বিধির ৫(খ) ধারা অনুযায়ী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করার জন্য সিন্ডিকেট সভার অনুমোদনের বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি ডা. আতিকুর রহমানের বেলায়। নিয়মানুযায়ী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে বহুল প্রচারিত পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও নিয়োগ নির্বাচনী বোর্ডের সুপারিশ সিন্ডিকেট থেকে অনুমোদন নিতে হয় এবং সিন্ডিকেটে অনুমোদনের তারিখ থেকে এই নিয়োগ কার্যকর হয়। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডেকেট সভার ধারাবাহিক তারিখ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ডা. মো. আতিকুর রহমানের সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ কার্যকরের ০১-০১-২০০৪ খ্রি. ও ০১-০১-২০০৮ খ্রি. তারিখ কোন সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। এছাড়া ওই তারিখের পরের সিন্ডিকেট সভায়ও তার নিয়োগ সংক্রান্ত কোন আলোচ্যসূচিও ছিল না। ফলে তার এই নিয়োগের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক বলেন, পূর্বের ধারাবাহিক জালিয়াতির কারণে তার বর্তমানের অধ্যাপক পদটি ও আইন অনুযায়ী অবৈধ। চাকুরীবিধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধিতে ভুতাপেক্ষ পদোন্নতির কোন সুযোগ নেই। তিনি বিধিবর্হিভূতভাবে প্রতি পদে পদোন্নতিতে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া ২০০৪ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় আতিকুর রহমানের খন্ডকালীন কোর্সে অবৈধভাবে উত্তোলিত অর্থফেরত প্রদান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আর এসব তথ্য গোপন করার জন্য তার অফিস ফাইল (সার্ভিস ফাইল) গায়েব করেছেন। অফিস ফাইলে শুধু ২০১৩ সাল পর্যন্ত তার চাকরীর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
পরবর্তী সময়ের কোন ফাইল না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা কথা বলতে রাজি হননি।
এবিষয়ে ট্রেজারার প্রফেসর ডা. মো. আতিকুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার জন্য মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি।
জানতে চাইলে বিএসএমএমইউ’র বর্তমান রেজিস্ট্রার স্বপন কুমার তপাদার ইনকিলাবকে বলেন, এ বিষয়ে মোবাইলে আমি কোনো বক্তব্য দিতে পারছি না। আপনার কোনো কিছু জানতে চাইলে ভিসি মহোদয়ের বরাবর লিখিতভাবে জানতে চাইলে তিনি আপনাকে এ বিষয়ে জানাবেন।
উল্লেখ্য, গত বছরের জুনে এ ধরনের জালিয়াতির জন্য এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের স্বাস্থ্য বিভাগের বেশ কয়েকজন শিক্ষককে পদাবনতি ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। কিন্তু ডা. মো. আতিকুর রহমান এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ত কমিটির সভাপতি ও ট্রেজারার পদে বহাল থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। কথিত আছে বাংলাদেশ ও আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক ডা. আতিকুর রহমান ২০০২ সালে বিএনপি’র ডক্টরস এসোসিয়েশান অব বাংলাদেশ- ড্যাবে মোটা অংকের টাকা দিয়ে আজীবন সদস্য পদ লাভ করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন